রাশভারী, ঋষির মত কবি আহসান হাবীব। কথা বলতেন মৃদুস্বরে, বলার ভঙ্গিতে থাকত প্রত্যয়। সমকালীন জীবন ও সমাজের বাস্তবরূপ তাঁর কবিতায় সহজ সরল ভাষায় রূপ লাভ করেছে। তিনি বাংলাদেশের একজন অগ্রগণ্য কবি। নবীন–প্রবীন লেখক কবিদের পদচারণায় মুখর ছিল তাঁর কক্ষ।
বিশ শতকের সত্তর দশকে দৈনিক বাংলা এবং আহসান হাবীবকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যের মনন ও পরিশীলতার শুভ সূচনা হয়েছিল। সৃজনশীল সাহিত্য চর্চার যে মেধা আবশ্যক, বাক্য গঠনে যে পরিশ্রম, অধ্যাবসায় প্রয়োজন তরুণ লেখকদের তা আহসান হাবীরের কাছেই শেখা প্রয়োজন । অনবদ্য গুণের জন্য সাহিত্য সম্পাদনার ইতিহাসে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। আমৃত্যু সৌখিন এবং একদম ভাল মানুষ ছিলেন কবি আহসান হাবীব। ১৯১৭ সালে ২ জানুয়ারি বরিশাল জেলার (তৎকালীন) পিরোজপুর মহকুমার শঙ্করপাশা গ্রামে জন্ম কবি আহসান হাবীবের। বাবা হামিজ উদ্দীন হাওলাদার, মা জমিলা খাতুন। তাঁরা ছিলেন পাঁচ ভাই চার বোন। ১৯৪৭ সালের ২১ জুন বিয়ে করেন। স্ত্রী খাতুন সুফিয়া বগুড়া জেলার কাটনাপাড়া নিবাসী মহসিন আলীর কন্যা।
৮০ দশকে “উপমা” নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হতো লেখক আতাউল করিমের সম্পাদনায়। ১৯৮২ সালে “উপমা” কবি আহসান হাবীব সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। কবির কবিতা সংক্রান্ত বই, প্রবন্ধ, কবির নির্বাচিত কবিতা, কবিকে উৎসর্গীকৃত কবিতা, ইত্যাদি বিষায়াদি নিয়ে সমৃদ্ধ এই ছোট কাগজটি কবির অনুমতি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে অবিস্মরণীয় সৃষ্টি রেখে চলে যাবার আগে, দেখে গেছেন সে বছর ফেব্রুয়ারি বইমেলায় প্রকাশিত কবি আহসান হাবীবের কবিতা সম্পর্কে লেখা গ্রন্থ নিঃশব্দ বজ্র, কবি তুষার দাশের লেখা। “শ্রেষ্ঠ কবিতা” শিরোনামে আরেকটি বই প্রকাশ করেছিল অনন্যা প্রকাশনী ১৯৯৯ সালের বইমেলায়। মাহবুব সাদিক এবং আবিদ আনোয়ার সংকলিত “শ্রেষ্ঠ কবিতা” কবি আহসান হাবীবের।
লেখা অমনোনীত হলে খামে ভরে অশালীন কথা লিখে পাঠাতো বেনামী ব্যক্তি। রিকশায় অফিস যাবার পথে অশ্লীল ধ্বনি শুনেছেন। অনৈতিক ব্যবহার বা রুচিহীন কথায় কষ্ট পেয়েও তিনি অনুত্তেজিত থাকতেন। সাহিত্য সংস্কৃতি ছিল নিভৃতচারী কবির আত্মার জাগরণ।
হুমায়ুন আজাদ কবি আহসান হাবীব সম্পর্কে বলেছেন —“আহসান হাবীবের কবিতা আমাদের আধুনিকতা চর্চার প্রকৃত সোপান তৈরি করেছে। তিরিশের কবিরা কবিতায় যে রবীন্দ্রোত্তর ধারা প্রবাহিত করেছেন, আহসান হাবীব তাতেই অবগাহন করেছেন”। সাহিত্য–সংস্কৃতির আবহে কেটেছে বাল্য কৈশোর। পড়ার আনন্দ থেকে লেখার আগ্রহ অনুভব করেন। স্কুল ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ “ধরম” ১৯৩৩ সালে। পরের বছর ছাপা হয় কবিতা ‘মায়ের কবর পাড়ে’ পিরোজপুর গভঃ স্কুল ম্যাগাজিনে। এই স্কুল থেকেই এন্ট্রান্স পাশ করেন ১৯৩৫ সালে। ১৮ বছর বয়সে ভর্তি হন বরিশালের বি. এম. কলেজে। দেড় বছর কলেজে পড়ার পর অর্থনৈতিক কারণে পাঠ অসমাপ্ত রাখতে হয়। কবি হওয়ার বাসনা এবং অর্থ উপার্জনের জন্য কাজের খোঁজে কলকাতা পাড়ি দেন ১৯৩৬ সালের শেষ দিকে। কলকাতার সংগ্রামমুখর জীবনের পথ চলায় সাহিত্যচর্চা ছিল চিরসঙ্গী। আহসান হাবীবের প্রথম কবিতার বই “রাত্রি শেষ” প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ হলো, ছায়া হরিণ (১৯৬২ খ্রি.), সারা দুপুর (১৯৬৪ খ্রি.), আশার বসতি (১৯৭৪ খ্রি.), মেঘ বলে চৈত্রে যাবো (১৯৭৬ খ্রি.), দুইহাতে দুই আদিম পাথর (১৯৮০ খ্রি.), প্রেমের কবিতা (১৯৮১ খ্রি.), বিদীর্ন দর্পনে মুখ (১৯৮৫ খ্রি.) ইত্যাদি।
প্রধানত কবি হলেও তাঁর লেখা কিছু উপন্যাস ও অনুবাদ গ্রন্থও রয়েছে। তাঁর দুইটি বিশিষ্ট উপন্যাস হলো অরণ্য নীলিমা, রানী খালের সাঁকো। তাঁর অনুবাদগ্রন্থ– প্রবাল দ্বীপে তিন বন্ধু, অভিযাত্রিক কলম্বাস, ইন্দোনেশিয়া এবং তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ দুটি হলো, বিদেশের সেরা গল্প ও কাব্যলোক। শিশু কিশোরদের জন্য তিনি প্রচুর ছড়া ও কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতায় ছন্দ ও শব্দ সহজেই পাঠকের মন কাড়ে। কাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ হলো– জ্যোৎস্না রাতের গল্প, বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, ছুটির দিন দুপুরে ইত্যাদি। দৈনিক তকবীর পত্রিকায় প্রথম চাকুরি করেন। আহসান হাবীবের জীবনের প্রথম বেতন ছিল ১৭ টাকা। পরবর্তী সময়ে কলকাতায় বুলবুল পত্রিকা এবং মাসিক সওগাত পত্রিকায় কাজ। প্রায় চার বছর আকাশ বাণী কলকাতায় চাকরি। কবি আহসান হাবীবের পেশা প্রথম থেকেই ছিল সাংবাদিকতা। ১৯৫০ সালে ঢাকা ফিরে চাকরি নেন দৈনিক আজাদী ও মাসিক মোহম্মদীতে। পরে দৈনিক ইত্তেহাদ এবং সাপ্তাহিক প্রবাহেও কাজ করেছেন। প্রায় সাত বছর চাকুরি করেছেন “ফ্রাঙ্কলিন বুক প্রোগামাস”–এ উপদেষ্টা হিসাবে। সর্বশেষ কাজ করেছেন দৈনিক বাংলায় ১৯৬৪ সালে। পত্রিকার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন মৃত্যু পর্যন্ত। তখনকার সামপ্রদায়িক বাস্তবতায় তাঁর শিক্ষক বরদা চক্রবর্তীও কোনো মুসলমান ছেলের ‘কবি’ হওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেন নি। শ্লেষে ঝলসে উঠে শ্রেণিকক্ষে সবার সামনে তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুই কপি হয়েছিস, কপি?’
কিন্তু বৈরী ও বন্ধুর পথ মাড়িয়ে ও তা পেরিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। উত্তরকালে পূর্বকালের কথা মনে রেখে ‘দুই হাতে দুই আদম পাথর’ কবিতায় তিনি লিখেছেন—
“সেই যে সময়, জীবনের একমাত্র সময়,
যখন হঠাৎ একজন পথে উৎসাহে
তর্জনী তুলে সঙ্গীকে বলেন,
ওই যে ছেলেটি, ওই শাদা শার্ট, বই হাতে
এ নাকি এখনই সুন্দর কবিতা লেখে
মাঝে মাঝে শহরের পত্রিকায় ছাপা হয়, ‘তুমি দেখে নিও, ও একদিন বড় হবে’।”
গভীর জীবন বোধ ও আশাবাদ তাঁর কবিতাকে বিশিষ্ট ব্যঞ্জনা দান করেছে। তাঁর কবিতার স্নিগ্ধতা পাঠক চিত্তে এক মধুর আবেশ সৃষ্টি করে। তিনি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং আর্ত মানবতার স্বপক্ষে বক্তব্য রেখেছেন । মননশীল কবি, সাংবাদিক ও সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীব ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত দৈনিক পাকিস্তান থেকে দৈনিক বাংলায় রূপান্তরিত পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি ইউনোস্কা সাহিত্য পুরষ্কার (১৯৬৬ খ্রি.) বাংলা একাডেমী পুরষ্কার (১৯৬১ খ্রি.), নাসির উদ্দীন স্বর্ণ পদক (১৯৭৭ খ্রি.) একুশে পদক (১৯৭৮ খ্রি.), আবুল কালাম স্মৃতি পুরষ্কার (১৯৮৪ খ্রি.)। এছাড়াও তিনি কবিতালাপ সাহিত্য পুরষ্কার, লেখিকা সংঘ পদক, অলক্ত সাহিত্য পুরষ্কার, পদাবলী পুরষ্কার, কবি আবুল হাসান স্মৃতি পুরষ্কারে ও ভূষিত হন।
মানুষের জীবনে চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে নানা বৈচিত্র ও আনন্দ। এ আনন্দময় বিচিত্র জীবন থেকে বেঁচে থাকার সুখ ও সার্থকতা খুজঁতে হবে। কবি আহসান হাবীবের “আনন্দ” কবিতায় আনন্দের নানা উৎসের কথা বলা হয়েছে—
“আনন্দ রে আনন্দ বল, কোথায় রে তোর বাসা,
তুই কি আমার মা, নাকি তুই মায়ের ভালবাসা?
বাবার হাতে তুই কি উথাল মাটিতে ধান বোনা?
মায়ের হাতে কুলোয় ভরা ধানের মত সোনা?
তুই কি আমার ঘরের চালে ফুরিয়ে যাওয়া রাত?”
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুলাই ৬৮ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন মননশীল কবি ও সাহিত্যিক আহসান হাবীব।