উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম গণিত বিশারদ ড. আতাউল হাকিম

মুহাম্মদ শামসুল হক | মঙ্গলবার , ১২ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

আমাদের চারদিকে কাছে-দূরে এমন অনেক জ্ঞানী গুণী শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, আইনজীবী, কবি সাহিত্যিক, সাংবাদিক রাজনীতিক, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, সমাজসেবক রয়েছেন যাঁরা সমাজকে নানাভাবে আলোকিত করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন- এখনো করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের কজনকেই নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা চেনেন, কজনই বা জানেন তাঁদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে। নতুন প্রজন্ম কেন, এ যুগের মধ্য বয়সের অনেকেরও সেই সব কৃতী পুরুষদের সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা নেই। এমনই একজন আলোকিত ব্যক্তিত্ব অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলিম গণিত বিশারদ, শিক্ষাবিদ, ড. আতাউল হাকিম। চট্টগ্রাম জেলাধীন পটিয়া উপজেলার নাইখাইন গ্রামে তাঁর জন্ম ১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি। তাঁর পিতার নাম মুন্সি চাঁদ মিয়া। তাঁর মৃত্যুদিন নিরবেই কেটে গেল গত ১১ সেপ্টেম্বর।
ড. আতাউল হাকিম আরব দেশগুলোর প্রায় সাড়ে তিন হাজার অংক শাস্ত্রবিদের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করেন। এজন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৪২ সালে তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলিম পিএইচডি (ডক্টরেট) ডিগ্রিধারী ব্যক্তি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তাঁর গবেষণা কর্মের নাম ‘দ্য আরব ম্যাথমেটিকস’। তাঁর প্রায় ২২ বছর সাধনার মাধ্যমে রচিত তিন হাজার ৭০৬ পৃষ্ঠার গবেষণা অভিসন্দর্ভ চার খণ্ডে বিভক্ত।
আতাউল হাকিম শৈশবে প্রাথমিক শিক্ষা নেন পটিয়া উপজেলার নিজ গ্রাম নাইখাইনের গৌরচন্দ্র ভিক্ষুর হাতে। গৈড়লা আপার প্রাইমারি স্কুল থেকে বৃত্তি নিয়ে ১৯০৬ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন এএস রাহাত আলী উচ্চবিদ্যালয়ে। এরপর ৭ম ও ৮ম শ্রেণিতে পড়েন পটিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে। তিনি ১৯১১ সালে চট্টগ্রাম সরকারি মোহসেনিয়া মাদ্রাসা (চট্টগ্রাম ওল্ড স্কিম মাদ্রাসা-বর্তমানে হাজি মুহাম্মদ মহসীন কলেজ) থেকে অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক, ১৯১৩ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএ ও ১৯১৫ সালে বিএ অনার্স পাস করেন। ১৯১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কশাস্ত্রে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং পরের বছর আরবীতেও এমএ পরীক্ষায় দ্বিতীয় হন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হয়েছিলেন প্রথম।
ড. আতাউল হাকিম অবিভক্ত বাংলাসহ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগে বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই চট্টগ্রাম কলেজের প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯২০ সালে কলকাতা ইসলামীয়া কলেজে অংকশাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে পরে অধ্যক্ষ হন। এ ছাড়া তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। জানা যায়, ব্রিটিশ ভারতের আইসিএস পরীক্ষার্থীর তালিকায় ড. আতাউল হাকিমের নাম প্রথম প্রস্তাব করা হয়। তবে এর সঙ্গে বলা হয়, তিনি যেন তাঁর দাড়ি কামিয়ে ফেলেন এবং লাল টুপি পরা পরিহার করেন। কিন্তু তিনি তা করতে রাজি হননি।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি পূর্ব বাংলায় আসেন এবং রাজশাহী রেঞ্জের বিভাগীয় স্কুল পরিদর্শক পদে যোগ দেন। একই পদে ১৯৪৯ সালে তিনি অবসর (মতান্তরে ১৯৫০ সালে) নেন। প্রায় দুই বছর অবসর কাটানোর পর আবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্ক বিভাগের রিডার পদে যোগ দেন এবং পরে অধ্যাপক হন। পরবর্তী সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্ক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হন। ড. আতাউল হাকিম প্রকাশনার জন্য তাঁর ‘দ্য আরব ম্যাথমেটিকস’ অভিসন্দর্ভের এক কপি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দেন। ড. হাকিম স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশেষ করে অঙ্কের ওপর বহু বই লিখেছেন। তবে বইগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি। ড. আতাউল হাকিম হোমিওপ্যাথি বিষয়েও অনুরাগী ছিলেন। তিনি ১৯৪৯ সালে হোমিওপ্যাথি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করে পরীক্ষায় সমগ্র পাকিস্তানে প্রথম হন এবং ৪৫০ পৃষ্ঠার Meteria Medica বিষয়ক গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করেন। তিনি হোমিওপ্যাথিক সোসাইটির অনারারি ফেলোশিপ অর্জন করেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বহু স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ ছিল। মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের তাঁর নামে বৃত্তি প্রদান করা হতো।
শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ড. শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী, ড. টি আহমেদ, ড. বি. করিমসহ অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁর ছাত্র এবং শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। এদের তালিকায় রয়েছেন-জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিচারপতি মঞ্জুর মোর্শেদ, ডা. মুহাম্মদ শহীদুলাহ, ড. কুদরত-ই-খুদা, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, নুরুল হক চৌধুরী, ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম, বিচারপতি মো. সায়েম, অর্থনীতিবিদ ড. নুরুল ইসলাম প্রমুখ।
কলকাতায় সেকালের চট্টগ্রামের মুসলিম ছাত্রদের লেখাপড়ার উপযোগী পরিবেশ, বিশেষত দরিদ্র ছাত্রদের থাকা খাওয়া ও ভর্তি সমস্যা ছিল প্রকট। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী চাকরিজীবীসহ অন্যরাও নানা সমস্যায় পড়তেন। তাদের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে চট্টগ্রামের খান বাহাদুর মুহাম্মদ ইব্রাহিম, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, আবদুল ওহাব চৌধুরী, মাওলানা নজির আহমদ চৌধুরী, খান বাহাদুর ফজলুল কাদের, অ্যাডভোকেট নুরুল হক চৌধুরী, মওলানা আবদুল হামিদ (ফখরে বাংলা) প্রমুখ মিলে ১৯১২ সালে চট্টগ্রাম মোসলেম ছাত্র সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনের পক্ষ থেকে ছাত্রদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করতে রচনা ও বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, নবীণবরণ, ঈদ পুনর্মিলনী, বৃত্তি প্রদান, ভর্তি ও থাকা খাওয়াসহ নানা রকম ব্যবস্থা নেওয়া হতো। কলকাতায় অবস্থানরত ড. আতাউল হাকিম ও তাঁর বড় ভাই ডা. আবদুল লতিফ এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। ড. হাকিম ১৯২৬ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন। অচিরেই এই সংগঠনের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত হয় এবং ‘চট্টগ্রাম মোসলেম ছাত্র’ ও ‘জনসমিতি’ রূপে কাজ শুরু করে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সংগঠনটির নেতা কর্মীরা ঢাকা চলে আসেন এবং চট্টগ্রাম সমিতি-ঢাকা নামে ৩২, তোপখানা রোডে সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করেন। সমিতিতে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে ড. আতাউল হাকিমকে মরণোত্তর ‘চট্টগ্রাম সমিতি পদক’ দিয়ে সম্মানিত করা হয়। এর আগে পিএইচডি ডিগ্রি লাভের পর কলকাতায় প্রবাসী চট্টগ্রামের অধিবাসীরা এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁকে ১৯৪৩ সালের ১৪ মার্চ সংবর্ধনা দেয়।
ড. আতাউল হাকিম সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, অর্থনীতিবিদ ড. নূরুল ইসলামের পিতা শিক্ষাবিদ আবদুর রহমান বলেন, ‘হার্ভার্ডের পাঠ্য তালিকা আলোচনা করে দেখা গেল বি.এ, অনার্স কোর্স পর্যন্ত Differeential Calculas এর জ্ঞান না থাকলে ভাল ফল করা যাবে না। নুরুর (ড. নূরুল ইসলাম) আইএতে অঙ্ক ছিল। কিন্তু বি.এতে অঙ্ক না পড়াতে Calculas সম্বন্ধে তার কোন জ্ঞানই ছিল না। হাতে তখনও দুই মাস সময় ছিল। ভাগ্যক্রমে প্রফেসার ড. আতাউল হাকিম সাহেব তখন কিছুদিনের জন্য সপরিবারে তাঁর নবনির্ম্মিত বাড়ীতে ছিলেন। তাঁকে বলাতে তিনি শিশুসুলভ উৎসাহভরে তাকে পড়াতে রাজী হয়ে গেলেন। দেড় মাইল দূর থেকে এসে রোজ প্রায় দুইতিন ঘন্টা করে তাকে পড়িয়ে যেতেন। এক পেয়লা চা ও কয়েক চিলিম খুসবো তামাক খেয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ী ফিরে যেতেন। যান বাহনের ভাড়াও নিতেন না। এবং এমন সময় আসতেন যখন খাওয়ার জন্য তাঁকে আটকে রাখাও যেতনা। এ বয়ো ও জ্ঞান-বৃদ্ধ লোকটি সারল্য ও সততার মিশ্রণে তাঁর জানা হাজার হাজার লোকের ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে এখনও সুস্থ শরীরে আত্মিক সাধনায় মগ্ন আছেন।’
তিন পুত্র ও চার কন্যার জনক এই কৃতী শিক্ষাবিদ ১৯৬৯ সালের (চট্টগ্রাম চরিতাভিধান মতে ১৯৭৩) ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তথ্যসূত্র : ১। চট্টগ্রাম সমিতি ঢাকার প্রকাশনা-শতবর্ষে চট্টগ্রাম সমিতি, ডিসেম্বর-২০১১, ২। পটিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় স্মরণিকা, (রমেশ যুগ), ৩। চট্টল মনীষা, আহমদ মমতাজ ও রাইহান নাসরীন সম্পাদিত-২০১৩, ৪। চট্টগ্রাম চরিতাভিধান, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, ড. সুনীতিভূষণ কানুনগো সম্পাদিত, ২০১২
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিউমার্কেটের পাশে ফুটপাতে অবৈধ হকার
পরবর্তী নিবন্ধহানাদার বাহিনীর বর্বরতার প্রতিশোধ নিতেই মুক্তিযুদ্ধে যান বিরণ চন্দ্র দে