গত ৫ এপ্রিল ২০২৪ চট্টগ্রামের পশ্চিম ফিরোজ শাহ কলোনি এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হাত থেকে এক পথচারীকে বাঁচাতে জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯–এ ফোন করেন আলী রেজা নামের এক ছাত্র। জানতে পেরে তাঁকে মারধর করতে আসে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ সময় ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে হামলার শিকার হন তাঁর বাবা কোরবান আলী (৬০)। মুমূর্ষু অবস্থায় কয়েকদিন হাসপাতালে চিকিৎসার পর তিনি মারা যান।
অনেক স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরের ভাড়া বাসায় উঠেছিলেন ব্যবসায়ী সৈয়দ মুহাম্মদ তারেক। আশা ছিল ছেলেমেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করবেন। বড় মেয়ে মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পাওয়ায় আশায় বুক বেঁধেছিলেন। ভেবেছিলেন ছেলেটাও বোনের পথ অনুসরণ করে নিজেকে গড়ে তুলবেন। কিন্তু কলেজ পড়ুয়া আসকার বিন তারেক (১৯) জড়িয়ে পড়ে কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে। অনেক বুঝিয়েছেন, কিন্তু শোনেনি। ২০২২ সালের ২২ এপ্রিল ছুরিকাঘাতে খুন হয় আসকার। ঘটনার দুই মাস পর শহর ছেড়ে লোহাগাড়ার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান সৈয়দ তারেক।ছেলে অহেতুক আড্ডা ও আজেবাজে বন্ধুদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাচ্ছিল। তাকে বোঝানো হতো, এগুলো একদিন বিপদ হতে পারে। কিন্তু সে কারো কথা শুনত না।’
২০১৮ সালে নগরের জামাল খান এলাকায় স্কুলছাত্র আদনান ইসফারকে গুলি করে খুন করে কিশোর গ্যাং। পরের বছর নগর পুলিশ কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা করে। এরপর থেকে গত ছয় বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত বলে জানায় পুলিশ। এর মধ্যে খুনের ঘটনা ৩৪টি। জানা যায়, ‘বড় ভাইয়েরা’ উঠতি তরুণদের প্রশ্রয় দিয়ে কিশোর গ্যাংএ যোগ দিতে উৎসাহিত করে। মূলত এলাকায় চাঁদা আদায়ের জন্য আধিপত্য বজায় রাখতে তাঁরা কিশোর গ্যাং গড়ে তোলেন। চাঁদার একটি অংশ ব্যয় হয় গ্যাংয়ের সদস্যদের পেছনে।
২০১৯ সালে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের করা তালিকায় কিশোর গ্যাংয়ের প্রশ্রয়দাতা ছিলেন ৪৮ জন, যাঁরা এলাকায় ‘বড় ভাই’ হিসেবে পরিচিত। পরে বিভিন্ন ঘটনা ও মামলার তদন্ত করতে গিয়ে আরো কমপক্ষে ১৬ জন ‘বড় ভাইয়ের’ খোঁজ পাওয়া যায়। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এলাকা ভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের প্রধানসহ ১৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব–পুলিশ।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অভিমত, পুলিশের একার পক্ষে এটি রোধ করা সম্ভব নয়। সমাজের সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। তারা বলেন, সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, পরিবারকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি পথশিশু, ভবঘুরে কিশোর–তাদেরকে পুনর্বাসন করতে হবে। এদিকে কিশোর অপরাধের মামলাও বেড়েছে চট্টগ্রামের আদালতে। বর্তমানে ২,২৩২টি মামলা বিচারাধীন। এসব মামলার বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং সংক্রান্ত বলে কৌঁসুলিদের অভিমত।
তবে পুলিশের সামপ্রতিক তথ্যমতে ৫ কাউন্সিলরসহ ৬৪ ‘বড় ভাইয়ের’ প্রশ্রয়ে চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং পরিচালিত হয়, এর সদস্য ১৪০০। এরা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সক্রিয় রয়েছে অন্তত ২০০ কিশোর গ্যাং। একেক দলে ৫–১৫ জন সদস্য রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ৪৫টি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে তাঁরা। নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে খুনোখুনি থেকে শুরু করে জায়গা দখল, অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারামারি, অস্ত্রবাজি, নারী উত্ত্যক্তসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। নামে কিশোর গ্যাং হলেও দলে ২০ থেকে ৩২ বছর বয়সীরাও রয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রাম নগরে স্কুলছাত্রদের অনেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অভিভাবকদের অগোচরে নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। যুক্ত হচ্ছে এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের করা জরিপে উঠে এসেছে এ তথ্য। চলতি বছরের শুরুতে নগরের তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নগর পুলিশের বিশেষ শাখা (সিটিএসবি) এ জরিপ চালায়। এতে ভিত্তি ধরা হয় গত এক বছরের (২০২৩ সাল) উপস্থিতির হার। জরিপ চালানো হয় ৭৮২ জন শিক্ষার্থীর ওপর। তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নবম–দশম শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার গড়ে ৪৬%। অনুপস্থিত থাকা ৫৪% শিক্ষার্থীর বেশির ভাগ ছাত্রই জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে।
সিটিএসবি জানায়, নগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সামাজিক অস্থিরতা ও কিশোর গ্যাংয়ের উত্থানের কারণ খুঁজতে গিয়ে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার তথ্য পায় পুলিশ। এসব ছাত্র পর্নোগ্রাফি, সাইবার অপরাধ, ছিনতাই, চুরি, মাদক নেওয়া ও কেনাবেচা এবং অনলাইন জুয়ার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে তারা বেছে নেয় স্কুলের সময়টা। এমনকি স্কুলের সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও শিক্ষার্থী দের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
সিটিএসবির তথ্য মতে, কিছু মামলায় পুলিশের তদন্তে স্কুল পড়ুয়া ছাত্রদের অপরাধের সত্যতা পাওয়া যায়। সেখানে দেখা গেছে নবম ও দশম শ্রেণির অনেক ছাত্রের অপরাধের শুরু হিরোইজম (বীরত্ব) দেখানো থেকে। প্রথমে চুরি ছিনতাই ও মাদকের নেশায় জড়ায়। এর পর নেশার টাকা জোগাড় ও নানা অপরাধ করে পার পেয়ে যেতে আশ্রয় নেয় এলাকা ভিত্তিক বড় ভাইদের কাছে। বড় ভাইয়েরা অপরাধমূলক কাজে কিশোরদের ব্যবহার করে। গুরুতর অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে অনেকে। দেখা গেছে পরিবারও এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিশোর গ্যাংয়ের বড় ভাইদের সংস্পর্শে আসার পর আচার আচরণেও নেতিবাচক পরিবর্তন হয়। তাঁরা জানান, নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া স্কুলপড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীকে অভিভাবকের জিম্মায় দেওয়া হয়, যাতে তারা সংশোধনের সুযোগ পায়। খুদেবার্তা চালু সহ জরিপে পাঁচটি সুপারিশ করা হয়। নবম, দশম ও একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণির মোট ক্লাসের ন্যূনতম ৭০% উপস্থিত না থাকলে নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না রাখা। যেসব শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার যৌক্তিক কারণে ৭০% এর নিচে থাকবে, তাদের কারণ বিবেচনার জন্য শিক্ষা বোর্ডের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা রাখা। শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে তা অভিভাবককে জানানোর জন্য এসএমএস (খুদে বার্তা) চালু ও ধারাবাহিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শ্রেণি কক্ষে ৭০% উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা। পুলিশের তথ্য মতে, শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা না থাকায় কোমল মতি শিক্ষার্থীরা বিপথগামী হচ্ছে। জরিপটি পাঁচটি সুপারিশসহ পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নজরে আনবেন।
জরিপ চালানো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের অভিমত আশপাশের বিভিন্ন বিপণিবিতান ও মাঠ থেকে অনেক শিক্ষার্থীকে ধরে আনা হয় এবং নিয়মিত কাউন্সেলিং করা হয়। তবে শুধু কাউন্সেলিংএর মাধ্যমে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এর জন্য চাই উপযুক্ত শাস্তি ও অভিযান। আর যাদের ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাং পরিচালিত হয়, দল মত ও রাজনৈতিক পরিচিতি বিবেচনা না নিয়ে তাদেরকে কঠোর হাতে দমন ও উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা। না হয় এই কিশোর গ্যাংএর সদস্যরা একদিন দানবে পরিণত হয়ে রাষ্ট্র ও সমাজকে অস্থিতিশীল করে ফেলবে।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।