কিংবদন্তি সমাজমানস বাদশা মিয়া চৌধুরী স্মরণে

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ৫ আগস্ট, ২০২৩ at ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ

প্রতিটি জন্মের পিছনে প্রবল কাঠিন্যে লুকিয়ে আছে অসীম গন্তব্যের চৌহদ্দিবিহীন অন্তিম পদচারণা। জীবনের সাথে যে সেতুবন্ধন মানুষকে প্রাণিত করে; মননসৃজন ও কর্মময় ব্যঞ্জনায় সেটি শেষযাত্রা ‘মৃত্যু’র পরেই অনেক বেশি প্রজ্বলিত হয়। এই বিশ্বে খুব কম সংখ্যক কৃতী মানব জীবদ্দশায় সার্থকতার পরিপূর্ণ স্বীকৃতি পেয়েছেন। তেমনই একজন কিংবদন্তী সমাজমানস বাদশা মিয়া চৌধুরী। মাত্র ১৭১৮ বছর সময়কালে তিনি সর্বোচ্চ নিষ্ঠাপরিশ্রমপ্রজ্ঞাদক্ষতাসততা ও দেশপ্রেমের অপূর্ব সম্মিলনে নিজেকে এক স্বতন্ত্র মানসপটে চিত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অসাধারণ গুণের সমীকরণে একজন সফলসার্থক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি ছিলেন সর্বত্রই সমাদৃত। দৃশ্যমান কর্মযজ্ঞের প্রতিস্থাপনে তিনি পরিণত হয়েছিলেন এক অনুকরণীয় প্রতিষ্ঠানে। অনুপম অনুপ্রেরণা ও তেজোদীপ্ত মহিমায় আত্মপ্রত্যয়ীআত্মসংযমীআত্মত্যাগী জনাব বাদশা মিয়া চৌধুরী ছিলেন সর্ব মহলে সর্বাধিক প্রিয় জীবনচরিত। সুশীল ও সাধারণসহ সর্বস্তরের মানুষের হৃদয় জয় করার মোহনীয় শক্তিময়তায় পরিপূর্ণ ছিলেন মরহুম বাদশা মিয়া চৌধুরী। স্বকীয় সত্তার নিগূঢ় অবগাহনে মননসৃজনশীল, অপরূপ সৌন্দর্যের দৃষ্টিহৃদয়নন্দন শৈলীতে সৃষ্ট তাঁর কর্মযজ্ঞ সময়ের আবর্তনে জীবনইতিহাসের ঐতিহ্যিক অধ্যায়ে প্রতিফলিত।

প্রয়াত বাদশা মিয়া চৌধুরী মনুষ্যত্বমানবিকতা বিকাশে, পরার্থে মাঙ্গলিক ব্যক্তিমানস সৃজনে প্রায়োগিক জ্ঞানের প্রসারমান সার্থকতায় নিরন্তর কৃতি মানবের স্বরূপ উম্মোচন করেছেন। চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তারপ্রসারে তাঁর নিরলস পরিশ্রম ও প্রায়োগিক কর্মকৌশল অগ্রগণ্য ভূমিকা হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ। প্রণিধানযোগ্য পরিবেশের নির্মম বাস্তবতায় বারবার কঠিন সঙ্কটের মুখোমুখী দাঁড়িয়েও আদর্শ থেকে ন্যূনতম বিচ্যুত না হয়ে সকল ক্ষেত্রে সৎসত্যবাদীতা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার পরিচয়পরিধি সমৃদ্ধ করেছেন। সমাজমানব হিতৈষী বাদশাহ মিয়া চৌধুরীর শিক্ষাসমাজসেবামানব কল্যাণের বহু ক্ষেত্রে অবাধ বিচরণ পরিলক্ষিত। নিজের মেধা ও চিন্তাশক্তির অপূর্ব সমাহারে চট্টগ্রাম আইন কলেজ, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ (তৎকালীন চট্টগ্রাম নাইট কলেজ), চট্টগ্রাম গার্লস কলেজ (বর্তমানে চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ), মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি হাই স্কুল, এমইএস কলেজ (বর্তমান ওমর গনি এমইএস কলেজ), কাজেম আলী নাইট স্কুল, মাদার্শা হাই স্কুল (হাটহাজারী), চাঁদপুর কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে নিজেকে সম্পৃক্ত করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় চির স্মরণীয় হয়ে আছেন।

জনাব বাদশাহ মিয়া চৌধুরী ১৯১৫ সালের ২০ অক্টোবর চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার অন্তর্গত উত্তর মাদার্শা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মনু মিয়া চৌধুরী এবং মাতার নাম মমতাজ বেগম। পিতা মনু মিয়া চৌধুরী এককালে বিত্তশালী ও প্রচুর জমিজমার মালিক ছিলেন। গ্রামের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। বাদশা মিয়া চৌধুরীর জন্মের সময় তাঁর পিতা মহাজনদের সুদিচক্রের কবলে পড়ে সমস্ত ধনসম্পদ হারিয়ে নিঃশেষ হয়ে যান। নিঃস্ব হয়েও শত কষ্টের মধ্যে তিনি সন্তানকে লেখাপড়া করাতে পিছুপা হননি। বাদশা মিয়া চৌধুরী আই.এস.সি পাস করার পর নুরুন নাহার বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। নুরুন নাহার বেগম দু’টি সন্তান জন্ম দিয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করলে শিশু সন্তানদের লালন পালনের নিমিত্তে বাদশা মিয়া চৌধুরীকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে হয়েছিল। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম সকিনা খাতুন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দশ সন্তানের জনক।

শৈশবকালে নিজ ঘরেই জনাব বাদশা মিয়া চৌধুরীর লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। নিজেদের বাড়ির সম্মুখে অবস্থিত মসজিদ ও মক্তবই ছিল তাঁর প্রথম শিক্ষালয়। পরবর্তীতে নিজের বাড়ি থেকে দুই মাইল দূরে ফতেয়াবাদ স্কুলে তৃতীয় শেণিতে ভর্তি হন। পিতার আর্থিক অসচ্ছলতা, /৩ মাইল হেঁটে স্কুলে আসার কষ্ট ও বৈরী আবহাওয়া বিবেচনায় তিনি লজিং থেকে ফতেয়াবাদ স্কুলে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া চালিয়ে যান। তিনি ১৯৩০ বা ৩১ সালে চার বিষয়ে লেটারসহ মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অত্যন্ত মেধাবী বাদশা মিয়া চৌধুরী স্কুল জীবনের প্রতিটি স্তরে অসাধারণ যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে পেয়েছিলেন জেলা শিক্ষাবৃত্তি। নিজের আচারব্যবহার, চালচলন, মেধা, চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে তিনি বিদ্যালয়ে ছাত্রশিক্ষকের অপরিসীম স্নেহ ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন। ভদ্র, চরিত্রবান, শান্ত প্রকৃতির ছাত্র হওয়ায় তিনি ফতেয়াবাদ গ্রামের সকলের কাছেই ছিলেন সম্মানিত। ১৯৩৩ বা ৩৪ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে আই.এস.সি পাস করে মেধার স্বাক্ষর রাখেন। এরপর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য কোলকাতা রিপন কলেজ থেকে সুনামের সহিত বি.এ এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.কম পাস করেন। কোলকাতায় প্রত্যক্ষ সহচর্যে আসেন বিখ্যাত আইনবিদ ব্যারিস্টার সানা উল্লাহর। দারিদ্রের কাছে মাথা নত না করে তিনি এম.কম পাস করার পর আইন বিষয়ে এল. এল. বি ডিগ্রি অর্জন করেন।

ছাত্রাবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তিনি খেলাধুলা, শরীরচর্চায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। ঐ সময়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় ফুটবল, হাডুডু, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, ডাঙগুলিসহ প্রতিটি গ্রামীণ খেলায় তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। ৭ম শ্রেণি থেকেই তাঁর ফুটবল নৈপুণ্য স্কুলের ছাত্রশিক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষিত হতে থাকে। চট্টগ্রাম কলেজের নিয়মিত ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন বাদশাহ মিয়া চৌধুরী। ১৯৩০ সালের অস্ত্রাগার দখলের প্রস্তুতি হিসেবে হিন্দুমুসলমান মহল্লায় জিমনেস্টিক ক্লাব গঠিত হলে অতি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। খেলাধুলার পাশাপাশি কুস্তির প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল অত্যধিক। তৎকালীন সময়ে গ্রামে ও শহরে কুস্তি খেলা প্রচন্ড জনপ্রিয় ছিলো এবং গ্রামেগঞ্জে মেলাতেও কুস্তির আসর বসতো। একেবারে শিশু বয়স থেকেই বাদশা মিয়া চৌধুরী কুস্তিতে পারদর্শী হয়ে উঠেন। জনশ্রুতি মতে, চট্টগ্রাম কলেজে পড়া অবস্থায় তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বালীখেলায়ও কুস্তিতে অংশগ্রহণ করে পুরষ্কার অর্জন করেছিলেন।

শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ও কর্মজীবনে প্রবেশ করে তিনি বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতায় পরিপুষ্ট হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের পর জনাব বাদশা মিয়া চৌধুরী জীবিকার সন্ধানে প্রথম জীবনে সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন। পাকিস্তান সরকারের কর বিভাগে প্রথম স্পেশাল অফিসার পদে যোগদানের পর কর্তৃপক্ষ তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ইনকাম টেক্স অফিসার পদে উন্নীত করে। সরকারের রাজস্ব বাড়ানো নিয়ে এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাকর্মচারিদের দ্বন্দ্বে চরম প্রতিকূল পরিবেশে শতভাগ সততার সাথে তিনি কর বিভাগে চাকরি করে গেছেন। বিভিন্ন সময় কর্তৃপক্ষ বাদশা মিয়া চৌধুরীকে চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর, বরিশাল, দিনাজপুর, কুমিল্লায় বদলি করে। বৈচিত্র্যপূর্ণ এই কর্মসংস্থানের সাথে যুক্ত হয়েও নীতিনৈতিকতার সাথে সৎ জীবন যাপনের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে তিনি ছিলেন পারঙ্গম ব্যক্তিত্ব। কর্মক্ষেত্রে মানসিক সন্তুষ্টি না পাওয়ায় একপর্যায়ে কর বিভাগের সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন আইন ব্যবসায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। কর বিভাগের চাকরির অভিজ্ঞতার আলোকে চট্টগ্রামের করদাতা ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের আয়কর উপদেষ্টা হিসেবে অত্যন্ত সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

স্বাধীন পেশায় থেকে তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে নিজেকে জড়িত করেছিলেন। তিনি মাদার্শা উচ্চ বিদ্যালয়ের আজীবন সভাপতিও ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম সরকারি খাস্তগীর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, অপর্ণা চরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, জে এম সেন উচ্চ বিদ্যালয়, কাজেম আলী বিদ্যালয়ের সরকার মনোনীত গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন। গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের সুবিধার্থে কাজেম আলী স্কুলে নাইট শিফট চালুর প্রবক্তাও ছিলেন বাদশা মিয়া চৌধুরী।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমবায় আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন বাদশা মিয়া চৌধুরী। তিনি চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমবায় সমিতির সভাপতি এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কোঅপারেটিভ সোসাইটির প্রবীণ সদস্য ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্কাউট কমিশনার ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে দেশে বিদেশে স্কাউট জাম্বুরীতে তিনি যোগ দেন। স্কাউট আন্দোলনে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কেন্দ্রীয় স্কাউট কমিটির পক্ষ থেকে তাঁকে সার্টিফিকেট অব মেরিট প্রদান করা হয়।

মাটি ও মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, অসাম্প্রদায়িক মানবিক ও দেশপ্রেমিক জনাব বাদশা মিয়া চৌধুরীর জীবনের আড়ালে বহু ঘটনা এখনোও অনাবিষ্কৃত। ক্ষণজন্মা এই ব্যক্তিত্বের জীবন ও সমাজ দর্শন তরুণ প্রজন্মকে নতুন পথের সন্ধান দিবেএটিই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বিশুদ্ধ চট্টলমানস বাদশা মিয়া চৌধুরী ১৯৬৭ সালের ৫ আগস্ট মাত্র ৫২ বছর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে অন্তিমযাত্রার সারথি হয়েছেন। তাঁর সৃজনমননশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে জনাব বাদশা মিয়া চৌধুরী আজো সরবে বেঁচে আছেন এবং থাকবেন যুগের পর যুগ। আজকের দিনে এই কৃতীমানবের পূতপবিত্র স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রচিন্তা
পরবর্তী নিবন্ধসড়ক দুর্ঘটনায় পা হারানো ব্যক্তির পাশে বিবেকানন্দ শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরিষদ