কর্মজীবী নারীর অধিকার : প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

পাহাড়ী ভট্টাচার্য | শুক্রবার , ৮ মার্চ, ২০২৪ at ৯:৪৩ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশের কর্মজীবী তথা শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নারী। নারী অধিকার তথা কর্মজীবী নারীর প্রাপ্যবিষয়ক আলোচনায় অবধারিতভাবে এসে পড়ে পৃথিবীর ইতিহাসের অমোঘ কিছু ঐতিহাসিক দিন ও মুহূর্তের কথা যার মধ্যে আন্তর্জাতিক নারী দিবস, মহান মে দিবস, ফরাসী বিপ্লবের কথা সবিশেষ স্মর্তব্য। নারী অধিকারসংশ্লিষ্ট বিশেষ দিনটি হল ৮ র্মাচ। ১৮৫৭ সালের এ দিনে শ্রমক্ষেত্রে নারীপুরুষ শ্রমিকদের কাজের সময় কমিয়ে দৈনিক ১২ ঘণ্টা করা, কর্মক্ষেত্রে মানবিক ও তুলনামূলক উন্নত কর্মপরিবেশ সৃষ্টি, নারী শ্রমিকের ওপর সহিংসতারোধ এবং মজুরিবৈষম্যসহ নারীর প্রতি সকল প্রকারের বঞ্চনাবৈষম্যের অবসান ও শ্রমজীবী মানুষদের ওপর মালিকনিয়োগকর্তাব্যবসহাপনা কর্তৃপক্ষের বিবিধ অন্যায়নির্যাতনহয়রানি প্রতিরোধের দাবীতে আমেরিকার নিউইয়র্কে সূতাকলের নারী শ্রমিকেরা সর্বপ্রথম রাজপথে নামে। নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের এ আন্দোলন বিশ্বব্যাপী শাসকগোষ্ঠীর ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়ে। উল্লেখ্য, কালপরিক্রমায় আন্দোলনের গতি কিছুটা কমলেও তা একেবারে স্তিমিত হয়নি। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ সালে নিউইয়র্ক শহরে তৎকালীন বিশিষ্ট নারীনেত্রী ক্লারা জেটকিন ও তাঁর সহযোগীদের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে আয়োজিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। এ সম্মেলনে, ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চকে স্মরণ করে নারী জাগরণের অন্যতম দিন হিসাবে ঘোষণা দিয়ে, দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে উদ্‌যাপনের ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯১১ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৮ মার্চ নারীর সমঅধিকার দিবস হিসাবে পালিত হতে থাকে। ১৯১৪ সাল হতে এই কর্মসূচির বিস্তৃতি ঘটতে থাকে এবং ১৯৮৪ সালে এসে দিবসটি জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভ করে।

২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হল “ইনস্পাইয়ার ইনক্লুশন”, বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর তথা মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রচারিত ভাষ্যমতে – “নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ”। আমাদের দেশের নারীদের তথা নারী শ্রমিকদের শোষণ, নির্যাতন, হয়রানি, সহিংসতা ও বৈষম্য থেকে মুক্ত করা, তার জন্য প্রযোজ্য আইনস্বীকৃত সকল অধিকার সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধানই হল মূলত আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

স্বাধীনতার ৫ দশক পর বাংলাদেশের সমাজকাঠামোয় নারীরা সামগ্রীকভাবে কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছেতা খতিয়ে দেখা দরকার। আমাদের দেশের মোট জনশক্তির প্রায় অর্ধেক নারী। আমাদের দেশের প্রতিটি পরিবারেই নারীদের ভুমিকা ও অবদান প্রশ্নাতীত। নারী শ্রমিকদের সিংহভাগ কৃষি কাজের সাথে যুক্ত থেকে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। নারী শ্রমিক নির্ভর পোশাক শিল্প খাত দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও নারীর অবদান সর্বজনস্বীকৃত। প্রবাসে থেকে শ্রমঘামে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করছে অসংখ্য নারী শ্রমিক। জিডিপির একটি বড় উৎস আসছে দেশেবিদেশে নারীর শ্রম ও আয় থেকে। নারীদের এ অর্জন সহজ পথে আসেনি। শত অবজ্ঞা ও হাজারো প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেই নারীরা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৭.৭ শতাংশ এবং পুরুষের ৮০.৬ শতাংশ। আমাদের বিদ্যমান সমাজবাস্তবতায় সার্বিকভাবে শিক্ষা ও কর্মে নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কিছুটা বাড়লেও নারীর মৌলিক মানবিক মর্যাদার স্বীকৃতি, স্বাধীনতা, সমতা ও ন্যায্যতাপ্রাপ্তির সুযোগ সমভাবে বাড়েনি। নারীকে বিবিধ পন্থায় অবদমন, প্রতিনিয়ত তার ওপর নানামাত্রিক বিধিনিষেধের ঘেরাটোপ আরোপ, সহিংসতা, শারিরীকমানসিক নির্যাতননিপীড়ন কমবেশী সমাজে অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের সংবিধানে, শ্রম আইনে, জাতীয়আন্তর্জাতিক নানা কনভেনশনে, ঘোষণায় কর্মজীবী তথা শ্রমজীবী নারীর জন্য প্রযোজ্য অনেক অধিকার ও প্রাপ্যর বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে সেসব অধিকার ও প্রাপ্য হতে তাদের প্রতিনিয়ত নানাভাবে বঞ্চিত করার হীন অপপ্রয়াস দৃশ্যমান।

প্রথমত, জীবিকার প্রয়োজনে একজন দক্ষ অথবা অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে স্বেচ্ছায়, পছন্দানুযায়ী যে কোন কর্মে নিযুক্ত হবার সহজাত সুযোগ, সম কাজে সম মজুরি, কর্মক্ষেত্রে মানবিক আচরণ ও মর্যাদা প্রাপ্তির সুযোগ, জীবন ধারণের উপযুক্ত মজুরিওভারটাইমবোনাসগ্রাচ্যুয়িটিপেনশনবীমাসুরক্ষা সুবিধা, আর্থিক ও অপরাপর কল্যাণসুবিধাদি, প্রাতিষ্ঠানিক নিজস্ব চাকুরি বিধি ও নীতিমালার আওতায় সামাজিক সুরক্ষা প্রাপ্তির সুযোগ, ছুটি, পেশাগত স্বাসহ্য সুরক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে রোগব্যাধিঅসুসহতা ও দুর্ঘটনামুক্ত থাকার নিশ্চয়তা, কর্মক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্ঘটনায় যথাযথ চিকিৎসা ও আইনানুগ ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ছাড়াও কর্মজীবী নারী গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের আগেপরে মাতৃত্বকালীন মোট ১৬ সপ্তাহের সবেতন ছুটিপ্রাপ্তির অধিকারসহ দেশের শ্রম আইনস্বীকৃত অপরাপর নানা অধিকার ও সুবিধাদি প্রাপ্তির কথা প্রাতিষ্ঠানিকঅপ্রাতিষ্ঠানিক সকল খাতের কর্মজীবী নারীদের রয়েছে।

শ্রমজীবী নারীর জন্য প্রযোজ্য উপরোক্ত আইনী সুবিধাদির নিশ্চয়তা বিধান সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর, মালিক ও নিয়োগকর্তা তথা ব্যবসহাপনা কর্তৃপক্ষের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এছাড়া শ্রমজীবী জনগোষ্টী ও শ্রমক্ষেত্র নিয়ে কাজ করে এমন জাতীয়আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংসহা বিশেষত ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিক সংগঠন নেতৃত্ব, আইএলও এবং শ্রমসেক্টরসংশ্লিষ্ট অংশীজনদের ভূমিকা এবং দায়বদ্ধতাও এ ক্ষেত্রে স্মর্তব্য।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র ১৯৮৪ সালে নারীর ওপর সকল ধরণের বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক দলিল সিডো সনদে ও ২০০০ সালে এতদসংশ্লিষ্ট অপশনাল প্রোটোকলে অনুস্বাক্ষর করলেও অদ্যাবধি নারীর ওপর সহিংসতা নিরসনসংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন১৯০ অনুস্বাক্ষর করেনি। ফলে নারী অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি দুরত্ব ও প্রতিবন্ধকতা রয়েই গেছে, যা দুরীভূত করা অত্যাবশ্যক।

নারীরা কর্মক্ষেত্রে অথবা পরিবারে নানাভাবে বৈষম্যনির্যাতনের স্বীকার যার চিত্র আমরা প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায়, প্রেসমিডিয়ায় দেখতে পাই। বিদেশপ্রত্যাগত নারী শ্রমিকের ওপর পরিচালিত নির্যাতনের ভয়াবহতার কথাও আমরা প্রায়শ: শুনি। যে নারী দেশেই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন, তার প্রতি সমাজরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে চরম অবমাননাকর সেখানে বিদেশপ্রত্যাগত নারীর সামাজিক অবস্থান আরো চরম হতাশাজনক। কোভিডকালীন সময়ে অনেক নারী শ্রমিক পৃথিবীর নানা দেশ হতে বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন। কোভিডএর কারনে অনেক নারী শ্রমিককে বকেয়া মজুরী ও অন্যান্য পাওনাদি প্রদান না করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এতে তারা চরমভাবে অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হয়েছে। কিছু কিছু নারী শ্রমিককে যৌন লালসার স্বীকারও হতে হয়েছে, দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হয়ে অনেকে অর্থনৈতিকভাবে চরম কষ্টে দিনযাপন করছেন। বর্তমান সরকার কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পুনর্বাসনে ঋণ সুবিধা প্রদান করার অঙ্গীকার করলেও সেই ঋণপ্রাপ্তির যে জটিলতা তথা ঋণগ্রহণের যে শর্তসমূহ তার মধ্যে সিংহভাগ শর্তই ঋণপ্রাপ্তির অন্তরায়। বিদেশ প্রত্যাগত নারী শ্রমিকেরা যখন কিছু করবে এই আশায় ঋণ নিতে যায় তখন সেখানে চাওয়া হয় উপযুক্ত গ্যারান্টার ও ট্রেড লাইন্সেসসহ অন্যান্য অনেক কাজপত্র। এ সকল জটিলতার কারণে তারা সহজে ঋণ নিতে পারে না। সহজে ঋণ পাওয়ার জন্য পলিসি লেভেলে কতিপয় শর্ত শিথিল অত্যাবশ্যক।

স্বাধীনভাবে কাজে নিযুক্ত হবার সুযোগ থেকে শুরু করে একজন কর্মজীবী নারীর সকল আইনস্বীকৃত অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এবং তার পুর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষও বটে। তবে এ নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে সংশ্লিষ্ট সকলকেই। আজ পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে কর্মজীবী নারীর অধিকার ও লৈঙ্গিক সমতার বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে আমাদের টেকসই আগামীও নিশ্চিত করা যাবেএই হোক আমাদের প্রত্যাশা ও প্রত্যয়।

লেখক: বেসরকারি শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান “বিল্‌স’এ কর্মরত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় নারীরা পালন করুক অগ্রণী ভূমিকা
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা