ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া গড়তে আঞ্চলিক নেতাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বর্তমান বিশ্ব গ্লোবাল ভিলেজ। একা চলার কথা চিন্তা করা যাবে না। আমরা সম্মিলিতভাবে চিন্তা করবো। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে গতকাল সোমবার রাজধানীর প্যারেড স্কয়ারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে মুজিব চিরন্তন শীর্ষক মূল প্রতিপাদ্যের দশ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা’র ৬ষ্ঠ দিনের অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য ‘বাংলার মাটি আমার মাটি’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারী। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা, নেপালের রাষ্ট্রপতির কন্যা উষা কিরণ ভাণ্ডারী। খবর বাংলানিউজ ও বিডিনিউজের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দক্ষিণ এশিয়া সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। এখানে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে। আর রয়েছে জনগণ। আমরা সবাই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে একে অপরের হাত ধরে যদি এগিয়ে যাই অবশ্যই আমরা এই অঞ্চলের মানুষকে ক্ষুধা, দারিদ্র থেকে মুক্তি দিয়ে উন্নত, সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। শেখ হাসিনা বলেন, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দক্ষিণ এশিয়ার এক বিশাল সংখ্যক মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। বিপুল সংখ্যক মানুষ এখনও অর্ধাহারে বা না খেয়ে প্রতিরাতে ঘুমাতে যায়। অনেকে জীবন ধারণের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় যে প্রাকৃতিক সম্পদ আছে সে সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহার করে এ অঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে এ অঞ্চলকে দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস আমরা অব্যাহত রাখব।
জলবায়ু পরিবর্তনে দক্ষিণ এশিয়ার নাজুক অবস্থার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এমন একটি অঞ্চলে বাসবাস করি যা প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত দেশগুলো যেমন ভূমিকম্প, ক্লাউড ব্রাস্ট, বরফ ধ্বস, ভূমিধ্বস, ফ্লাস ফ্লাড বা হরকা বান ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ, তেমনি বাংলাদেশের মত সাগর-উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহ বারবার বন্যা, জলোচ্ছাস, ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টি বা খরার মত দুর্যোগের সম্মুখীন হয়।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ুর পরিবর্তন আমাদের এ উপমহাদেশের দেশগুলোকে সবচেয়ে বেশি নাজুক করে তুলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের অবদান না থাকলেও আমরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা অভিযোজনের মাধ্যমে সাময়িকভাবে নিজেদের রক্ষা করতে পারি, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারা বন্ধ করা না গেলে অভিযোজন প্রক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তিতে যোগ দিতে ঢাকায় আসায় নেপালের রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দুই দেশের মধ্যে চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। আমাদের মধ্যে ভৌগোলিক নৈকট্য ছাড়াও আমাদের রয়েছে প্রায় একই ধরনের ইতিহাস। আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের অবস্থান প্রায় এক এবং অভিন্ন। আলোচনা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম।
জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান : এদিকে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে সোমবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারী বলেছেন, নেতৃত্ব গুণে বাঙালির হৃদয় জয় করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের কাছেও পূজনীয় নেতা হিসাবে বিবেচিত। তিনি বলেন, অনলবর্ষী বক্তা, সংগঠক ও যোদ্ধা হিসাবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন এবং অর্জন করেছিলেন নতুন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য। এ অঞ্চলের মানুষের কাছেও তিনি পূজনীয় নেতা।
বাঙালির জোড়া উদযাপনে ১০ দিনব্যাপী আয়োজন ‘মুজিব চিরন্তন’ এর ষষ্ঠ দিন বিদেশি রাষ্ট্রনেতা হিসেবে বক্তব্য দেন বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারী। বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিকসহ অন্যান্য নৈকট্যের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি জন্মলগ্নের সম্পর্কের কথাও বলেন নেপালের প্রথম নারী রাষ্ট্রপ্রধান।
তিনি বলেন, আমি মনে করি, বাংলাদেশের ক্রমাগত অগ্রগতিই জাতি গঠনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন। তরুণ বয়স থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ নেতা, চমৎকার সংগঠক, ব্যক্তিত্বে দৃঢ় সংকল্প এবং লড়াকু যোদ্ধা।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নের সঙ্গে নেপালের ‘সমৃদ্ধ নেপাল, সুখী নেপালি’ সংকল্পের মিল থাকার কথা জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ভাণ্ডারী বলেন, নেপালকে সমৃদ্ধ দেশ করার জন্য আমাদের সব কার্যক্রম। আমি বিশ্বাস করি, উন্নয়নের মাধ্যমে নেপাল ও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিতেও ভূমিকা রাখবে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদাতা দেশগুলোর মধ্যে নেপাল ছিল ষষ্ঠ। সে কথা স্মরণ করে দেশটির প্রেসিডেন্ট বলেন, স্বাধীনতার পর খুব অল্প সময়ের শাসনে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সপ্রদায়ের কাছেও বাংলাদেশকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
নেপালের প্রেসিডেন্ট হয়ে এবার প্রথম এলেও এর আগে ব্যক্তিগত সফরে বাংলাদেশের আসার কথা বক্তৃতায় উল্লেখ করেন বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারী। দুই সফরের তুলনা করে তিনি বলেন, এবারের সফরে আমি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি জনগণের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি।
বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের মাঝারি পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যকে আরও বেগবান করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি বিরাজমান। বাণিজ্যকে দুই দেশের জন্যই লাভজনক করতে ঘাটতি কমিয়ে আনা দরকার। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও ত্বরান্বিত করতে বাণিজ্য বাধা দূর করা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বাজারে প্রবেশাধিকার সহজ করতে হবে। জ্বালানি খাতে সহযোগিতা বাড়াতে নেপাল-বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারী।
বাংলাদেশ-নেপালের মধ্যে ৪ এমওইউ স্বাক্ষর : পর্যটন, স্যানিটেশন, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও রেল ট্রানজিট বিষয়ে বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে চারটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। গতকাল সোমবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারির উপস্থিতিতে এসব এমওইউ স্বাক্ষর হয়।
পর্যটন সহযোগিতা শীর্ষক এমওইউতে বাংলাদেশের পক্ষে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন সচিব মোকাম্মেল হোসেন এবং নেপালের পক্ষে সংস্কৃতি, পর্যটন ও সিভিল এভিয়েশন সচিব যাদব প্রসাদ কৈরালা সই করেন। স্যানিটারি ও ফাইটোস্যানিটারি বিষয়ক এমওইউতে বাংলাদেশের পক্ষে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মেসবাহুল ইসলাম এবং নেপালের শিল্প, বাণিজ্য ও সরবরাহ সচিব দিনেশ ভট্টারি সই করেন।
২০২২-২০২৫ সাল পর্যন্ত সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বিষয়ে এমওইউতে বালাদেশের পক্ষে সংস্কৃতি সচিব বদরুল আরেফীন এবং নেপালের পক্ষে দেশটির সংস্কৃতি, পর্যটন ও সিভিল এভিয়েশন সচিব যাদব প্রসাদ কৈরালা সই করেন। ‘লেটার অব এঙচেঞ্জ অন রোহানপুর-সিংঘাবাদ রেলওয়ে রুট (অ্যামেন্ডমেন্ট টু নেপাল-বাংলাদেশ ট্রানজিট এগ্রিমেন্ট)’ শীর্ষক বিনিময়পত্র বাংলাদেশের পক্ষে বাণিজ্য সচিব জাফর উদ্দীন এবং নেপালের পক্ষে শিল্প, বাণিজ্য ও সরবরাহ সচিব দিনেশ ভট্টারি সই করেন।