সালমা বিনতে শফিক
লালদিয়ার চরে একজন তারামন বিবি ছিল। আজ তিনি ভাসমান। তার তেত্রিশ বছরের সংসার আজ ছাদহারা। কর্ণফুলী সাক্ষী। স্বামী-সন্তান, হাঁড়িকুড়ি, বিছানা-বালিশই কেবল নয়, ঘরের চাল, বেড়া, দরজা, জানাালা খুলে নিয়ে পথে-পথে ঘুরছেন এখন তারামন। তারামন এই বাংলাদেশেরই নাগরিক। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উদযাপন করবেন তিনি খোলা আকাশের নিচে। নারী দিবস তিনি কীভাবে পালন করছেন, তাও- ভাববার বিষয়!
তারামনের প্রতিবেশী ইসমাইল মিয়া; বড় সাধ করে টিনের ঘর বেঁধেছিলেন মাত্র ছ’মাস আগে। এখন নিজ হাতে সব খুলে খুলে জড়ো করছেন। কোথায় নিয়ে যাবেন, পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় থাকবেন জানেন না। অনেক ধারকর্জ করে একটা সেমিপাকা ঘর বানিয়েছিলেন শাহ আলম। নিজ হাতে গড়া ঘর নিজের হাতে ভেঙেই পথে-পথে ঘুরছেন স্ত্রী-পরিজন নিয়ে।
চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা উচ্ছেদ অভিযান ছিল সেদিন। এককালের বিশ্বসেরা বন্দর, পর্তুগীজ নাবিকরা ষোড়শ শতকে ঞযব চড়ৎঃড় এৎধহফব বা ‘গ্রেট পোর্ট’/ বড় বন্দর নাম দিয়েছিল যাকে, তার উন্নয়ন থমকে আছে তারামন বিবিদের জবরদখলের কারণে। এই অনাচার সহ্য করা যায়না। তাইতো রচিত হয় ‘অ্যাকশন প্ল্যান’। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহস্রাধিক কর্মী তৈরি অভিযানে নেমে পড়তে। তাদের আর কষ্ট করে হাত পা নাড়াতে হয়না। অতিকায় বুলডোজারগুলো বেকার হয়ে পড়ে। তারামন বিবিরা স্বেচ্ছায় নিজ হাতে ঘর ভেঙে সরে পড়ে নিঃশব্দে। গুমরে কান্নার শব্দও শোনা যায়না। এমনকি শিশুরাও তাকিয়ে থাকে কান্না ভুলে। কোন প্রতিবাদ আসে না। একটা ঢিলও কেউ ছুঁড়ে মারে না কর্তৃপক্ষের ওপর। কেবল চাপা অসন্তোষ; ভিনদেশী শরণার্থীদের জন্য ‘বরাদ্দ জামাই আদর’ আর আমাদের জন্য আছে খোলা আকাশ।
ভাষার মাসের উদযাপন শেষে আমরা স্বাধীনতার মাস উদযাপন শুরু করেছি। স্বাধীনতার অর্ধশত বার্ষিকী এবার। আয়োজন তাই জমকালো হওয়া চাই। ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশও চলে এসেছে। সেদিনই চূড়ান্ত হয় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সংলগ্ন লালদিয়ার চরের উচ্ছেদ অভিযানের পরিকল্পনা। শান্তিপূর্ণ এই উচ্ছেদ অভিযানের সূত্রে চৌদ্দ হাজার মানুষ এক মুহূর্তে গৃহহীন হয়ে ঘুরছে নগরের পথে পথে।
অথচ একটা জলজ্যান্ত দ্বীপ দিয়ে ফেলেছি আমরা রোহিঙ্গাদেরকে। আমাদের পর্যটন শহরটাকে তছনছ করে দেওয়ার পর এখন কোটি টাকা খরচা করে সসম্মানে ওদের স্থানান্তরিত করে চলেছি হিমালয় থেকে বয়ে আসা পলি নিয়ে বঙ্গোপসাগরের বুকে নতুন গজিয়ে ওঠা ভাসান দ্বীপে। বিশ্বের নামি দামী সংস্থারা নিয়মিত খোঁজ খবর করছে- ওরা ঠিকঠাক আছে তো? কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে না তো? বিশ্ব মাঝারে মানবতাবাদী হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন শরণার্থী এমন কপাল নিয়ে এসেছে বলে শোনা যায়নি।
প্রসঙ্গতঃ বলি রোহিঙ্গাদের প্রতি কোন বিদ্বেষ নেই। আমার আপনার মতোই মানুষ ওরা। বিপদে পড়ে আমাদের সীমানায় আশ্রয় নিয়েছে ধরিত্রী মায়ের এই অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানেরা। আমাদের সদাশয় সরকার তাৎক্ষণিক সীমান্ত খুলে দিয়ে মানবিক ঔদার্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। স্থানীয় জনসাধারণদের অনেকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমার দেশের নাগরিকের চেয়ে শরণার্থীরা যখন অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় তখনতো ‘পরিবারে বিদ্রোহী সন্তানের’ মতো ক্ষোভ জন্মাবেই নাগরিকদের মাঝে।
তারামন বিবি, ইসমাইল মিয়া কিংবা শাহ আলমরাই কেবল ভিটেমাটি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছেন, তাই নয়। আবার লালদিয়ার চরও একমাত্র স্থান নয়, যার জন্য থমকে আছে নগরের উন্নয়ন। প্রতিদিনই খবর আসে উচ্ছেদের। কোথাও নামমাত্র ক্ষতিপূরণ মেলে, কোথাওবা কিছুই মেলে না। তবু ওদের জীবন কেটে যায়। কীভাবে, তা আমরা জানিনা, জানার প্রয়োজনও বোধ করিনা।
মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের সড়ক বিভাজকে বাঁশ, কাপড়, আর চাটাই দিয়ে ঘরকন্না পেতেছিলেন সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী নূরজাহান বেগম। রাজধানীর বুকে এই অসুন্দর দৃশ্য সহ্য হয়না আমাদের। কালো কাঁচ ঘেরা কোটি টাকার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাহনের যাত্রীদের চোখে লাগে এই কুৎসিত দৃশ্য। তাইতো ঐ এক চিলতে কুঁড়েঘরখানাকে হাতুড়ি দিয়ে ভেঙেচুরে অন্য কোন পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে ডেকে সব সাফসুতরো করে ফেলি আমরা (‘করজোড়ে কাঁদি চল সবে’- অর্ণব সান্যাল, অন্য আলো, প্রথম আলো, ৪/৩/২১)। নূরজাহানের করজোড়ে মিনতি’র সেই স্থিরচিত্র বিবেকবান মানুষের প্রাণ কাঁপিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা যারা বিবেককে অনেক আগেই গলা টিপে মেরে কবরও দিয়ে ফেলেছি তাদের কাছে এ যেন এক ‘আর্টফিল্ম’’, প্রামাণ্য চিত্রের অংশবিশেষ। এই স্থিরচিত্র নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক পুরস্কারের দাবীদার।
লালদিয়ার চরের ভূতপূর্ব বাসিন্দারা পুনর্বাসনের জন্য সরকারের কাছে মিনতি করেছেন। পুনর্বাসন হবে, কাগুজি ক্ষতিপূরণও হয়তো মিলবে। চৌদ্দ হাজার ভাসমান মানুষদের সকলেই তা পাবেন, এমনটা আশা করা বাতুলতা বৈ অন্য কিছু নয়। ক্ষতিপূরণ যদি মিলেও যায়, কারও তেত্রিশ, কারও চল্লিশ আবার কারওবা আটচল্লিশ বছরের সংসার, স্মৃতি- পারব কি আমরা ফিরিয়ে দিতে?
দেশজুড়ে শত সহস্র ভুমিদস্যু দিনরাত রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাহাড় নদী অরণ্য সাবাড় করে দিচ্ছে, আরও শতসহস্র ধনকুবের দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। এসব কর্মকাণ্ডের হোতা হিসেবে সময় সময়ে জনপ্রতিনিধিদের নামও আসে কাগজে। কোন কিছু বদলায়না, কারও গায়ে ফুলের টোকাও লাগেনা। তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়। তাদের উৎখাত করার প্রশ্নই আসেনা। বরং দিনে দিনে ফুলেফেঁপে বিশাল মহীরুহে পরিণত হয় তারা। তাদের জীবনযাত্রার মান ও মোট আয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের জাতীয় মাথাপিছু আয়ও বেড়ে যায়। তাইতো নামিদামী নাগরিক তাঁরা। তারামন বিবি কিংবা নুরজাহানরা কেবল নগরের সৌন্দর্যহানি করে তাই নয়, পরিবেশও দূষণ করে। নামীদামী নাগরিকদের জীবন- যাপন, আনন্দ বিনোদন দুর্বিষহ করে তোলে। তাই ওদের অদৃশ্য করে দেওয়াই বিধেয়।
কবিগুরুর ‘দুই বিঘা জমি’ শতবছর আগের সমাজে চলমান আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ও অমানবিকতার এক নিখাদ ছবি। বাবু’র বাগানখানা দৈর্ঘ্য প্রস্থে সমান করার জন্য উপেনের দুই বিঘা জমি ছাড়া চলছিল না। বাবুমশাই ঘোষণা দেন- ‘বুঝেছ উপেন, এ-জমি লইব কিনে’। বাবুর দয়ার শরীর! জমির ন্যায্য দাম দিয়েছেন উপেনকে। চাইলেইতো উৎখাত করে দিতে পারতেন কানাকড়ি না দিয়েই। উপেনের ছিল সাতপুরুষের ভিটা। তারামনদের তা নয়, তারা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। এতদিন ভোগদখল করেছিল- এই তো বেশী।
বারবার মনে পড়ে যায় বিশ্বকবিকে। তিনি বলেছিলেন, ‘দুর্বলেরে রক্ষা কর, দুর্জনেরে হানো’। এখন আমরা প্রতিনিয়তই দুর্জনকে রক্ষা করে দুর্বলকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ব্রতে নিয়োজিত। দেখেশুনে মনে হয় দারিদ্র নির্মূলের নামে আমরা দরিদ্র নির্মূলেই নেমেছি। আঠারো কোটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে হতদরিদ্র কয়েক কোটিকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলে সূচকের দৌড়ে আমরা এখনই বিশ্বমোড়লদের ছাড়িয়ে যেতে পারি।