আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিন একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ। হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শা গ্রামে তাঁর জন্ম। ১৯৮৬ এবং ১৯৯১ সালে তিনি হাটহাজারী আসন হতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু দু’টি নির্বাচনেই হেরে যান তিনি। প্রথমবার হারেন পেশিশক্তির কাছে, আর পরেরবার হলেন অপপ্রচারের শিকার । আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিন ছিলেন একজন বিত্তবান মানুষ । এ’ সুবাদে তিনি চট্টগ্রাম ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন তৎকালীন চেম্বারের পরিচালকও ছিলেন। রাজনীতিতে আসার পূর্ব থেকেই এ’ মানুষটি মানবসেবাকে জীবনের অন্যতম ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। রাজনীতি যেহেতু সেবার অন্যতম ও অকৃত্রিম একটি মাধ্যম সেহেতু একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন আমৃত্যু। অবিরত ছুটেছেন মৃত্তিকার খোঁজে। বিত্তবান হলেও বিত্তের অহংকার কখনও ছুঁতে পারেনি এ মানুষটিকে। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন অকাতরে সদা সর্বক্ষণ। বর্তমান সমাজে বিত্তবান মানুষের অভাব নেই। কিন্তু এঁদের ক’জনইবা মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসেন? এঁদের ক’জনই মানবিক হতে পারেন! ক’জনইবা চিত্তবান হতে পারেন বা পেরেছেন! এরা বিত্তের সাথে তাদের চিত্তকেও অনেকটাই গুটিয়ে রাখেন। কিন্তু আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিন ছিলেন সম্পূর্ণ এর ব্যতিক্রম। তিনি বিত্তবানের চাইতেও চিত্তবান ছিলেন বেশি।একজন সম্পূর্ণ মৃত্তিকার মানুষ। রাজনীতিতে এসে এ’ সেবার মানসিকতাকে আরো প্রসারিত করলেন তিনি। হাটহাজারীর আকবরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের মঞ্চে তিনি ইন্তেকাল করেন। শত শত কোমলমতি ছাত্র- ছাত্রীর মাঝে একটি বিদ্যাপীঠের পবিত্র আঙিনায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এমন ব্যথাতুর ঘটনায় হাটহাজারীর মানুষ আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিনকে কখনও ভুলতে পারবে না। চট্টল শার্দুল এম আজিজ জীবদ্দশায় তাঁর অনুসারীদের প্রায়শ নাকি বলতেন তোমরা এমনভাবে রাজনীতি করো যেন জানাজায় মানুষ হয়। আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিন জননেতা এম এ আজিজের এ’ কথাকে বোধ হয় মনেপ্রাণে অনুসরণ করেছিলেন, ধারণ করেছিলেন। হয়তো তাই মানব কল্যাণেই নিয়োজিত করেছিলেন তার শ্রম, মেধার, চেষ্টার সবটুকুই মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। যার কারণে লালদীঘির মাঠে তাঁর জানাজায় হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিল। লালদীঘির মাঠ উপচে আশপাশের সড়ক, চত্বর কানায় কানায় ভরে গিয়েছিল মানুষে। শোকার্ত মানুষে পরিপূর্ণ লালদীঘির মাঠকে এদিন মনে হয়েছিল এ যেন এক জ্যোতির্ময় নক্ষত্রের কক্ষচ্যুতিতে আহাজারিরত বেদনাময় মহাকাশ।পরদিন পত্রিকার শিরোনাম ছিল এ’ রকম। এম এ আজিজের জানাজার পর আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিন এর জানাজাই ছিল সর্ববৃহৎ জানাজা ।দু’বার নির্বাচন করে তিনি তাঁর অনুকূলে জয় পাননি ঠিকই কিন্তু অন্তিম যাত্রায় মানুষকে কাঁদিয়েছেন অঝোরে। সেদিন তিনি জয় করতে পেরেছেন মানুষের ভালোবাসাকে।এ কান্নার কাছে, ভালোবাসার কাছে নির্বাচনের জয় পাওয়াটা অনেকটাই তুচ্ছ। মহান আল্লাহ্ হয়তো তাঁর জীবদ্দশায় এ তুচ্ছ ভালোবাসায় সিক্ত করেননি নির্লোভ, নিরহঙ্কার এ মানুষটিকে। আসলে আল্লাহ্ তাঁর ভালোবাসার মানুষদের সাথে এমনটাই করেন। আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিন জীবদ্দশায় হাটহাজারীর স্কুল, কলেজ,মসজিদ মাদরাসার উন্নয়নে যখন যেভাবে পেরেছেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সবসময়। কোন মানুষ তার কাছে সাহায্য চেয়ে খালি হাতে ফিরেছেন এমন নজির নেই। ডান হাতে দিলে তার বাম হাত জানতোনা।এমনই প্রচারবিমুখ ছিলেন তিনি। রাজনীতির এখন অনেকটা আকাল চলছে। শিষ্টাচার বর্জন, আমিত্বের প্রতিযোগিতা, সমাজ বা মানুষের কল্যাণ করার চাইতে লোভ আর মোহে অনন্ত নিজেকে ডুবিয়ে রাখা এখন আমাদের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যতটুকু করিনা তার চাইতে বেশি প্রচার করতে ভালোবাসি। সেবায় নিবেদিত না হয়ে আত্মতুষ্টিতে মনোনিবেশ করছি নিজেকে বা নিজেদের ক্রমাগত ।মনে করছি পরনিন্দাই যেন উত্তরণের অন্যতম নিয়ামক। কিন্তু চরিত্রে ও মননে এবং বিশ্বাসে এর সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন হাটহাজারীবাসীর প্রিয়জন, দানবীর আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিন। আজ মানুষটির অভাববোধ করছে ক্ষণে ক্ষণে হাটহাজারীবাসী। আমরা কিয়ত আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিনকে অনুসরণ করতে পারি। শিক্ষা নিতে পারি তাঁর আদর্শ ও চরিত্র থেকে। ১৯৯২ সালের ৩ জানুয়ারি এ কীর্তিমান মানুষের অকাল প্রয়াণ হয়। পাঁচলাইশস্থ কাতালগঞ্জের কবরস্থানে মৃত্তিকার এ মানুষটি শুয়ে আছেন এখন। এখানে শুয়ে থাকবেন তিনি অনন্তকাল। আল্লাহ্ তাঁকে বেহেস্ত নসীব করুন।
লেখক: সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিন স্মৃতি সংসদ, চট্টগ্রাম।