কর্মই জীবন, কর্মই ধর্ম। কাজ ভালোবেসে করা হলে, প্রশান্তি আসে। যে–কোনো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা এক প্রকার ছুতো, ভালো থাকার। কিন্তু কর্মজীবী শব্দের সাথে সরাসরি কর্মেই জীবন অনুধাবিত হয় কিনা, সংশয় বটে। আমাদের শেখা ভাষ্য মতে কর্মের মাধ্যমে জীবিকা বোধহয় বেশি প্রচলিত। জীবন ধারণকারী প্রত্যেকে তাই ছুটে চলে। কিন্তু বিভেদ বা প্রতিযোগিতা খুবই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা। কথা না বাড়িয়ে ফলত সরাসরি বলছি, কর্মজীবী নারীর গল্প। কর্মজীবী নারী ও পুরুষের মাঝে বৈষ্যমের গল্প। অথবা একজন মায়ের কর্মজীবী মা হয়ে যাপনের গল্প।
বর্তমানে এ ধরনের বিষয়বস্তু ক্লিশে মনে হলেও, সমান যৌক্তিকতা আছে বলে লেখার চলমান বহিঃপ্রকাশ। একজন নারী সামাজিক কারণে মেয়ে, বোন এবং নিঃসন্দেহে স্ত্রী ও মা হয়ে ওঠেন। তবে যখনই তিনি কর্মজীবী স্ত্রীর চেয়েও কর্মজীবী মা হয়ে উঠেন, বিপত্তি হয় সেখানেই।
প্রথমত আমাদের কর্মজীবী নারীরা যদি বিবাহিতা হন, তবে একত্রে ঘর সামলিয়ে অফিসে যান। অন্তরালে প্রচণ্ড দায়িত্ব পালনের দায় থাকে। হ্যাঁ, পুরুষেরা এক্ষেত্রে এগিয়ে। সকালের তৈরি জলখাবার এবং সমস্ত দায়ভার খানিকটা এড়ানো যায়। সে যে ঘরে দশ হাত সম্পন্ন দেবী এনেছেন। একই সাথে তাই ঘর ও চাকরি দুটোই সামলে নিচ্ছেন। ভালো বেতনের পুরুষেরা আরো চড়া সুর তুলেন। যারা ব্যতিক্রম তাদের নিশ্চয় শুনতে হয়, বেডি মানুষের মত চুরি পরে ঘরে বসে থাকলেই পারো।
একটু মনে করিয়ে দিই, বেডি মানুষের ঠিক বসে থাকবার সুযোগ কই? পুরুষের মত বাইরে যে বিবাহিতারা যান না, তারা গুরুদায়িত্ব পালন করেন। অনেকে এটাকে সাহায্য বলে, ভেবে দেখুন তো যদি ভালো নারী হবার পূর্ণ বাসনা আপনার না থাকতো তাহলে অবশ্যই আপনি অর্থের জোগানে ছুটতেন, কেননা এতটা দিন খেটে বছর ফি কিছু স্নো–পাউডার, কাপড়, হাত খরচ কিংবা বাড়ির লোককে দুবেলা ডেকে এনে খাওয়াতে আপনারও পোষাত না। এসব আসলেই পুরনো আলাপ।
এখন সন্তান নিয়ে নারীরা এভারেস্টে যাচ্ছেন, ঘর সামলে নিচ্ছেন, অফিস করছেন। ‘আমি নারী, আমিই পারি’ এ স্লোগানে নারীরা উজ্জীবিত বলা যায়। কিন্তু প্রশ্নটা হলো আপনাকে সব পারতে হবে কেন? এক হাতে সামলাতে বা হবেই কেন? বেশি প্রশ্ন হয়ে যাচ্ছে। মূল প্রসঙ্গতে ফিরে আসা যাক।
একজন শিশুকে কেবল জন্ম দিয়ে যদি দায় এড়ানো যেতো বোধ করি, তবেও শিশুর জন্মদান অপ্রয়োজনীয়। শিশুর জন্মের সাথে সবচেয়ে বেশি জড়িত নারী, সত্য। পুরুষেরা তাহলে বাবা হিসেবে দায়িত্ব বেছে নেন অর্থের জোগান আর বাদবাকি তথাকথিত কিছু বিষয়। আর কর্মজীবী মা মাত্রই প্রশ্ন ও কথার শিকার। ভেবেছেন কি, একজন কর্মজীবী মা কতটা মা হয়ে উঠতে পারছেন? কিংবা আপনাদের মাপকাঠিতে পারছেন না কেন?
কর্মজীবী মায়ের কাজের ফিরিস্তি বড্ড বড়। ঘর সামলিয়ে, অফিস সামলিয়ে ঠিকঠাক সন্তানকে সুস্থ সময় দিতে অসুবিধে হবে যা স্বাভাবিক। তবে সন্তান একটু বিগড়ে গেলে, শরীরে অসুখ হলে, পড়াশোনায় ভালো না হলে দ্রুতই আমরা চেপে বসি সেই কর্মজীবী মাকে। যিনি চেষ্টা করছেন হয়তো কিন্তু আর পেরে উঠছেন না। এরপর সন্তানই যদি একদিন বলে বসে, তুমি তো খারাপ মা, আমাদেরকে সময় দাও না। দোষ কি সন্তান কিংবা আপনার সহযাত্রীর যার দায়িত্ব বর্তায় হাত লাগানোর, সন্তানের অর্ধেক দায়িত্ব নেওয়ার? না, দোষটা আপনারই। নারী থেকে মা অব্দি সমস্ত পথে আপনি ‘আমি নারী,আমিই পারি’ হতে চেয়েছিলেন। যার কিনা একা হাতে বাড়ি, অফিস, সন্তান সব সামলাতে হবে। হ্যাঁ, পুরুষতন্ত্রের কারণেই আপনার আজ এ–দশা কিন্তু এখন আর সময় নেই কারো উপর দোষ চাপানোর।
কর্মজীবী মায়ের অবহেলায় সন্তান যদি এতই নষ্ট হয়, তবে বাবারা কেন সন্তানকে দেখছেন না। বাবারা কি তাদের সন্তানকে কম ভালোবাসে? নাকি পুরুষতন্ত্রের পুরুষত্ব আর ভালো বাবা হতে দিচ্ছে না তাকে। আদতে কর্মজীবী মায়েরাই ভালো মা নন। ভালো মায়েরা সন্তানকে সমতার গল্প বলে। মানুষ হয়ে উঠতে শিক্ষা দেয়, চোখের সামনে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখায়।
কর্মজীবী নারী নিশ্চয় জেনে বুঝে স্বাবলম্বী হতে চেয়েছেন। কিন্তু অপাত্রে দান নয়, দুধ দিয়ে কাল সাপ পোষার মত বিষয়টা। যে সন্তানের ভবিষ্যত আর একটু সম্মানে বাঁচতে কর্মজীবী মা হয়েছেন, তার সমস্ত অর্থ দিয়ে কেবল নিজের ক্ষতি ছাড়া কিছুই হয় না। যদি সন্তানকে ন্যায়বোধের জায়গা থেকে উতরাতে না পারেন তবে এত ত্যাগেও জয় মিলবে না। শুনতে হবে, কে বলেছিলো চাকরি করতে?
তবে কি বসে পড়বেন চাকরি ছেড়ে! ভেবে দেখুন তো যেসব নারীরা কর্মজীবী নন, ঘরোয়া একজন নারী, একজন মা। তিনিও কি বেলাশেষে একজন সম্পূর্ণা হতে পেরেছেন? পান থেকে চুন ফসতে হই হুল্লোড়, অল্পতে সন্তানদের দ্বারা অবহেলা, ভয়ে থাকতে হয় ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ ভেবে।
তাহলে এত কর্ম কেন, এত সঙ কার জন্যে। আপনি নারী, রোবট নন যে সব পারতেই হবে। যতটুকু পারছেন সেটিই নিন। ভেবে সিদ্ধান্ত দিন। প্রয়োজনে কাজ ভাগ করে দিন পরিবারের সব সদস্যদের মাঝে। সন্তানকে গড়ে তুলুন মানুষ হিসেবে, যে অন্তত আশা করবে না, আমার মা–ই তো সব করবে, কাপড় ধুয়ে দেবে, মুখে তুলে খাইয়েও দেবে, সকালে ব্যাগ গুছিয়ে দেবে আরো কত কি! বরং নিজের থেকে প্রতিযোগিতামূলক ভাবনা আগে বাদ দিন। বাদবাকি একজন কর্মজীবী নারীর জন্যে কতটা মা নয়, কেমন মা হওয়া উচিত তা নিয়ে ভাবুন।