কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ ছাড়াও সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার অধিক ব্যয়ে ১৭টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে তিনটি প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর এবং উদ্বোধনের তালিকায় আছে ১৪টি প্রকল্প।
উদ্বোধনের তালিকা থাকা প্রকল্পগুলো হচ্ছে : চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ টাওয়ার, রাঙ্গুনিয়া উপেজেলায় নির্মিত জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, আনোয়ারা উপজেলায় নির্মিত জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, পটিয়া শেখ কামাল অডিটোরিয়াম কাম মাল্টিপারপাস হল, রাউজান উপজেলা শেখ কামাল কমপ্লেঙ নির্মাণ প্রকল্প, বিমানবন্দর প্রবেশমুখে গোলচত্বরে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল’, পটিয়া উপজেলার উজিরপুর সড়কের ১০ হাজার ৫৮০ মিটার চেইনেজে শিকলবাহা খালের উপর ৩৯০ দশমিক ৪০ মিটার দীর্ঘ পিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্প।
প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বাস্তবায়িত ৬টি প্রকল্পেরও উদ্বোধন করবেন। প্রকল্পগুলো হচ্ছে : ডিসি পার্ক, পর্যটক বাস, রিভার ক্রুজ ও ফুল ডে ট্যুর সম্বলিত পর্যটন সেবা, স্মার্ট স্কুল বাস সার্ভিস, ১৯১টি ইউনিয়নে খেলার মাঠ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, চট্টগ্রাম বার্ডস পার্ক ও হাজার বছরের নৌকা জাদুঘরের উদ্বোধন করবেন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, আমাদের প্রকল্পের অনেকগুলোর কাজ শেষ হয়েছে। যেগুলো হয়নি সেগুলো আগামী বছরের জুনের মধ্যে শেষ হবে।
দেশের প্রথম ভার্টিক্যাল ম্যুরাল : উদ্বোধনের তালিকায় থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৮৪ লাখ ব্যয়ে বিমানবন্দর প্রবেশমুখে গোলচত্বরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল’র কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। এটি দেশের প্রথম ভার্টিক্যাল ম্যুরাল (দ্বিমাত্রিক ভাস্কর্য)। ম্যুরালটি ৩৩ ফুট দীর্ঘ ১১৭ ফুট প্রশস্ত। ৫৭টি উলম্ব ধাতপ পাইপ দিয়ে এটি নির্মাণ করা হয়। ত্রিমাত্রিক কোণে ম্যুরালের সাথে ২৪ ফুট লম্বা ও ৩২ ফুট ব্যাসের একটি সাম্পানও রয়েছে।
সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, ম্যুারাল নির্মাণের পরিকল্পনাটি আমার ছিল। শিল্পীরা সেটা সুন্দর করে এঁেকছেন বা বাস্তবে রূপ দেন। বঙ্গবন্ধুর এ ভার্টিক্যাল ম্যুরাল কিন্তু বাংলাদেশের আর কোথাও হয়নি। পৃথিবীতে একটি আছে এবং সেটা হচ্ছে নেলসন ম্যান্ডেলার। ওই দিক থেকে আমাদের স্থাপিত ভার্টিক্যাল ম্যুরালটি পৃথিবীতে দ্বিতীয় এবং বাংলাদেশে প্রথম। এটা চট্টগ্রামবাসীর জন্য গৌরবের। চট্টগ্রামের নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য কর্পোরেশন যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তার প্রমাণ এটি।
অন্যান্য প্রকল্পের অগ্রগতি : প্রকল্পগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেঙ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে ২০৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৮৭ শতাংশ এবং আগামী বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এ প্রকল্পের আওতায় পুরনো শহীদ মিনারের আদল ঠিক রেখে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন শহীদ মিনার ও উন্মুক্ত গ্যালারি। এছাড়া পুরনো পাবলিক লাইব্রেরি ভেঙে ১৫ তলা গণগ্রন্থাগার ভবন ও পুরনো মুসলিম হল ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছে ৮ তলা ভবন।
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ টাওয়ার নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৮১ কোটি ২৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। পরে বিভিন্ন সংযোজন ও আনুষাঙ্গিক কাজসহ প্রকৃত ব্যয় প্রায় ১০০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে বলে জনিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম। জেলা পরিষদের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পটির ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
রাঙ্গুনিয়া উপেজেলায় জেলা পরিষদ ডাকবাংলো’র কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ ৮৪ হাজার ৫১১ টাকা। আনোয়ারা উপেজেলায় জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর কাজও শতভাগ শেষ হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয় ১ কোটি ৪৮ লাখ ২১ হাজার টাকা। জেলা পরিষদের উদ্যোগে পটিয়া শেখ কামাল অডিটোরিয়াম কাম মাল্টিপারপাস হল নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০ কোটি ১২ লাখ ৬১ হাজার টাকার প্রকল্পটির ৮৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে খরচ হয় ১৬ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। শতভাগ শেষ হয়েছে রাউজান উপজেলা শেখ কামাল কমপ্লেঙ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। জেলা পরিষদের এ প্রকল্পে খরচ হয় ৭ কোটি ৩১ লাখ ২৭ হাজার টাকা। এছাড়া শতভাগ শেষ হয়েছে ৪৫ কোটি ২৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয়ে পটিয়া উপজেলার উজিরপুর সড়কের ১০ হাজার ৫৮০ মিটার চেইনেজে শিকলবাহা খালের উপর ৩৯০ দশমিক ৪০ মিটার দীর্ঘ পিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।
৩ প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর : ১০৪ কোটি ব্যয়ে নির্মাণাধীন ৩ প্রকল্পেরও ভিত্তিপ্রস্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী। প্রকল্পগুলো হচ্ছে : চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ৪৫ কোটি টাকায় বাস্তবায়নাধীন জননেত্রী শেখ হাসিনা সড়কের চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প, নাবিক ও প্রবাসী শ্রমিক কল্যাণ পরিদপ্তরের ৫৯ কোটি ১৪ লাখ ১৪ হাজার টাকায় দক্ষিণ হালিশহরের সল্টগোলায় সীম্যান্স হোস্টেল কমপ্লেঙ ভবন নির্মাণ প্রকল্প ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণ প্রকল্প।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি একনেকে অনুমোদিত ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতায় এয়ারপোর্ট রোডসহ বিভিন্ন সড়কসমূহ উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ শীর্ষক দুই হাজার ৪৯০ কোটি ৯৬ লাখ ৬৯ হাজার টাকার প্রকল্পের আওতায় জননেত্রী শেখ হাসিনা সড়কের সিমেন্ট ক্রসিং থেকে বিমানবন্দর হয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল পর্যন্ত অংশ চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২৫ কোটি টাকায় টানেল থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত প্রায় ২ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার অংশে ৫০ শতাংশ কাজ শেষ করেছে চসিক। মূলত এ অংশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
চসিকের নির্বাহী মো. আশিকুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, টানেল মোড় থেকে এয়ারপোর্ট, বোট ক্লাব, রুবি সিমেন্ট গেট হয়ে সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত পুরো সড়কটি ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ। যার পুরোটাই চার লেনে উন্নীত হবে। সড়কের দুই পাশে ফুটপাত, ড্রেন ও মাঝখানে মিড আইল্যান্ড হবে। সাথে সৌন্দর্যবর্ধন করা হবে। বঙ্গবন্ধু টানেলের মুখ থেকে এয়ারর্পোটের মোড় পর্যন্ত আপাতত আমরা কাজ শেষ করেছি। সেখানে এক লেয়ার কার্পেটিং, ল্যান্ড মার্কিং এবং বাগান করেছি। তবে এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। মাঝখানে মিডআইল্যান্ডে বসার ব্লক হবে। রাস্তার পাশে মানুষের বসার সুন্দর ব্যবস্থা করা হবে। আরো সৌন্দর্যবর্ধন করা হবে।
এদিকে ২০২২ সালের ১১ অক্টোবর একনেকে অনুমোদন হয় সীম্যান্স হোস্টেল কমপ্লেঙ ভবন নির্মাণ প্রকল্পটি। সর্বশেষ গত ২৬ সেপ্টেম্বর গণপূর্ত অধিদপ্তর যাচাই–বাছাই করে দর প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম বন্দরে আগত বিদেশি নাবিকদের সাময়িক আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিশ্চিত হবে। একইসঙ্গে দেশি–বিদেশি নাবিকদের চিত্ত বিনোদন, লাইব্রেরি, ক্যাফেটেরিয়া, সাইবার ক্যাফে, জিমনেশিয়াম, এমিউজমেন্ট কর্নার ও অন্যান্য সুবিধাও নিশ্চিত হবে।