অর্থ আত্মসাৎ করে পালিয়ে থাকা প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারকে দেশে আনতে এবং গ্রেপ্তারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে হাই কোর্ট। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যানকে ১০ দিনের মধ্যে তা জানাতে বলা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ এ আদেশ দেয়। পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কিংবা গ্রেপ্তারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা সে ব্যাখ্যা জানাতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। দুদক চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ও ঢাকা জেলা প্রশাসককে ১০ দিনের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আদেশের সময় আদালতে ছিলেন দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। খবর বিডিনিউজের।
পি কে হালদারের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে খুরশীদ আলম খান আদালতে বলেন, বর্তমানে সে পলাতক। আসার কথা বলেও সে দেশে আসে নাই। সর্বশেষ অবস্থা হল ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে ধরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, আত্মসাৎ করা টাকা দেশের বাইরে পাঠিয়েছে কি? জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, সেটাই তদন্ত চলছে। এখানে মানি লন্ডারিং হয়েছে। অনেক টাকাই বিদেশে পাঠিয়েছে। সেটার তদন্ত চলছে। পরে ৫ম পৃষ্ঠার ৪র্থ কলাম
বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, কেউ দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করবে আর সে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে, মগের মল্লুক নাকি! কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তাকে অবশ্যই দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে, আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। তাকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। এত টাকা সে কিভাবে আয় করেছে, কিভাবে সে বিদেশে পাচার করেছে! আমরা মনে করি তাকে ফিরিয়ে আনতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা সেটা আমাদের জানা দরকার।
বিচারক বলেন, একজন মানুষ হাজার হাজার কোটি নিয়ে যাচ্ছে, সে আইনের আওতার বাইরে থাকবে, কোর্টের আওতার বাইরে থাকবে, সমস্ত জাতিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাবে এটা হতে পারে না। তাকে ব্যাখ্যা করতে হবে কিভাবে এত টাকা বিদেশে নিয়ে গেল। এ বিষয়ে অব্যশই যথাযথ আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে। এটা অবশ্যই কোর্টের নজরে আনতে হবে। তার বিরুদ্ধে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। গত মঙ্গলবার দুদকের আইনজীবী বলেছিলেন, পি কে হালদারকে ইন্টারপোল দিয়ে ধরিয়ে আনার চিন্তা করছে কমিশন। খুব শিগগিরই আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটির কাছে নোটিস পাঠানো হবে। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আইএলএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। আইএলএফএসএল গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে বছরের শুরুতে পি কে হালদারের বিদেশ পালানোর পর দুদক তার ৩০০ কোটি টাকার ‘অবৈধ সম্পদের’ খবর দিয়ে মামলা করে। বিদেশে থাকা পিকে হালদার গত ২৮ জুন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে একটি আবেদন করেন। সেখানে বলা হয়, আইএলএফএসএল তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মালিকানার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে। তার অনুপস্থিতি ও দেশের মধ্যে সৃষ্ট ‘অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে ওইসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ‘জটিল আকার’ ধারণ করেছে। তিনি দেশে ফিরতে পারলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘সঙ্কট কেটে যাবে’ এবং মহামারীর সময়ে দেশের অর্থনীতিতে ‘ইতিবাচক ভূমিকা’ রাখতে পারবে বলে সেখানে দাবি করা হয়। আবেদনে বলা হয়, সেজন্য তিনি ‘ভয়ভীতিমুক্ত পরিবেশে’ দেশে ফিরতে চান এবং তার সব প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে আইএলএফএসএলসহ অন্যান্য সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দায়দেনা মিটিয়ে ফেলতে চান। পি কে হালদারের ওই আবেদন পাওয়ার পর তার জীবনের নিরাপত্তায় আদালতের হেফাজত চেয়ে আবেদন করে আইএলএফএসএল। এ আবেদনে শুনানির পর পিকে হালদার কখন কবে কোন ফ্লাইটে দেশে ফিরতে চান তা আইএল এফএসএলকে জানাতে বলে আদালত।
এক পর্যায়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর আইএলএফএসএল আদালতকে জানায়, ‘আত্মসাৎ করা অর্থ ফেরত দিতে’ জীবনের নিরাপত্তার জন্য আদালতের আশ্রয়ে দেশে ফিরতে চাইছেন পি কে হালদার। এরপর আইএলএফএসএলের পক্ষ থেকে হাই কোর্টে আবেদন করে বলা হয়, ২৫ অক্টোবর দুবাই থেকে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় আসার জন্য তিনি টিকিট কেটেছেন। বাংলাদেশ সময় সকাল ৮টা ১০ মিনিটে ওই ফ্লাইট ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামবেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ অক্টোবর হাই কোর্ট আদেশ দেয়। সে আদেশে আদালত বলে দেয়, পি কে হালদার বিমান থেকে দেশের মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার করে উপযুক্ত আদালতে সোপর্দ করতে হবে।
পি কে হালদার ‘নিরাপদে’ দেশে ফিরে যাতে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে পারেন, সেজন্য পুলিশ প্রধান, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু ২৪ আইএলএফএসএলের আইনজীবী ইমেইল করে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে জানায়, পি কে হালদার আপাতত দেশে ফিরছেন না। শারীরিক অসুস্থতা এবং কোভিড-১৯ এর কারণে তিনি আসছেন না। কখন আসবেন পরে জানাবেন। পি কে হালদার বিদেশ পালানোর পর আইএলএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণের পাশাপাশি তার সম্পত্তি জব্দ করা হয়। এর আগে আইএলএফএসএলে রাখা আমানতের টাকা ফেরতের নির্দেশনা চেয়ে সাত ব্যক্তি হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন। ওই আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট গত ২১ জানুয়ারি পি কে হালদার, তার মা, স্ত্রী, ভাই এবং ওই কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ১৯ জনের পাসপোর্ট জব্দের নির্দেশ দেয়। তাদের দেশত্যাগ ঠেকাতে ওই নির্দেশ দেওয়া হলেও পি কে হালদার ততদিনে লাপাত্তা হয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর আসে।