এলসি ছাড়াই সাত শতাধিক গাড়ি আমদানিতে ব্যাপক তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনা নজিরবিহীন এবং এগুলো আনার ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম মানা হয়নি। দুইশ’ কোটিরও বেশি টাকা দামের এসব গাড়ি চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে খালাস করা হয়েছে। এর পাশাপাশি আরো অন্তত ১৩শ’ গাড়ি নিয়ে দুইটি রো রো ভ্যাসেল জাপান থেকে রওয়ানা হয়েছে। দেশের আমদানি নীতি অনুযায়ী আমদানি করা ৭৬৯টি গাড়ি ডেলিভারি নিতে কমপক্ষে দুই কোটি ডলারের এলসি (প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা) জাপানে পাঠাতে হবে। জাপানের বাংলাদেশি দু’জন শীর্ষ রপ্তানিকারকসহ কয়েকজন রপ্তানিকারক এদেশের গাড়ি ব্যবসায়ীদের কাছে এসব গাড়ি পাঠালেও ডলার সংকটের কারণে এলসি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। এখন কোনো ব্যাংক এলসি করতে রাজি হচ্ছে না। এ কারণে এই গাড়ির বহর নিয়ে জাপানে রপ্তানিকারক এবং দেশে আমদানিকারকরা সংকটে পড়েছেন।
সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের মোটরযান সেক্টরের প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর। গত কয়েকবছর ধরে নতুন গাড়ি আমদানির পরিমাণ বাড়লেও একসময় রিকন্ডিশন্ড গাড়ি এনে দেশের চাহিদা মেটানো হতো। এখনো নতুন গাড়ির পাশাপাশি জাপান থেকে প্রচুর পরিমাণে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করা হয়। দেশের আমদানিকারকদের পাশাপাশি জাপানে বসবাসকারী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের অনেকেই এখন শীর্ষ রপ্তানিকারক। এতে করে জাপানে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি রপ্তানিকারক এবং বাংলাদেশের আমদানিকারক উভয়ই বাংলাদেশি হওয়ায় তাদের মধ্যে বেশ সখ্য রয়েছে। আমদানিকারক এবং রপ্তানিকারকের সখ্যভাবের কারণে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের কিছু নীতিমালা এখানে উপেক্ষিত হয়। বিশেষ করে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের কারণে উভয়পক্ষই কিছুটা বাড়তি সুবিধা ভোগ করে।
প্রচলিত নীতি অনুযায়ী যে কোনো আমদানির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক ব্যাংকে এলসি খোলার পরই রপ্তানিকারক সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে পণ্য জাহাজীকরণ করে। গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রেও একই নীতি পালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু সম্প্রতি প্রচলিত নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশি আমদানিকারকের কাছে জাপানের রপ্তানিকারকেরা ব্যাংকের এলসি ছাড়া গাড়ি পাঠিয়ে দেন। এভাবে গাড়ি জাহাজীকরণের সুযোগ না থাকলেও আমদানি-রপ্তানিকারক মিলেমিশে এবং শিপিং এজেন্সিকে ম্যানেজ করে গাড়ির বহর পাঠিয়ে দেয়। কথা ছিল গাড়ি বন্দরে পৌঁছার আগেই এলসি পাঠিয়ে দেয়া হবে। এক্ষেত্রে গাড়িবাহী জাহাজ বন্দরে পৌঁছার আগে এলসি পাঠিয়ে দেয়া হলে বিষয়টি নিয়ে কেউ আর উচ্চবাচ্য করতেন না। কোনো সংকটও হতো না।
কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক সংকটে দেশে ডলারের হাহাকার চলছে। বিভিন্ন ব্যাংক এলসি খোলা অঘোষিতভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। যে কোনো এলসি খোলার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। অতি জরুরি ভোগ্যপণ্য ছাড়া প্রায় সব ধরনের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এলসি মার্জিন শতভাগ করে দেয়া হয়েছে। আগে যেখানে দশ থেকে ত্রিশ চল্লিশ শতাংশ মার্জিন দিয়ে এলসি খোলা যেতো সেখানে পণ্য মূল্যের পুরোটাই অগ্রিম পরিশোধ করার পরই কেবল এলসি খোলা হচ্ছে। গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রেও এলসি মার্জিন শতভাগ করে দেয়া হয়। আমদানি নিরুৎসাহিত করে ডলার সাশ্রয়ের জন্যই মূলত: সরকার এলসি মার্জিন শতভাগ করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, শুধু শতভাগ এলসি মার্জিনই নয়, পুরো টাকা দিয়েও এলসি খুলতে পারছিলেন না আমদানিকারকেরা। ব্যাংকে ব্যাংকে ধর্ণা দিয়েও এলসি খুলতে না পেরে বহু আমদানিকারকই হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। ডলারের অভাবে অসংখ্য আমদানিকারক এলসি খোলা থেকে বিরত থাকার ফলে গাড়ি আমদানিও একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে।
কিন্তু একেবারে আচমকা চট্টগ্রাম এবং মোংলা বন্দর গাড়িতে সয়লাব হয়ে উঠে। এনওয়াইকে শিপিং লাইন্সের রো রো ভ্যাসেল লোটাস লিডার এবং ইসিএল শিপিং লাইসেন্সের জাহাজ মালয়েশিয়া স্টার যোগে বিপুল সংখ্যক গাড়ি চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে পৌঁছে। এরমধ্যে প্রাডো, হ্যারিয়ার, প্রিমিও, এলিয়নসহ বিভিন্ন ব্রান্ডের ৭৬৯টি গাড়ির কোনো এলসি নেই বলে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। প্রচলিত নিয়মে আইজিএমে রপ্তানিকারক, আমদানিকারক এবং ব্যাংকের নাম থাকে। কিন্তু এসব গাড়ির আইজিএমে শুধুমাত্র আমদানিকারকের নাম রয়েছে। এতে করে এসব গাড়ির বিএল ইস্যু করা সম্ভব হচ্ছে না। শিপিং এজেন্সির পক্ষ থেকে বিএল ইস্যু করতে না পেরে মারাত্মক রকমের সংকটে পড়েছে। আমদানিকারকের সাথে এলসি নিয়ে সৃষ্ট বিরোধে মোংলা বন্দরের ৩০টি দামি গাড়ির চাবি নিয়ে যায় শিপিং এজেন্সি। বন্দর কর্তৃপক্ষ ইয়ার্ড ব্যবস্থাপনার জন্য গাড়িগুলো সরাতে গেলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করে। অনুসন্ধানে জানা যায় যে, চট্টগ্রাম বন্দরে ২১৯ টি এবং মোংলা বন্দরে ৫৫০ টি গাড়ির কোনো এলসি নেই।
সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম এবং মোংলা বন্দরে ইতোমধ্যে খালাস হওয়া এলসিবিহীন গাড়িগুলো ছাড়াও গত ১১ নভেম্বর এবং ১৪ নভেম্বর দুইটি জাহাজে আরো প্রায় ১৩শ’ এলসিবিহীন গাড়ি বাংলাদেশের পথে রয়েছে। জাহাজ দুইটি এলসিবিহীন গাড়িগুলো সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত নেয়া হতে পারে বলেও সূত্র আভাস দিয়েছে। অবশ্য এলসি ম্যানেজ করা গেলে গাড়িগুলো সিডিউল অনুযায়ী সিঙ্গাপুর থেকে ট্রানশিপমেন্ট হয়ে মোংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, বাংলাদেশে এলসিবিহীনভাবে আসা গাড়িগুলোর অধিকাংশই এনেছেন বারভিডার একজন নেতা। জাপানে বসবাসকারী বাংলাদেশি গাড়ি ব্যবসায়ী ড. জহির এবং মেজবাহউদ্দীনসহ কয়েকজন রপ্তানিকারক এসব গাড়ি রপ্তানি করেছেন। তবে এলসি না যাওয়ায় রপ্তানিকারকেরাও মারাত্মক রকমের বেকায়দায় পড়েছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বন্দরে খালাস হওয়া গাড়িগুলোর মালিকানা নিয়ে তারা সংকটে পড়তে যাচ্ছেন বলেও সূত্র আভাস দিয়েছে। এলসি ছাড়া গাড়িগুলো শিপিং লাইন্স কিভাবে জাহাজীকরণ করলো তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গাড়িগুলো জায়েজ করতে হলে কমপক্ষে প্রায় দুই কোটি ডলার বা দুইশ’ কোটিরও বেশি টাকার এলসি জাপানে পাঠাতে হবে। এখন কোনো ব্যাংকই এলসি করতে রাজি হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকেরা এখন বিভিন্ন ব্যাংকে এলসি খোলার জন্য ধর্ণা দিচ্ছেন বলেও সূত্র জানিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল ইসিএল শিপিং লাইন্সের কর্মকর্তা মহিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেন। গাড়ির এলসি সংক্রান্ত কথা বলার কথা বলতেই লাইন কেটে দেন। পরবর্তীতে ক্ষুদে বার্তা দিলেও তিনি আর কোনো উত্তর দেননি, ফোনও ধরেননি।
এনওয়াইকে শিপিং লাইসেন্সের কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি তাদের প্রতিটি গাড়িই এলসির মাধ্যমে আমদানি হয়েছে এবং হচ্ছে বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, এলসি ছাড়া গাড়ি আমদানির কোনো সুযোগ নেই। ১০ নভেম্বর আসা রো রো ভ্যাসেল লোটাস লিডারের সব গাড়ির এলসি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি ‘আছে’ বলে উল্লেখ করেন।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গাড়ি আমদানির কথা স্বীকার করে বলেছেন, এগুলোর এলসি আছে কি নেই তা দেখার দায়িত্ব বন্দরের নয়। গাড়িগুলো কিভাবে আনা হয়েছে বা এলসি আছে কিনা তা নোটিং করার সময় ধরা পড়বে। বিষয়টি শুল্কায়নে সংকট তৈরি করবে, বন্দরের নয়। বন্দর ৩০ দিন গাড়ি দেখবে। এরমধ্যে নোটিং না হলে গাড়ি নিলামে তোলার জন্য কাস্টমসে জানিয়ে দেবে। বন্দর শুধু ভাড়ার মালিক, গাড়ির নয় বলেও উল্লেখ করেন তারা।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঘটনাটি শুনেছি। এটা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। তবে শুল্কায়নের জন্য কাগজপত্র জমা না দেয়া পর্যন্ত বিষয়টি সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। আইজিএমে আমদানিকারকের পাশাপাশি রপ্তানিকারক এবং কোনো ব্যাংকের এলসির মাধ্যমে আমদানি হয়েছে তার উল্লেখ থাকে বলে তিনি জানান।