কোনোদিন আর ফিরবে না, নিশ্চিত জেনেও কারো জন্য অপেক্ষা করার গল্পের নাম ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস”। একা একা হেঁটে যাওয়া শুধু, পৌঁছায় না কোথাও… এই গল্পের ছায়াচিত্র ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’। শিউলির মৌ মৌ ঘ্রাণে আমৃত্যু আলিঙ্গনে ভালোবাসার গন্ধ মাখার গান শোনায় ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’। অর্ধেকটা দম নিয়ে, বাকি অর্ধেকটা দুজন একসাথে নেয়ার আকুলতার ছবি আঁকে ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’। প্রহরবিহীন এক প্রতীক্ষার নাম ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’। হ্যাঁ, সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ঊনপঞ্চাশ বাতাস দেখার পরে একজন দর্শকের প্রতিক্রিয়া নয়, অনুভব জানাতে কলম ধরেছি। মাসুদ হাসান উজ্জ্বল এই সিনেমার পরিচালক, এবং একইসাথে গল্পরচয়িতা, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, শিল্প নির্দেশক এবং সঙ্গীত পরিচালক। সিনেমার শেষ দৃশ্যের পরে মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের এই সমস্ত পরিচয় আড়াল করে যে পরিচয়টি আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, তা হলো, তিনি আদ্যোপান্ত একজন শিল্পী এবং একজন মানবিক মানুষ।
ঊনপঞ্চাশ বাতাসের নির্মাণের আলাপচারিতায় তিনি বলেছেন, এটি একটি প্রেমের গল্প। প্রেমের তো বটেই, তবে একটু অন্যরকম প্রেম। সিনেমার পোস্টারের নিচে লেখা কাঁচের দেয়ালের গল্প নয়, সেটার যথার্থতা প্রমাণের গল্প বলে এই প্রেম। সত্যিই, গভীর এক মানবিক দেয়ালের গল্প। পরানের গহীনের গল্প। এই প্রেমের গল্পে প্রেমিকের চাইতে প্রেমিকার ওপরেই ভাবনার এবং মনযোগের সবটুকু আলো যেন ফেলতে চেয়েছেন নির্মাতা। সেখানে নীরা নামের নারীর প্রেমের আবেগ ছাপিয়ে তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, শিক্ষা, গবেষণা, কর্মই আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। তার প্রেমকে এসবই আরো বেশি অর্থপূর্ণ করে তুলেছে। ঊনপঞ্চাশ বাতাসের নীরাকে বুঝতে গিয়ে মনে পড়েছে রবীন্দ্রনাথকে। এক স্মৃতিকথায় তিনি লিখছেন, “একরকম ভালোবাসা আছে যা তুলে ধরে, বড় করে। আর একরকম ভালোবাসা আছে, আমাদের দেশে, যেটা মারে, চাপা দিয়ে দেয়। বিদেশে দেখেছি তারা যখন ভালোবাসে তখন তার ইমোশনকে একটা রূপ দেয়, একটা কাজের ভেতর দিয়ে তার প্রতিষ্ঠা করে। আমার মনে হয় আমাদের দেশের নারীদের কাছ থেকে যেটা পেতে পারতুম, তার অনেকখানি অপব্যয় হয় কেবলমাত্র তার চোখের জলের সীমানার মধ্যে”। নীরা তার সেই চোখের জলের সীমানা পেরিয়ে আবেগকে একটা বিনির্মাণের রূপ দিয়েছে। নির্মাতা উজ্জ্বলকে ধন্যবাদ, নারীকে আলো করে ভাবনার সত্যরূপ দেয়ার জন্য।
২০০৫ সালে রচিত পরিচালকের উপন্যাস ‘পাঁজর করোটি স্কন্ধের মালা’র অবলম্বনে এই সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে। উজ্জ্বলের লেখা এই উপন্যাসটি ২০১৬ সালে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৭ সালে ঊনপঞ্চাশ বাতাসের প্রাথমিক নির্মাণ কাজ শুরু হয়। একটু দীর্ঘ সময় ধরেই এর চিত্রগ্রহন আর সম্পাদনার কাজটি চলে। প্রায় তিন বছর। ২০২০ এর মার্চে যখন মুক্তির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হলো, ঠিক তখনই বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ তুঙ্গে। তাই মুক্তির প্রতীক্ষা আরো প্রলম্বিত হলো। তার প্রায় আট মাস পরে ২৩ অক্টোবর দেশ জুড়ে ঘোষিত হলো উনপঞ্চাশ বাতাসের মুক্তিক্ষণ। দেখে এলাম। গভীরে ছুঁয়ে গেল সিনেমাটি। বাংলা প্রবাদ ঊনপঞ্চাশ বায়ুর পাগলামির ছাঁট প্রেমের পাগলামো হয়েই গায়ে এসে লাগলো ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’-এর। এই পাগলামো সকলকে ছোঁবে না, ভাবাবে না। সময়ের চেয়ে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ভাবতে পারলে, আধুনিক মনন আর খানিকটা বিজ্ঞানমনস্ক চেতনা থাকলে, তবেই তাদের কাছে এ-সিনেমা ভালো লাগবে। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনেও হয়েছে, নির্মাতা গতানুগতিক প্রেমের একটি সিনেমা বানিয়ে হইচই ফেলে ভাইরাল হবার মানসে এ-সিনেমা নির্মাণ করেননি। তিনি আরো একটু গভীরে যেতে চেয়েছেন; ভাবনার, ভালোবাসার আর মানবিকতার।
ঊনপঞ্চাশ বাতাস-এর দৃশ্যায়ন আর অভিনয় বিষয়ে বলতে গেলে বলবো, এক কথায় অসাধারণ। সিনেমাটোগ্রাফি যাকে বলে, সেটা ছিল পুরো সময়টা জুড়ে চোখের আরাম আর একই সঙ্গে অনুভবের আরাম। বাতাসে আবির উড়িয়ে দেয়ার দৃশ্য, অয়নের অসুখের খবরটি নিশ্চিত হবার পরে শুকনো গাছের ডাল থেকে কাকদের উড়ে যাওয়ার দৃশ্য, অয়নের ঘরের বারান্দার রেলিঙে বৃষ্টি ঝরার দৃশ্য আর ‘প্রথম’ গানটিতে ওদের দুজনের সবুজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আলাদা করে চোখে লেগে আছে।
আর অভিনয়? শারলিন ফারজানা আর ইমতিয়াজ বর্ষণ… এরা দুজনেই মনে হয়েছে নিজেদের সত্যিকারের পরিচয় ভুলে গিয়েছিলেন। নীরা আর অয়ন ছাড়া আর অন্য কিছু ওদের অস্তিত্বে ছিল না। শারলিনকে আগে দেখেছি টিভির বিজ্ঞাপনে। এই প্রথম তার সিনেমায় অভিনয়। একবারও মনে হয়নি, এই তার প্রথম। এত পরিণত, এত পরিশীলিত তার অভিনয়। শারলিনের পোশাকভাবনা, তার উচ্চারণ, অভিনয়ের পরিমিতি, এ প্রজন্মের যে-কোনো অভিনেত্রীর ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠতে বাধ্য। বিউটি এবং ব্রেইন, দুটোই শারলিনের আছে। এবং দুটো বিষয়ই তিনি যত্নের সাথে কাজে লাগিয়েছেন।
ইমতিয়াজ বর্ষণ, জেনেছি মঞ্চাভিনেতা। মঞ্চে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা যার থাকে তাকে পর্দায় খুব বেশি শ্রম দিতে হয় না। বিরতির আগে পর্যন্ত মনে হয়েছে, অয়ন আরেকটু প্রাণ দিতে পারে তার অভিব্যক্তি প্রকাশে। পরে এসে উপলব্ধি করেছি, না, অয়নের চরিত্রই এমন। অন্যের জন্যে এত মানবিক কিন্তু নিজেকে নিয়ে রাজ্যের সমস্ত নির্লিপ্তি যেন অয়নের একারই। তাই আরেকটু প্রাণময় হবার কোনো অবকাশ ছিল না। আমি বর্ষণ লিখছি না, অয়ন লিখছি। কারণ, বিরতির পরে বর্ষণের আর কোনো অস্তিত্ব ছিল না এই সিনেমায়। তিনি অয়নকে এতটাই ধারণ করেছেন, এতটাই, একে অভিনয় বললে বর্ষণের প্রতি অবিচার করা হবে। অয়ন যখন রুগী হয়ে উঠেছেন; বর্ষণ, অয়ন আর অসুখ তখন মিলেমিশে একাকার। অ্যাম্বুলেসের ভেতরের অয়নকে চোখ থেকে মুছে দিতে অনেকটা সময় লাগবে আমার। নীরা আর অয়নকে আমার অভিবাদন, সম্পূর্ণরূপে নীরা আর অয়ন হয়ে উঠবার জন্য।
এরপরে বাকি থাকে গান। পরিচালনা, অভিনয় আর সিনেমাটোগ্রাফির সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে গেছে ঊনপঞ্চাশ বাতাস-এর গানগুলো। এত কাব্যিক গান আজকাল বাংলাদেশের সিনেমায় শোনা যায় না। সত্যিই বলছি। ‘প্রথম’ গানটি মানুষের কানে কানে বাজবে, মুখে মুখে ফিরবে, এ-আমার ধারণা। অর্থহীন দলের বেজবাবা সুমন ছাড়া এ-গান আর কেউ গাইলে এই আবেদন আসতো বলে মনে হয় না। এ গানের কথা লিখেছেন সুমন টিংকু, সুর দিয়েছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ, সঙ্গীত পরিচালনায় মাসুদ হাসান উজ্জ্বল। ‘চিবুক’ গানটি সিনেমায় শুনিনি, ইউটিউবে শুনেছি, দুর্দান্ত সুন্দর একটি গান। কথা, সুর, সঙ্গীত আয়োজন নির্মাতা উজ্জ্বলের আর গেয়েছেন ওপার বাংলার সিধু। ‘এ শহর জানে’ আরেকটি দারুণ স্পর্শী গান। সৌরিনের কথা, সুর আর কণ্ঠে গানটি ছুঁয়ে গেছে আমাকে। আমার বিশ্বাস, আপনাদেরকেও স্পর্শ করবে মায়াঝরানো এই গান।
আমি যখন সিনেমাটি দেখার অনুভব লিখতে বসেছি, পুরো অনুভবটুকুই লিখবো। ভালো-মন্দ সকলই। খুব বেশি প্রয়োজন ছিল না ঊনপঞ্চাশ বাতাসকে সময়ের দৈর্ঘ্যে এতটা দীর্ঘ করার। অপ্রয়োজনীয় মেদ ঝরাতে কিছু কিছু দৃশ্য অনায়াসেই বাদ দেয়া যেত। আর তাতে সিনেমাটি আরো তন্বী হতো। নীরার বন্ধুদের সাথে কাটানো তার বাসার দৃশ্য, বিয়ের বিস্তারিত পর্ব, এবং কবরস্থানে ধোঁয়া ছড়িয়ে অলৌকিকতার আবহ ফোটানো… সম্পাদনার টেবিলে এসব আরেকটু কাটছাট হলে, ঊনপঞ্চাশ বাতাসের সৌন্দর্যে খুব একটা টান পড়তো বলে মনে হয় না।
সবশেষে যেটা বলার, ভালো লেগেছে, ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ ভালো লেগেছে। সাহিত্যগুণ আছে, শিল্পগুণ আছে, বিনোদন আছে, আরো যেটা বিশেষভাবে উল্লেখ করার, সিনেমার কাহিনিতে বুদ্ধির দীপ্তি আছে। নির্মাতা মেধা দিয়েছেন, শ্রম দিয়েছেন, যত্ন দিয়েছেন, সময় দিয়েছেন ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’এ। এই সিনেমায় সংশ্লিষ্ট পুরো দল তাকে যথার্থভাবে সঙ্গ দিয়েছেন। তাদের সকলের এই নিবেদনগুলো অর্থপূর্ণ হবে তখনই, যখন দর্শক সিনেমা হলে গিয়ে এটি দেখবেন।। সিনেমাপ্রেমীদেরকে বলছি, দেখুন, সিনেমা হলে গিয়ে রেড অক্টোবর-এর প্রযোজনার “ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ দেখুন।