চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ জনপদ। এই উপজেলায় রয়েছে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকপ্রাপ্ত চার বরেণ্য। তাঁরা হলেন- কবি রমেশ শীল, বিনয়বাঁশী জলদাস, আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষ এবং সাহিত্যিক সুচরিত চৌধুরী।
এই অঞ্চলের বর্ধিষ্ণু একটি গ্রাম কধুরখীল। সমাজকে আলোকিত করার প্রত্যয়ে, পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে নারী শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে এলাকার কিছু শিক্ষানুরাগী এবং কীর্তিমান ব্যক্তিত্বগণ ১৯০৮ সালে স্বল্প পরিসরে এই কধুরখীল বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। সূচিত হয় নারী শিক্ষার ঐতিহাসিক এক অধ্যায়। ১৯১৯ সালে বিদ্যালয়টি মধ্য ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয় নামে এগিয়ে যেতে থাকে। পরবর্তীতে এলাকার মহীয়সী নারী সীতাসুন্দরী দেবীর নামে স্কুল নামাঙ্কিত হয়। বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত এবং বিবিধ প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১৯৬০ সালে বিদ্যালয়টি পরিচিতি লাভ করে কধুরখীল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদ্যালয়টি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু লক্ষ্যে যারা অটল, উদ্দেশ্য যাদের মহৎ, ব্রত যাদের ত্যাগ ও সেবার, সমাজকে সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত করায় তাঁরা মোটেও দমে যাওয়ার পাত্র নন। ধ্বংসপ্রাপ্ত বিদ্যালয়কে পুনরুজ্জীবিত করেন কধুরখীল গ্রামের মহাত্মা পুরুষগণ।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিদ্যালয়টি সংস্কৃতি চর্চার এক অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। শিক্ষার্থীদের সৌন্দর্যবোধের উন্মোচন, প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশের লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাণী বন্দনার দিনে ‘কধুরখীল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সাংস্কৃতিক পরিষদ’ নামে সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। বিদ্যালয়ের প্রাক্তন সভাপতি মিলন দাশগুপ্ত, সহ সভাপতি পরিতোষ চৌধুরী এবং বর্তমান সভাপতি শফিউল আজম শেফুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এই পরিষদের কার্যক্রমকে গতিশীল রাখতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
বর্তমানে বিদ্যালয়ের শিক্ষক সঙ্গীত শিল্পী লিপি রানী শীলের তত্ত্বাবধানে ছাত্রীদের নিয়মিত সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চলমান। সাথে রয়েছেন বিদ্যালয়ের সাহিত্য ও সংস্কৃতি অনুরাগী শিক্ষক অমরনাথ চক্রবর্তী, দেবী দত্ত, তনুশ্রী বিশ্বাস, শুভাশিস নাথ, উবাইদুল হক, দিল আফরোজ হীরা, প্রকাশ কুমার ঘোষ। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এই পরিষদের কার্যক্রম বেগবান। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সঙ্গীত ও আবৃত্তির দুজন প্রশিক্ষক নিয়মিত ছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন। বিদ্যালয়ে জাতীয় দিবস, রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী, বাংলা নববর্ষ উদযাপন, বিভিন্ন সাহিত্যিক, নারী শিক্ষা ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রণী, বিপ্লবী মহীয়সী নারীদের নিয়ে নিয়মিত অনুষ্ঠান হয়ে থাকে বিদ্যালয়ে। আর এসকল অনুষ্ঠানে ছাত্রীরা পরিবেশন করে আবৃত্তি, নৃত্য, দেশের গান, পল্লীগীতি, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, আধুনিক গান, জারীগান। মঞ্চস্থ করে নাটক, গীতি আলেখ্য। উপজেলা-জেলা পর্যায়ে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং বিদগ্ধজনদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। এলাকার বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে ছাত্রীদের রয়েছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সরব উপস্থিতি এবং পরিবেশন করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সংস্কৃতি চর্চা হোক প্রাথমিক পর্যায় থেকে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই চর্চা বাধ্যতামূলক করা এখন সময়ের দাবি। স্থিতিশীল রাষ্ট্রের প্রয়োজনে মেধার উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে সংস্কৃতি চর্চা অপরিহার্য। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে শিক্ষার্থী আনন্দময় পরিবেশে শিক্ষা লাভ করবে এবং শিক্ষার্থীর সৃজন মনন আরো সমৃদ্ধ হবে, এই আশাবাদে এগিয়ে চলেছে কধুরখীল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সাংস্কৃতিক পরিষদ।