তিন বাঙালি মা বাবার অভিজ্ঞতায় রচিত ‘তিন ভুবনের শিক্ষা’ বইটি পড়ে জাপান আর নেদারল্যান্ডস- এর শিশুদের শৈশব, কৈশোর এবং শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জেনে যেরকম স্বর্গীয় অনুভূতি হলো, পাশাপাশি বাংলাদেশের শিশুদের শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক স্তরের বর্ণনাটুকুতে এসে মনে হলো আমার স্বর্গচ্যুতি হয়েছে। স্বর্গ থেকে সরাসরি হাবিয়া দোযখে এসে পড়েছি।
জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন তানজীনা ইয়াসমিন, নেদারল্যান্ডস এর শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন তানবীরা তালুকদার এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন রাখাল রাহা।
জাপান কিংবা নেদারল্যান্ডস-এর শিশুদের শৈশবকালের সিকিভাগও যদি আমাদের শিশুদের মিলতো! না ঘরে, না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, না সমাজে, কোথাও আমাদের শিশুদের জন্য তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। তাদেরকে আমরা মুখে-মুখে জাতির ভবিষ্যৎ বলি, সেই ভবিষ্যতের জন্য আমাদের বর্তমানের কোনো আয়োজন নেই। আমরা চারাগাছের পর্যাপ্ত যত্ন ছাড়াই বিশাল মহীরুহ আশা করি এবং সেই মহীরুহ থেকে যাবতীয় সুফলের জন্য লালায়িত হয়ে থাকি। কেমন নির্বোধ হতে পারি আমরা!
লেখক তানজীনা ইয়াসমিন জানিয়েছেন, জাপানের সব এলাকার সব স্কুলের শিক্ষার মান একই। বাচ্চাকে নিজ ওয়ার্ডের ভেতর বাসা থেকে ২০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বের স্কুলে পড়তে পাঠায়। আর ২০ মিনিটের এই হাঁটা পথ বাচ্চারা একা একাই হেঁটে স্কুলে যাবে। চাইলে অবশ্য দলবেঁধে বন্ধুরা একসাথে যেতে পারে। তবে কোনোভাবেই গাড়িতে যাওয়া যাবে না। অভিভাবকরাও যেতে পারবে না।
এমন একটা পরিস্থিতি চিন্তা করতে পারি আমরা আমাদের দেশে! প্রথমত অলিগলির স্কুলগুলোর কোনো মানই নেই। যারা অন্য কোথাও কোনো চাকরি-বাকরি করতে পারছে না তারাই নিদেনপক্ষে এসে অলিগলির কেজি স্কুলগুলোর শিক্ষক হয়! প্রাইমারি স্কুলগুলোতে অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে সেখানেও বাচ্চাকে দিতে মন সায় দেয় না। বাচ্চারাও স্কুলের পরিবেশ দেখে চোখ কপালে তুলে ফেলার যোগাড়! চট্টগ্রামের একটা ভালো স্কুলে (ভালো স্কুলের মানদণ্ড বলতে পড়ালেখার যে মানদণ্ড তা আমাদের পুরা দেশটাতেই ঘাটতি, তবু যেগুলো নাম করা স্কুল, মানে নামের উপর দিয়েই চলে, সেরকম স্কুলগুলোর কথাই বলছি) বাচ্চাকে ভর্তি করানোর জন্য নভেম্বর মাস থেকে ভর্তি ফরম বিক্রি হয়। সেই ভর্তি ফরম কেনার জন্য ভোর থেকে লম্বা লাইন ধরতে হয়, তারপর পরীক্ষা, লটারি, হাবিজাবি আরও কতকি! বাচ্চা কি ক্লান্ত হবে আমি অভিভাবকই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আর বাচ্চাকে একা একা রাস্তায় ছেড়ে দেয়া! কী ভয়ংকর কথা! এর মধ্যেই বেড়ে উঠছে আমাদের শিশুরা।
অরিগামী বা কাগজের তৈরি বিভিন্ন খেলনা বানিয়ে ঘর সাজানো, খেলায়-খেলায় বর্ণমালা সাজানো, ট্রাফিক সিগনাল চেনানো, ট্রাফিক আইন মেনে চলা, নিজের কাজ নিজে করা, অন্যদের সম্মান দিয়ে কথা বলা, পরীক্ষাবিহীন পড়ালেখা, আনন্দপাঠ, বয়োঃসন্ধিকালের স্পষ্ট ধারণা দেয়ার কৌশল, প্রয়াস সব কিছুই শিক্ষনীয় আমাদের। আমরা শিখছি কি!
নেদারল্যান্ডস-এর শিক্ষাব্যবস্থাও যথারীতি শিশুদের জন্য আশীর্বাদ। তাই তো বলা হয়ে থাকে নেদারল্যান্ডস- এর শিশুরা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী শিশু। ডাচ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বলে কিছু নেই। তাদের মূল্যায়ন – ভালো, যথেষ্ট, যথেষ্ট নয়। ডাচ শিশুদের প্রাইমারি লেভেলে বাড়িতে কোনো বই খাতা থাকে না। স্কুলেই পড়ালেখা করে সব স্কুলেই জমা দিয়ে আসে। বিষয়টা ভাবতেই কেমন যেন লাগছে! কারণ চোখের সামনে নিজের সন্তানের ব্যাগ ভর্তি বই এবং বইয়ের ভারে ছোট্ট একটা মানুষের কাবু হয়ে যাওয়া মুখখানি কেমন অসহায় করে তোলে!
তানবীরা তালুকদার লিখেছেন, ‘ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত এখানে বাচ্চাদের মুখস্থ করার বা পড়ার জন্য কোনো বাঁধানো বই নেই। সবটাই হাতেকলমে, খেলায়, ছবিতে, গানে বা সিনেমার মাধ্যমে শেখানো হয়।’
এই অংশটুকু পড়ে নিজের কন্যার স্কুল ভীতির কথা মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ভাবি,আমাদের সন্তানের শৈশব রাঙাতে না পারার ব্যর্থতার দায় আমাদেরও কম নয়।
জাপানি বাচ্চারা সবাই সাইকেল চালায়, ডাচ বাচ্চারা সাইকেল চালায়। আমাদের বাচ্চারা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছে এই চিত্রটা কল্পনা করতেই আঁতকে উঠি আমি। যেই রাস্তাঘাট আমাদের! তারা ক্যাম্পে যায়, ছোটবেলা থেকে নিজের কাজ নিজে করতে শেখে, স্বাবলম্বী হতে শেখে, সৃজনশীলতার মধ্যে বেড়ে ওঠে, অভিভাবকদের কোনো চাপ নেই, হতাশ হওয়ার সুযোগ নেই, শিক্ষকদের কোনো চাপ নেই, চালাকি নেই, অসম প্রতিযোগিতার আয়োজন নেই, বই পড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা ব্যবস্থাপনার কোনো উল্লেখযোগ্য ত্রুটি বের করতে পারলাম না। শুধু মনে হচ্ছিল এসব দেশে তো প্রজন্মের পর প্রজন্ম শান্তিতে থাকবেই। কারণ শান্তির বীজ তো তারা শিশুকালেই বপন করে দিয়েছে।
জাপান, নেদারল্যান্ডস- এর শিক্ষা ব্যবস্থা পড়ে যখন রাখাল রাহার বয়ানে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পড়লাম তখন আগুনের উত্তাপ ঘরে বসে আবার অনুভব করলাম। কারণ এসব চিত্র তো আমাদের দেখাই। কিন্তু রাখাল রাহার মতো সচেতন অভিভাবকও তো আমরা হতে পারিনি। কন্যার স্কুলের পড়ার কৌশল, অপ্রয়োজনীয় বইয়ের বোঝা কমানোর জন্য থানা হাজত, নাজেহালের যে চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন তাতে হতাশা ছাড়া আলোর কোনো বিচ্ছুরণ আমি দেখতে পাই নি। এই হতাশায় একজন অভিভাবক হিসেবে আমার দায়টুকু আমি অস্বীকার করতে পারিনি। আমরাও যদি সবাই রাখাল রাহার মতো বলতে পারতাম তাহলে হয়তো, ধীরে ধীরে হলেও কিছুটা লক্ষনীয় পরিবর্তন আসতো। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার অব্যবস্থাপনা লাঘব হতো, কম বেতনের অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পরিহার হতো, আমরা আমাদের শিক্ষকদের যেভাবে অবমূল্যায়ন করছি, তার জন্য হয়তো আরও অনেক অন্ধকার আমাদের দেখতে হবে।
লেখক রাখাল রাহার লেখা একটি অংশ, ‘যদি বলি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ওরা বলবে, ইউরোপ -আমেরিকাতেও এখন শিক্ষার মান নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। যদি বলি, আমাদের শিক্ষকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন না, ওরা বলবে যা বেতন, তাতে এরচেয়ে বেশি আর কি করবে? যদি বলি, আমাদের শিক্ষকদের চেয়ে প্রতিবেশী দেশের শিক্ষকরা অনেক বেশি বেতন পায়। ওরা বলবে তাতে কি হয়েছে? তাদের শিক্ষা কি ইউরোপ-আমেরিকার মতো হয়ে গেছে?’
কি বোঝা যায়? ঘোর কলিকালে আছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। এর থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস দরকার আমাদের স্বার্থেই।
চমৎকার বাস্তব চিত্র তুলে ধরার জন্য বইয়ের তিন লেখককেই জানাই আরিগাতোউ ( জাপানি ভাষায় ধন্যবাদ)।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্টগণ এই বইটি যদি পড়তেন! যদি ঢেলে সাজাতেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে! বিশেষ করে প্রাইমারি শিক্ষাটা। আমাদের শিক্ষক এবং অভিভাবকগণের জন্যও প্রয়োজনীয় একটি বই। ভালো একটি বই।
প্রকাশক- শিক্ষা ও শিশুরক্ষা আন্দোলন (শিশির),
প্রকাশকাল- ফেব্রুয়ারি,২০১৯।
প্রচ্ছদ – সব্যসাচী মিস্ত্রী।