হৃদয় ক্ষরণ এবং রক্তক্ষরণ ভিন্ন প্রেক্ষিত ও আঙ্গিকের মানবিক বিপর্যয়, ভিন্ন বেদনা ও অনুভূতির ঘাত। রক্তক্ষরণের চেয়ে হৃদয় ক্ষরণ বহু গভীরের অমোচনীয় ক্ষত সৃষ্টি করে। হৃদয় ক্ষরণ মনস্তাত্ত্বিক। হৃদয় ক্ষরণের আঙ্গিক, চরিত্র, প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন।
পাকিস্তানের কারাগারে এক নির্জন-নিঃসঙ্গ অবস্থায় বাংলাদেশ বিনির্মাণের কারিগর শেখ মুজিবুর রহমানের হৃদয় ক্ষরণ হতো। পুত্র-কন্যা, স্বজন-পরিজন, সঙ্গী-সাথী থেকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিচ্ছিন্ন থাকার জন্য। এ ভাবেই, এ কারণেই কোন সন্তানের জন্মের সময় তিনি বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের পাশে থাকতে পারেননি। এমনকি সর্বশেষ সন্তান তাঁর চেতনা-দর্শনের প্রতিভূ শেখ রাসেলের জন্মের সময়ও নয়।
৪ বছরের ছেলেটি যখন জেলখানার গেটে এসে গলা জড়িয়ে ধরে বলতো, ‘আব্বু বালি চলো’।
তখন বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হৃদয় ভেঙে যেতো। হৃদয় ক্ষরণ হতো। এমনি হৃদয় ভাঙ্গা শত যন্ত্রণাকে জয় করে আমরা তাঁকে শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে জাতির পিতা করে পেয়েছি ।
বিপন্ন বিস্ময় মৃত্যুমুখী আহাজারি- ‘আমি মায়ের কাছে যাবো। আমাকে তোমরা মায়ের কাছে নিয়ে যাও’। ঘাতকরা যখন তাঁকে টানা হেচরা করছিল, তখন দশ বছর বয়সি রাসেল বুক শুকানো,চোখ শুকানো কান্নায় আহাজারি করেছিল, ‘আমি মায়ের কাছে যাব’। নির্মম পশুরা তাঁকে মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিল ঠিকই। স্বজনদের রক্তাক্ত মৃতদেহ ডিঙিয়ে তাঁকে সেখানে নেয়া হয়েছিল। মরার আগেই মারা হয়েছিল তাঁকে। সেখানেই তাঁর শুকানো আত্নার জীবন প্রদীপকে যন্ত্রদানবের গর্জে ওঠা পশুত্ব দিয়ে নিঃশেষ করে দেয়া হয়েছিল। কী নির্মমতা!
পৃথিবীর বর্বরতম হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল সেদিনের সেই কাকডাকা ভোরে, শ্বাশত আজানের ধ্বনিতে জেগে ওঠা ভোরে, বাংলাদেশের ৩২ নম্বরের বুকে ।
বিশ্ব মানবতা নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সেই বর্বরতায়। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আদরের রাসেল বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হত ৫৮ বছর।
রাসেলের হত্যাকাণ্ড ছিল বিশ্বের বর্বরতম হত্যাকাণ্ড, বিশ্ববিবেকের বিষণ্ন বিস্ময়।
১৯৬৪ সালে ১৮ অক্টোবর ৩২ নম্বরের বিস্ময়-বিহ্বলতাকে বিদীর্ণ করে, বিকশিত করে এ ধরায় আগমন করেছিল শেখ মুজিবের স্বপ্নের রাসেল। মধ্যরাতে নীরবতা ভেঙে গিয়েছিল আনন্দে উল্লাসে-বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে।
রাসেলের জন্মের সময়ও বরাবরের মত তিনি ছিলেন দেশের জন্য আইউবের বিরুদ্ধে নির্বাচনী ব্যস্ত কর্মকাণ্ডে , চট্টগ্রামে। ফুফুদের সহযোগিতায় বড় বোন হাসিনা-রেহানার উৎফুল্ল উচ্ছলতায় রাসেলের আগমন ছিল বিস্ময়কর।
বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের মননে যে বার্ট্রান্ড রাসেল সব সময় বিচরণ করত, তারই পারিবারিক প্রতীক ছিল শেখ রাসেল।
জন্ম নিয়ে শেখ রাসেলের প্রথম পরিচয় হয়েছে জেলখানার সাক্ষাৎকারের কক্ষের সাথে। পরিবারের অন্য সবার সাথে বাবা রাজনীতিক শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখতে শেখ রাসেলকে নেয়া হত জেলখানায়।
১৮ মাস বয়সে রাসেল জেলখানার অভ্যর্থনা কক্ষে যতক্ষণ বাবাকে না দেখে ততক্ষণ সে হাসে না, কথা বলেনা, গম্ভীর হয়ে থাকে। দূর থেকে দেখলেই আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করে। কাছে পেলেই গলা জড়িয়ে ধরে হাসে। খুশি প্রকাশ করে। জেলকে বলে আব্বার বাড়ি। ভুলিয়ে ভালিয়ে তাঁকে বিদায় দিতে হয়। এইটাই রাজনীতিক মুজিবকে গভীর ভাবে পীড়া দিত জেল জীবনে।
এভাবেই তাঁর বয়স যখন ২১ মাস, বাবা মুজিবকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে কী যেন বলতে চাইত।
একদিন শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের এই শিশু সন্তানটিকে রাজনীতির কথা বললেন, ‘আমার কানে কানে কথা বললে আইবি নারাজ হবে। ভাববে ২১ মাসের ছেলের সাথে রাজনীতি নিয়ে কানে কানে কথা বলছি।’
সকলেই হেসে উঠেছিল। এটা রাসেলের একটা খেলা, কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপ করে থাকত আর হাসত। এভাবেই জড়িয়ে রাখতে চাইত সে বাবাকে, বাংলাদেশকে। ফিরে যেতে চাইতনা ৩২ নম্বরে।’ তাঁর কাছে এটি ছিল বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পাঁচ বছর আগেই ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দেই রাসেল বুঝতে পেরেছিল, ‘এইতো বাংলাদেশ! এইতো নির্ভরতা! আমরা বুঝেছি আরো পাঁচ বছর পর। এখনও পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পারিনি আমরা। না রাসেলকে, না বঙ্গবন্ধুকে ।
শেখ মুজিবুর রহমানের উচ্ছ্বাসের অনুভূতি ছিল এমন, ‘জেলখানার অভ্যর্থনা কক্ষে একদিন রাসেল আমাকে পড়ে শোনাল, আড়াই বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে, ‘৬ দফা মানতে হবে-সংগ্রাম সংগ্রাম-চলবে চলবে-ইত্যাদি।’ ভাঙ্গা ভাঙ্গা করে বলে, কি মিষ্টি শোনায়! জিজ্ঞাসা করলাম, ও শিখলো কোথা থেকে?’
আড়াই বছরের শিশুর এ অনুভূতি ছিল পাকিস্তানের প্রতি বিদ্বেষ। নতুন স্বপ্নের বাংলাদেশের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার। উপনিবেশ মুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সার্বজনীন বাঙালি প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা। সংহতি ও মুক্তির সুকান্ত সূর্যের প্রদীপ্ত আওয়াজ-আভাস।
জেলে বন্দী নির্জন কক্ষের একাকিত্বের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘যেদিন বাচ্চাদের সাথে সাক্ষাৎ হয়, ওরা চলে যাওয়ার পর মন খারাপ লাগে’। এ খারাপ লাগা ছিল তাঁর সারা জীবনের অনুভূতি। দেশের জন্য, মানুষের জন্য এ খারাপ লাগাকে তিনি ভালোবেসে ছিলেন আজীবন। আমাদের শাপমোচন, পাপমোচন কি কোনদিনই হবে।
সেই হাঁটি হাঁটি পা পা শিশুকাল থেকেই শেখ রাসেল জানত ৩২ নম্বর তাঁর বাড়ি, জেলখানা বাবার বাড়ি। এই বোধ থেকেই রাসেলের বড় হওয়া। বাবা মুজিবের ৪৪ বছর বয়সে রাসেল পৃথিবীর মুখ দেখে। বাবার সাথে গল্প বলা, খেলাধুলা, মাছ ধরা ছিল তাঁর অন্যতম কাজ। চার ভাইবোন এবং মায়ের আদরে বড় হওয়া রাসেল বৃন্ত থেকে বিচ্যুত এক স্বপ্ন কুড়ির নাম। এক বিপন্ন বিস্ময়ের নাম। বর্বরতার নিকৃষ্টতম বিপন্নতার নাম। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বিপর্যস্ত মানবতার নাম।
বিশ্বমানবতার বিপন্ন বিস্ময় শেখ রাসেলের হত্যাকাণ্ড।
ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিল শেখ রাসেল। আমি মায়ের কাছে যাব বলে যে ছেলেটি আহাজারি করেছিল, মায়ের মৃতদেহ দেখে সেই ছেলেটি ভীতশুষ্ক আত্নায় বলেছিল, ‘আমাকে হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দাও’। সেদিনের সেই নির্মমতা, মানবিক বিপর্যয়ের বর্বরতা শিশু কিশোরের কাছে মানবিক চরম বিপর্যয়ের এ আহাজারি অক্ষয় অমলিন ।
মানুষ কতটুকু বর্বর হলে শিশুর মৃত্যুমুখী আহাজারি ব্যর্থ হয়, তা সেদিনের সেই আযানের পবিত্র আহবানের ধ্বনি মুখরিত ভোরে বিশ্ব মানবতা নির্বাক হয়ে শুনেছে।
রাসেল একটি স্বপ্নের নাম ছিল । যে স্বপ্নের সর্বাংশে জুড়ে বাংলাদেশ। শেখ মুজিব পরিবার, বাঙালি পরিবার।
শেখ হাসিনার ভাষায়, ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি কামাল জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজো ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্স ও এসেছে। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায়, আবার জেগে উঠে। আমরা ঘুমের ঢুলু ঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়।
মেজো ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন, আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুপু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথা ভরা ঘন কালো সিক্ত চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল’। কী উত্তপ্ত উষ্ণ অনুভূতি!
রাসেল বিশ্ব বিখ্যাত দার্শনিক, বিজ্ঞানী এবং সমাজ সংস্কারক। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে তিনি গঠন করেছিলেন ’কমিটি অফ হান্ড্রেডস’। এই পৃথিবীকে শান্তি ও সুখের নীড়ে পরিণত করার প্রচেষ্টায় যুক্ত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আজীবন। তাই দার্শনিক রাসেল ছিল তাঁর মনস্তাত্ত্বিক বন্ধু, সুহৃদ। আপন সন্তানের মধ্য দিয়েই তিনি রাসেলকে কাছে পেতে চেয়েছিলাম। বিশ্ব শান্তির স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে। কী অতৃপ্ত বিষ্ময়! কী পরিচ্ছন্ন আকাঙ্ক্ষা! এই চেতনা ও কর্মেরই স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন বিশ্ব শান্তি পরিষদ কর্তৃক ‘জুলিও কুরি সম্মাননা।’
১৯৬৬ ছয় দফা আন্দোলন বঙ্গবন্ধুকে ঘরছাড়া করে দেশের মানুষের জন্য। শেখ রাসেলকে তাঁর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করা হয়। মাকে আব্বা ডাকতে হয়েছে। এ জাতি কী ভাবে এ ঋণ শোধ করবে!
কী ছিল তাঁর অনুভূতি, যখন বড় দুই ভাই, ভাইদের বউ, চাচা, মায়ের লাশের পাশ দিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমরা কি কল্পনা করতে পারি? এ দায় আমরা কী ভাবে শোধ করবো?
বড় হলে রাসেল কেমন হতো? দেশকে কীভাবে ভালোবাসতো? সে রাজনীতিক হতো, নাকি বিজ্ঞানী হতো ? নাকি মানুষ গড়ার কারিগর হতো? কত কথাই তাঁকে নিয়ে জানার, বোঝার, ভাবার আছে আমাদের। শিশু রাসেলকে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মাঝে, শিশুদের মাঝে আমরা কীভাবে তুলে ধরছি? ধরতে পেরেছি কি? আমাদের দায়বোধ আমরা কীভাবে পরিশোধ করছি। আদৌ করছি কিনা?
শিশু রাসেলকে, তাঁর সে সময়কার শিশু মনস্তত্ত্ব, ক্রিয়া-কলাপ আমাদের বিদ্যালয়ের শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাঁকে জাগিয়ে রাখতে হবে শিশু-কিশোর, তারুণ্যের মাঝে, দেশপ্রেমের প্রতীক করে। প্রতিভূ করে।
বাংলাদেশের শিশু-কিশোর-তরুণবোধ ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন আগামী প্রজন্মের আদর্শ ও ভালোবাসার প্রতীক শিশু রাসেল। তাঁকে অধ্যায়ন করা যায় জীবনব্যাপী। অদম্য অগ্রগতির বাংলাদেশে পশ্চাৎপদ, অবহেলিত, অধিকারবঞ্চিত শিশু- কিশোরদের প্রত্যয় এবং শঙ্কামুক্ত প্রতীক হতে পারে শিশু শেখ রাসেল। তাঁকে নিয়ে লিখতে হবে। পড়তে হবে। ভাবতে হবে। তাঁর স্বল্পকালীন জীবনের সুরভীকে ছড়িয়ে দিতে হবে বাংলাদেশ থেকে বিশ্ব শিশুদের মাঝে।
আমরা শহীদ রাসেলের ৫৭তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করছি। গভীর শ্রদ্ধার সাথে শেখ রাসেল এবং তাঁর বাবা- মা- ভাই- ভাবীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি গভীর নিবেশে, ১৫ আগস্টের সকল বিদেহী আত্মার প্রতি। রাসেল সমগ্র বিশ্বের শিশু-কিশোরের প্রতিভূ। অক্ষয়, অব্যয় এক অতৃপ্ত আত্মা। তাঁর প্রতি গভীরতম শ্রদ্ধা।
ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি : মুক্তিযোদ্ধা, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।