চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর এর সাথে একটা প্রোগ্রামে থাকার সুযোগ হয় কিছুদিন আগে। দুর্গাপুজোর সময় তিনি চট্টগ্রাম রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমে এসেছিলেন পুজোকালীন সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং ভক্তমন্ডলীদের পুজোর শুভেচ্ছা জানানোর জন্য। পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসাবে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক থাকায় উনার সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছা বক্তব্যটি মনোযোগ সহকারে শুনেছিলাম। ঐদিন তাঁর বক্তব্যটি শুধু ভক্তমন্ডলীদের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা জানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলনা। শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি তিনি উপস্থিত ভক্ত ও দর্শনার্থীদের তাদের সন্তানদের পড়ালেখার পাশাপাশি নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে বলেন। সন্তানদের মাদকতার ভয়াবহতা থেকে যেমন দূরে রাখতে বলেছেন তেমনি যাতে কিশোর অপরাধের সাথে না জড়ায় সে বিষয়টিও নজরদারী করতে বলেছেন। তিনি জানালেন পিতামাতার সঠিক পরিচর্যা ও নজরদারী পেলে সন্তান বিপথে যেতে পারেনা। সত্যিই কিশোর অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে বিপথে যাওয়া সন্তান শুধু পিতামাতা না, সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্যও বোঝা। কমিশনার সাহেব তাঁর পেশাদারত্বের বাইরে গিয়ে সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই হয়তো কথাগুলো বলেছেন কারণ তাঁদের এধরনের কেসগুলো নিয়মিত ফেস করতে হয়।
কিশোর অপরাধ বিষয়টা কি প্রথমে সেদিকে আমরা একটু দৃষ্টিপাত করি। এটি খুব অল্প বয়সে অপরাধ করার মতো একটি কাজ। যেমন আঠারো বছরের কম বয়সী কিশোর, যিনি কোন অপরাধ করে রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন ভঙ্গ করে। কিশোররা সাধারণত আঠারোর আগে অনেকটা অপরিণত এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মতো ভাবেন না। অতএব তারা ভুল করে অপরাধ করেন যা পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। মারাত্মক ব্যাপারটি হলো, অনেকসময় কিশোররা নিজের চিন্তা ও কাজকে সঠিক বলে প্রাধান্য দেয়, পরিবার সমাজ কি ভাবলো সেটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে তাদের কাছে। ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিকূল পরিবেশে সামাজিক সংগঠন ও কার্যাবলীর সাথে তাল মেলাতে না পেরে তারা সমাজ বিরোধী কাজে অংশ নেয়। কিশোররা এরকম বিভিন্ন কারণে আইন ভঙ্গ করতে পারে এবং সমাজে এমন অনেকগুলি কারণ বিদ্যমান রয়েছে যা তাদের কিশোর অপরাধের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
আমাদের দেশে বর্তমানে আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ার অন্যতম কারণ। তথ্য-প্রযুক্তির কারণে শিশু-কিশোরদের নৈতিক স্খলন হচ্ছে বিশেষ করে শহুরে কিশোরদের। একজন কিশোর তার বাবা-মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে নৈতিক মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষা গ্রহণ করে। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে কোনও কিশোরের আচরণ গঠনে এবং তার ব্যক্তিত্বকে সুসজ্জিত করতে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে কিশোররা হিংস্র হয়ে ওঠে বা কিশোর অপরাধের চিহ্নগুলি কেবল তখনই দেখায় যখন তারা বাড়িতে অশান্তির মুখোমুখি হয়। বর্তমান করোনাকালীন স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় এ ব্যাপারটা আরও বেশি করে দৃশ্যমান। সম্পর্ক খারাপ হওয়ার মাধ্যমে ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলি কিশোরদের পথভ্রষ্ট ও হিংস্র হতে পরোক্ষ একটা সমর্থন দেয়। অন্যদিকে হালের কর্পোরেট যুগে বাবা-মা প্রায়শই প্রফেশনের কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাই তারা তাদের বাচ্চাদের সাথে মানসম্পন্ন সময় ব্যয় করতে সক্ষম হন না। এটি কিশোর-কিশোরীদের অন্যদের, বিশেষত তাদের সমবয়সীদের সাথে নিজেকে যখন তুলনা করে তখন একধরণের হীনমন্যতায় ভোগে। এর ফলে তারা পরিত্রাণের উপায় হিসেবে মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও রাজনৈতিকভাবে কিশোরদের ব্যবহার করার কারণেও তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। অনেকক্ষেত্রে আবার পারিবারিক অর্থাভাবও একটি কারণ হতে পারে। অল্পবয়স্ক বা অপ্রাপ্তবয়স্ক কেউ কেউ তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ভুলপথে পরিচালিত হয়ে অন্ধকার পথে পা বাড়ায়, যেমন এদের দিয়ে ড্রাগ ডিলিংস ও অস্ত্র কেনাবেচা করানো হয়। এরা মাঝে মাঝে ছিনতাই, চুরি করতেও শুরু করতে পারে।
এখন আমরা দেখি কিশোর অপরাধের প্রভাবটা কিরকম হতে পারে। বর্তমানে দেশের বাস্তবতায় কিশোর অপরাধের প্রভাবটা অত্যন্ত ভয়াবহ। এর প্রভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হয়। শিশু কিশোর দ্বারা রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, পকেটমারের মতো অপরাধ করে বেড়ায় যা জনগণের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায়, ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রের আইন লঙ্ঘিত হয়। আমাদের সমাজে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো ছাত্রী অপহরণ, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপের মতো অপরাধ। এসব কারণে স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে বা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। কিশোর অপরাধের কারণে সমাজে মাদকাসক্তি ও যৌনাচার বেড়ে চলেছে যা সমাজ জীবনে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। এ ছাড়া কিশোরদের দ্বারা পিতা-মাতা ও বয়োজ্যেষ্ঠদের অবাধ্যতা,অশোভন আচরণ, পারিবারিক জীবনে শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। সর্বোপরি কিশোরদের অর্থবহ জীবনকে ধ্বংস করে সমাজ তথা জাতিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
কিশোর অপরাধের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত গ্যাং কালচার। স্কুল-কলেজ এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তার কিংবা দ্বন্দ্ব মেটাতে শিশু-কিশোররা কয়েকজন মিলে গড়ে তুলে গ্যাং বাহিনী। গ্যাং কালচারের সদস্যরা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ খুলে নিয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে। অনেক সময় দেখা যায় স্কুল-কলেজে বা এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে ঝামেলা হলে এরা ওই গ্রুপের মাধ্যমে অন্য সদস্যদের জানিয়ে দেয়। এরপর স্কুল ছুটি হলে বা সুবিধামতো এরা একত্রিত হয়ে একজন আরেকজনের ওপর হামলা চালায়। ছোট ছোট গ্রুপ করে এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা আবার কোনো একজন বড় ভাইয়ের অধীনে থাকে। উনি হচ্ছেন গ্যাং লিডার। অপরাধ করার পরে বা বিপদে আপদে গ্যাং লিডাররা আশ্রয় দিয়ে থাকে। ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে এরকম বড়ভাই বা গ্যাং লিডারদের অনেকসময় মা বাবার চেয়েও উপরের আসনে স্থান দেয়। এরকম একজন গ্যাং লিডার সমপ্রতি পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে (৫ নভেম্বর, আজাদী)। সমপ্রতি দেখলাম এসব গ্যাং এর সদস্যরা নিত্যনতুন কৌশলে অপরাধ করে বেড়াচ্ছে।ভয়ের কারণ হলো চট্টগ্রাম শহরের ১৬ টি থানায় নাকি ৩০০ টি স্পটে ৫৩৫ জনের কিশোর গ্যাং কালচারে জড়িত।
এখন আমরা দেখি কিভাবে বোঝা যায় সন্তান কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত। বিশ্লষকদের মতে সন্তানের চলাফেরা, আচরণের দিকে লক্ষ্য রাখলেই বোঝা যাবে যে, সে আসলে কোন ধরনের গ্যাং বা মাদক গ্রহণের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কিনা। প্রথমদিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় হয়তো সন্তানটি সময়মতো বাসায় ফিরছে না, ঠিকমতো খাচ্ছে না বা ঘুমাচ্ছে না। হয়তো বাসায় ফিরে নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকছে এবং গভীর রীত পর্যন্ত জেগে থাকছে। অতিরিক্ত টাকা দাবি করছে এবং বাসায় বন্ধুদের নিয়ে বেশি আড্ডা দিচ্ছে ও কাপড়চোপড়ের ধরণ পাল্টে যাচ্ছে। হয়তো হাতে বা কানে নানা ধরনের অলংকার ব্যবহার শুরু করেছে। কথাবার্তা বা আচরণে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এসব লক্ষণ দেখা গেলেই সন্তানের ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দেন।
আমাদের সমাজকে সুন্দর ও গঠনমূলক করার ভবিষ্যৎ কান্ডারী কিন্তু বর্তমান শিশু কিশোররা। এদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করা বা করতে সাহায্য করা আমাদের সামাজিক দায়িত্ববোধের মধ্যে পড়ে। যে কিশোররা কোন সামাজিক বা নৈতিক প্রশিক্ষণ পায়নি তারা প্রায়শই কিশোর অপরাধের দিকে পরিচালিত হয়। আমাদের বাচ্চাদের নৈতিক ও নৈতিক মূল্যবোধ শেখানো পিতামাতা সহ পরিবারের প্রধানতম কর্তব্য। পিতামাতার উচিত সঠিক ও ভুল আচরণের মধ্যে পার্থক্য শিখানো। সামাজিক এবং নৈতিক মূল্যবোধের অভাব শিশুদেরকে অন্যের সাথে খারাপ যোগাযোগের দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং তাদেরকে কম আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে তারা স্বার্থপর ও অহঙ্কারী হয়ে উঠতে পারে। তারা শিখে না কীভাবে রাষ্ট্রের আইনকে সম্মান জানাতে হয়। জড়িয়ে পড়তে পারে কিশোর অপরাধের সাথে, হয়ে উঠতে পারে গ্যাং লিডার। আমরা নিজেদের তথা সমাজ ও দেশের স্বার্থে সন্তানদের সময় দিই এবং প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলায় ভূমিকা রাখি।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।