ঈদ মানে সব দিকে আনন্দের জোয়ার। ঈদ মানে সব মনে খুশির সঞ্চার। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর রমজানের শেষ দিনে আকাশের এক কোণে বাঁকা চাঁদের মিষ্টি হাসি ঈদের জানান দেয়। সবাই একই সুরে গেয়ে উঠি কাজী নজরুল ইসলামের সেই অমর সংগীত, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’
সিয়াম সাধনা ও সংযম পালনের পর অপার খুশি আর আনন্দের বারতা নিয়ে সমাগত হয় শাওয়ালের নতুন চাঁদ, পবিত্র ঈদ–উল–ফিতর। হাজির হয় এক আনন্দঘন দিন। এ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে, আমাদের সারা বাংলাদেশেও।
এই ঈদ উপলক্ষ্যে মানুষ শিকড়ের টানে ফিরে যায় গ্রামে, আপনজনের কাছে। মিলিত হয় আত্মীয়–স্বজন ও পাড়া–প্রতিবেশীদের সাথে। ঈদ সব শ্রেণি–পেশার মানুষের মধ্যে গড়ে তোলে সৌহার্দ্য, সমপ্রীতি ও ঐক্যের বন্ধন। পবিত্র এদিনে ধনী–গরিব, আশরাফ–আতরাফ নির্বিশেষে সবাই এক কাতারে শামিল হন এবং ঈদের আনন্দকে ভাগাভাগি করে নেন। শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যময় সমাজ গঠনে ঈদ–উল–ফিতরের আবেদন তাই চিরন্তন।
তবে আমরা দেখি, ঈদে এলে সমাজের অসচ্ছল ব্যক্তিরা পড়েন দুর্বিপাকে। সচ্ছলদের খুশি দেখা ছাড়া গতি নেই যেন হতদরিদ্র শ্রেণির! তাদের জীবনে এই সময় হাহাকার সৃষ্টি হয়! তৈরি হয় শ্রেণি–বৈষম্য। পাশাপাশি সামাজিকভাবেও হেনস্তা হতে হয় দরিদ্রদের। স্ব–স্ব শ্রেণির বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। ঈদের আনন্দ ভাগ করতে গেলেও সেখান থেকে উল্টো দুঃখ পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অর্থনৈতিক, সামাজিক গণ্ডি পেরিয়ে ধর্মীয়ভাবেও দরিদ্ররা বৈষম্যের শিকার হন। ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে জাকাত দেওয়ার যে বিধান ধনীরা সেই হক সঠিকভাবে পালন করেন না। বরং ঈদের সাজসজ্জাকে কেন্দ্র করে আভিজাত্যের অহং দেখান। এর ফলে ঈদ ধনিক শ্রেণির জন্য আনন্দের হয়ে ওঠে। কিন্তু দরিদ্রের জন্য হয়ে ওঠে বেদনার। এতে ঈদের সর্বজনীন আনন্দকে ম্লান করে দেয়। তাই সমাজপতি, ধনিকশ্রেণির উচিত ঈদকে কেন্দ্র করে সামাজিক বৈষম্য যেন প্রকট আকার ধারণ না করে, সে ব্যাপারে প্রয়োজন পদক্ষেপ নেওয়া।
সকলে যদি সঠিক উদ্যোগ নেন, তাহলে অন্তত ঈদের দিন সবার মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব। এজন্য প্রথমেই অবস্থাপন্নদের দেওয়া জাকাতে সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ঈদকে কেন্দ্র করে একটি ফান্ড তৈরি করা যেতে পারে। যেই ফান্ডের আওতায় অসচ্ছল ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে তাদের মধ্যে বণ্টন করা যেতে পারে। এভাবে ঈদের আনন্দকে সর্বজনীন করে তোলা সম্ভব। এজন্য অবশ্যই সমাজের অবস্থা–সম্পন্নদের এগিয়ে আসতে হবে, রাখতে হবে ভূমিকা। তবেই ঈদ হয়ে উঠবে সর্বজনীন আনন্দের উৎসব। অর্থাৎ সবার পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতার মাধ্যমেই ঈদ হয়ে উঠতে পারে সর্বজনীন, ধনী–দরিদ্র সবার সমান আনন্দের দিন।
এদিকে এই ঈদ প্রতিটি ঘরে যেন নারীদের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রমের দিন নিয়ে আসে। নারীকে দেখা যায় ঈদের দিনে সবার মাঝে আনন্দ বিলিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিতে। রান্নাবান্নাসহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে বাধ্য হন গৃহবধূ এবং মা। ঈদের দিন কি রান্না হলো, ঘর কতখানি গোছানো এইসব দেখ বিচার করা হয় পরিবারের নারী সদস্যকে। যেনো নারী সদস্যের কাজ ঘরটাই ঠিক করে গোছানো। ঈদের একটা আনন্দের দিনে নারী চাইলে ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারে। নিজের যত্ন নিতে পারে। কিন্তু সেটা না করে নারী পড়ে থাকে রান্নাঘরে। কারণ আমরা ধরেই নিয়েছি, নারীর স্থান ঘরেও না, ঘরের রান্নাঘরে। হরেক পদের রান্না ছাড়াও হয়তো আমাদের উৎসব আয়োজন সম্পন্ন হতো কিন্তু তাতে কারও মন ভরে না! সবার মন রাখার দায়িত্ব নিজ কাঁধে টেনে নেওয়ার অসীম ধৈর্য নিয়ে নারীরা জন্মেছেন। এছাড়া উৎসবকেন্দ্রিক ঘর ঝাড়া, মোছা, আর কেনাকাটার দায়িত্ব তো থাকেই নারীর ওপরে। বিশেষ করে, গ্রামীণ পটভূমিতে নারীদের প্রাপ্য সম্মান দিতে এখনও সমাজে স্থবিরতা দেখা যায়। নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের প্রচেষ্টা, শিক্ষা গ্রহণে নারীদের আগ্রহ, কর্মসংস্থানে পুরুষের ন্যায় নারীদের অংশগ্রহণ ইত্যাদি কারণে পূর্বের তুলনায় কিয়দংশ হলেও নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বের ক্ষেত্রেও শাখা–প্রশাখা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বাঙালী নারীদের। নারীকে আরও বেশি প্রাণবন্ত, আধুনিক ও যুগোপযোগী হতে হচ্ছে দায়িত্ব পালন বিবেচনায় সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
আগামী দিনগুলো সত্য ও সুন্দর হোক। হাসি–খুশি ও ঈদের অনাবিল আনন্দে প্রতিটি মানুষের জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠুক। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, সংযম, সৌহার্দ্য ও সমপ্রীতির মেলবন্ধন পরিব্যাপ্তি লাভ করুক–এটাই হোক এবারের ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা।
ধনী–দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই যাতে ঈদের আনন্দ সমানভাবে উপভোগ করতে পারে, সেজন্য মানবতার মুক্তির দিশারি হিসেবে ইসলামের মর্মার্থ ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ৃক, ভরে উঠুক শান্তি আর সৌহার্দ্যৈ, গড়ে উঠুক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ পবিত্র ঈদুল ফিতরে আমার এ প্রত্যাশা।
লেখক : নারীনেত্রী ও সংগঠক।