জুন মাসে বাজেট ঘোষণা এদেশের রীতি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনও বাজেট করবে। নতুন মেয়রের এটা প্রথম বাজেট। সেই অনুভূতি থেকেই এই তাগিদনামা। ছাত্র জীবনে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে মেয়র মহোদয়ের জ্ঞানচর্চা সম্পর্কে জানি। তাঁর রাজনৈতিক নিবন্ধও পড়েছি। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি নিয়ে ছাত্রজীবনে তাঁর যৌক্তিক বিশ্লেষণে মুগ্ধ হয়েছি। আজকের দিনে সেসব রাজনৈতিক পাঠচক্র অচল হলেও নবনির্বাচিত মেয়রের পাঠাভ্যাস এখনও বর্তমান আশাকরি।
এমন ধারণা থেকে বলছি, ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত দৈনিক আজাদী’র ৩৫ বছর পূর্তিতে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যা ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ তাঁর গোচরিভূত হয়েছে। তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে, এমনকি সিটি কর্পোরেশনেও সংকলনটি থাকতে পারে। সিকি শতক আগের সংকলনটি আজাদী’র লাইব্রেরিতে আছে। নগরীর প্রথমবারের বাজেট প্রণয়নের আগে তাঁকে সংকলনটি আরেকবার পাঠের অনুরোধ করব। এটি হাজার বছরের চট্টগ্রামের এক অনন্য দলিল। এ জন্য অধ্যাপক মোহম্মদ খালেদ, জনাব এম.এ মালেক, অরুণ দাশগুপ্ত, মাহবুব হাসান, অধ্যাপক মাহবুবুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে আমরা একদল লেখক অনেক শ্রম দিয়েছি। এখানে চট্টগ্রামের হাজার বছরের নানানদিককে তুলে ধরা হয়েছে। যেহেতু এখনও মেয়র মহোদয়ের ‘হানিমুন পিরিয়ড’ চলছে, এসময়ে মহানগরীর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ইতিহাস, ঐতিহ্যকে জানতে পুনর্পঠন জরুরি। আলোকিত নগর গড়তে সংকলনটি সহায়ক হবে।
মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের বছরটিতে পালিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তি। করোনায় আনুষ্ঠানিকতা কিছুটা ম্লান হলেও বাঙালির অন্তরে তা অম্লান হয়ে থাকবে। করোণা মোকাবেলায়ও আমরা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। কথায় আছে, ‘আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান, আঁরা সিনা দি ঠেকায় ঝড়, তুফান।’ আমরা হার মানতে জানি না। এমনতর প্রত্যয় থেকে মেয়রকে অনুরোধ করব, ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’-এর সহায়তায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তিকে উৎসর্গ করে ১০০ দফা (অথবা ৫০ দফা) কর্মপরিকল্পনা করুন। কর্মপরিকল্পনাটি মেয়রের মেয়াদকালীন সময়ে তিন ভাগে সম্পন্ন হবে। কিছু আশু করণীয়, কিছু মধ্যবর্তী এবং কিছু সম্পন্ন হবে শেষ প্রান্তে।
কর্মপরিকল্পনার সম্পূর্ণটাই নতুন হবে, এমনটি ভাবা সঠিক হবে না। পূর্ববর্তী মেয়রদের সফল কাজের ধরাবাহিকতাও এখানে থাকবে। এরসঙ্গে সৃজনশীলতাযুক্ত হবে। মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম প্রবেশমুখে সিটিগেইট নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু এটা একমাত্র প্রবেশমুখ নয়। দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে নগরীতে প্রবেশের দুটো পথ আছে। রাঙামাটি থেকে আসলে একটি, কাপ্তাই থেকে আসলে আরেকটি প্রবেশপথ আছে। এই চারটি প্রবেশমুখেও চারটি তোড়ন হতে পারে। কাজটিতে কর্পোরেশনের অর্থায়নের দরকার নেই। প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নকশা আহবান করে স্পন্সরের সহায়তায় নির্মাণ হবে।
চট্টগ্রাম থিয়েটার ইন্সটিটিউট এবং শহীদ মিনারের মধ্যবর্তী স্থানে একটি জাদুঘর থাকা দরকার। এই জাদুঘরে ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’-কে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়সহ নানাভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে। চট্টগ্রামের গুনীজনদের সম্পর্কে জানা যাবে। ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরে যেমন বাংলাদেশকে জানা যায়, সোনারগাঁও জাদুঘরে বাংলার লোক ঐতিহ্যকে পাওয়া যায়, তেমনিভাবে এখানে ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’-কে জানা যাবে। প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে, এই জাদুঘরে তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার থাকবে। জাদুঘরে প্রবেশ ফি থাকবে।
কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে প্রতিবছর একুশে সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়। খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু এর পরিধি বাড়াতে হবে। সাংবাদিকতা, আলোকচিত্র, শিল্পকলা, নৃত্য, আবৃত্তি, নাটক, সংগীত, চলচ্চিত্র ইত্যাদিকেও যুক্ত করতে হবে। এসব মাধ্যমেও চট্টগ্রামের অবদান অপরিসীম। এসবক্ষেত্রে মরণোত্তর পুরস্কারও থাকবে। তবেই প্রয়াতদের নতুন প্রজন্ম স্মরণে রাখবে। এ আয়োজন একুশে ফেব্রুয়ারির প্রাক্কালে হলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা প্রদান করতে হবে স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে। যেহেতু ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’-এর কথা বলছি, তাই সম্মাননা ৭১-এর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীদেরও মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করতে হবে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে কারো অবদানকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এভাবে সম্মাননা জানালে নেলী সেনগুপ্তাদের বাড়ি দখলমুক্ত করতে পথে নামতে হবে না। সৃজনশীল উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিজয় দিবসে তরুণ উদ্যোক্তাদের, রোকেয়া দিবসে নারী উদ্যোক্তাদের পুরস্কৃত করতে হবে। এর ফলে সার্বিকভাবে চট্টগ্রামে সৃজনশীল কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাবে।
কর্পোরেশনের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্তার’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখানে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক স্মৃতিচিহ্নের রেপ্লিকার পাশাপাশি জ্ঞানার্জনের জন্য পাঠাগার থাকবে। পাঠাগারে বইয়ের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের লেখক, প্রকাশক অগ্রাধিকার পাবেন। এখানে চট্টগ্রামের প্রকাশকরাই শুধু বই সরবরাহ করবেন। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোও থাকবে। এরফলে জ্ঞান চর্চার পথ সুগম হবে। মৌলবাদের ভয়াল থাবা চট্টগ্রামের তারুণ্যকে আঘাত করতে পারবে না। একই সঙ্গে জ্ঞানমুখী বাণিজ্যের বিকাশ ঘটবে। মনে রাখতে হবে, এসব সৃজনশীল প্রকাশনাসংস্থা কর দেয়। এসব প্রতিষ্ঠান সচল থাকলে কর্পোরেশনের আয়ের পথও সুগম হবে। সিটি কর্পোরেশনেরও একটি নিজস্ব পাঠাগার থাকা উচিত। এখানে গবেষকরা জ্ঞানচর্চা করবেন। পাঠাগারের জন্য বই, পত্রিকা কেনার জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাজেট থাকাও জরুরি। আলোকিত মহানগর গড়তে এর প্রয়োজন আছে।
সিটি কর্পোরেশনে অনেক সড়ক আছে। এসব সড়ক চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনদের নামে নামকরণ করে দৃশ্যমান স্থানে তাঁদের ছবিসহ কীর্তিফলক স্থাপন করতে হবে। যেসব সড়কের ইতিমধ্যে নামকরণ আছে, ওসব সড়কের তাঁদের কীর্তিফলক স্থাপিত হবে। যেমন জানে আলম দোভাষ সড়ক, কাজেম আলী মাস্টার সড়ক, গোলাপ সিং লেইন ইত্যাদি। একটি সড়কের নামকরণ করুন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী সড়ক। ভাষা আন্দোলনের প্রথম ‘কবিতা কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ খ্যাত কোহিনূর প্রেসের মালিক, দেশের অন্যতম প্রাচীন দৈনিক আজাদীর প্রকাশক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের নামে আন্দরকিল্লা সড়কের নামকরণ হোক। যদিও আন্দরকিল্লা মোড়কে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক স্কোয়ার করা হয়েছে। এ রকম হতে পারে পাথরঘাটার একটি সড়কের নাম লোকনাথ বল সড়ক। ওখান থেকে ১৯৩০ সালে তিনি সদলবলে মাকে প্রণাম করে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলে গিয়েছিলেন। সদরঘাটের একটি সড়কের নাম দেওয়া উচিত শহীদ টেগরা বল সড়ক। এঁদের কারণেই চট্টগ্রাম, বীর চট্টগ্রাম হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়েছে, ‘চট্টগ্রাম সবার আগে’। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা সাংবাদিক লোকমান খান শেরওয়ানী, নেলী সেনগুপ্তা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এম.এ. মান্নান, সাহিত্যিক আবুল ফজল, অধ্যাপক মোহম্মদ খালেদ, বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম প্রমুখের নামেও সড়ক চাই। সড়কের সৌন্দর্য্যবর্ধনে জামালখানকে মডেল ধরা যেতে পারে। এভাবেই নগরীর দেয়ালে দেয়ালে ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’কে তুলে ধরতে হবে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন অনেকবার ক্লিন সিটির পুরস্কার পেয়েছে। চট্টগ্রাম কি একবারও সে পুরস্কার পেতে পারে না?
নগরীর ফুটপাত হকারের দখলে। কর্মপরিকল্পনায় হকারবান্ধব কর্মসূচি থাকবে। করের আওতায় এনে জহুর হকার মার্কেটের মতো এদের জন্যও স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। অস্থায়ী সান্ধ্য মার্কেট বসতে পারে। এলাকাভেদে দিন ভিন্ন হবে, একদিনে একাধিক এলাকায়ও বসতে পারে। ঢাকায় এমনটি আছে। থাইল্যান্ডে দেখেছি, বিশেষ বিশেষ রাস্তার ফুটপাতে কয়েক ঘন্টার জন্য অস্থায়ী সান্ধ্য মার্কেট বসতে। চট্টগ্রামেও হতে পারে।
নগরীর জলাবদ্ধতা দূর করাও হবে এই কর্মপরিকল্পনার অংশ। চীনের দুঃখ হোংহো, চট্টগ্রামের দুঃখ চাক্তাই খাল নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব কাজে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন। মহানগরীর কবরস্থান, শ্মাশনগুলো আধুনিকায়ন করা হোক। এদিকেও নজর চাই। ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ সংকলনটিতে এ সম্পর্কেও কিছু কথা আছে।
শুধু কবরস্থান, শ্মশানের জন্য নয়, সংকলনটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে রোডম্যাপ হিসাবে কাজ করবে। ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’-এর আলোকে পরিকল্পনা করেই প্রাচ্যের রাণী চট্টগ্রামকে সাজানো সম্ভব। অনেকেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনগণের করের টাকা ব্যয়ের বিপক্ষে মত দেবেন। এ কারণে তা বাস্তবায়নের জন্য স্পন্সর নিতে পারেন। কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে আলোকিত নগর গড়তে চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনদেরও সহায়তা থাকবে আশা রাখি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার