২২ শ্রাবণ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। বেশিরভাগ বাঙালি এ দিবসটি গভীর বেদনার সাথে স্মরণ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসামান্য কবি, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক অর্থাৎ সাহিত্যের সব শাখায় তাঁর দৃপ্ত বিচরণ। নোবেল পুরস্কার পেয়ে তিনি বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে সমগ্র পৃথিবীতে পরিচিত করেছেন এবং মর্যাদা দান করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাই বাঙালি কখনো ভুলতে পারবে না।
অনেকের ধারণা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুব ধনী এবং তিনি অত্যন্ত আরাম আয়েশে জীবন কাটিয়েছেন এবং লেখালেখি করেছেন। কিন্তু এ তথ্য যে কত ভুল তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী যাঁরা পড়েছেন তাঁরা সেটা ভালো ভাবেই জানেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা জীবন স্মৃতিতে আমরা পড়েছি। শৈশব-কৈশোবের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত সাধাসিধে জীবন ছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “আমাদের চাল ছিল গরীবের মতন”। খাওয়ানোর দায়িত্ব ছিল ব্রজেশ্বরের হাতে। ফলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন “অল্প খাওয়া আমার দিব্যি সয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অল্প খাওয়াতে আমাকে কাহিল করেছিল। এমন কথা বলবার জো নেই। ……. শরীরটা ছিল একগুঁয়ে রকমের ভালো। অন্ধকার থাকতেই বিছানা থেকে (শীতকালেও) উঠতে হতো। তারপর কুস্তি লড়তে হতো। লেখাপড়ার জন্য সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি ও বিভিন্ন ধরণের গ্রন্থের সাথে সাথে শরীরবিদ্যা ব্যায়াম করা প্রভৃতি সবই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শিক্ষালাভ করতে হয়েছিল। যদিও বিদ্যালয়ের বাঁধা ধরা পথে তিনি পড়তে পছন্দ করতেন না। তাঁর যা পড়তে ভাল লাগতো তাই তিনি পড়তেন।
রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ব্যারিস্টার হবেন। কিন্তু যখন ব্যারিস্টারি না পড়ে তিনি দেশে ফিরে এলেন তখন তাঁর পিতা তাঁকে অবকাশ দিলেন না বরং বাংলার জমিদারি দেখাশোনার ভার দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও খুশি হয়েছিলেন। প্রকৃতি, নদী, মানুষ এ সবই তাঁর প্রিয় ছিল।
সেসময় অনেক বছর ধরে শিলাইদহ বিখ্যাত নদীবন্দর হিসেবে পরিচিত ছিল। বিভিন্ন ধরনের নৌকা সেখানে আসতো। ধান, পাট ও বিভিন্ন দ্রব্য ও ফসল আদান প্রদানের মাধ্যমে জমজমাট ব্যবসা চলতো। “বিহার থেকে আসতো বিশাল জবরজং নৌকা আর ঢাকা থেকে আসতো সুন্দর হালকা পানসি।” নৌকার যাতায়াতে পদ্মা নদী সব সময় ভরপুর থাকতো। বর্ষার জেলে-নৌকা ব্যস্ত থাকতো ইলিশ ধরার জন্য। কুষ্টিয়া রেল স্টেশন থেকে ট্রেনে করে কলকাতায় ইলিশ পাঠানো হতো।
ঠাকুর বাড়ির জমিদারি ছিল পূর্ব বঙ্গের শিলাইদহ, পাবনা, ফরিদপুর, রাজশাহী, বগুড়া প্রভৃতি বিভিন্ন জায়গায়, তখন নৌপথে এসব জায়গায় যাতায়াত করতে হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পদ্মা নদীকে খুব পছন্দ করতেন। তাঁর লেখায় প্রমত্ত পদ্মা নদীর অসংখ্য বর্ণনা আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর হাউজ বোটের নামকরণ করেছিলেন পদ্মা। প্রিন্স দ্বারকানায় ঠাকুর হাউজ বোটটি তৈরি করেছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় কলকাতার কাছে হুগলি নদীর তীরে বজরাটি বাঁধা থাকতো। তিনি অনেক সময় গঙ্গায় বেড়াতেন। সে সময় অনেক জমিদার বা ধনীব্যক্তি হাউজ বোট ব্যবহার করতেন। দূরের যাত্রায় বা আনন্দ ভ্রমণে হাউজ বোট ব্যবহৃত হতো। বিশেষ ধরনের এ হাউজ বোট ঢাকায় তৈরি হতো। এজন্য এগুলোকে ঢাকাই বজরা বলা হতো। বজরাগুলো প্রশ্বস্ত তবে ভারী ছিল তাই আস্তে আস্তে চলতো এবং অগভীর পানিতেও যাতায়াত করতে পারতো। এ বজরা গুলো বাংলার নদীতে বেশি দেখা যেতো।
শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসর এর তিন জমিদারি আর কুষ্টিয়ার কারখানা নদীপথে সংযুক্ত ছিল। এ সমস্ত জমিদারি দেখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রচুর সময় নদীতে কাটাতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বজবার সামনের কেবিনে বসতেন এবং জানালা দিয়ে নদীর দু’তীরের অপরূপ শ্যামল শোভা, নীল- সাদা আকাশ, উজ্জ্বল সোনালি রোদে ভরপুর পল্লীগ্রামের সৌন্দর্য ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দেখে আনন্দিত হতেন। তাঁর সাহিত্যে জীবন ও প্রকৃতি সংযুক্ত হয়ে এক অসামান্য রূপ দান করেছিল। ফলে তাঁর সাহিত্য হয়ে উঠলো জীবন রসে সিক্ত। শিলাইদহের বজরায় তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে তিনি অনেক সময় নিয়ে গিয়েছেন। তিনি লিখেছেন শিলাইদহের বজরায় তাঁর পিতা অনেক লেখালেখি করতেন।
রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। প্রতিটি নথিপত্র তিনি মনোযোগের সাথে দেখতেন। মতামত বা নির্দেশ দিতেন। তাঁর কর্মচারী এবং কৃষকরা জানতো তিনি কখনো অবিচার করবেন না। প্রজাদের অভাব অভিযোগ, কলহ-বিবাদ শুনতেন ও মিটিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন। তিনি প্রজাদেরকে আদালতে মামলা করতে বারণ করতেন। তাদের জন্য তিনি পঞ্চায়েতের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্য জমিদারদের মত ছিলেন না। প্রজাদের সাথে সহজভাবে কথা বলতেন। প্রজারাও কবিকে নিজেদের ব্যক্তিগত সুখ-দু:খের কথা বলতে দ্বিধা করতো না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নির্দেশ দিয়েছিলেন কোন প্রজা প্রয়োজন হলে সরাসরি তাঁর সাথে দেখা করবে। কর্মচারীরা কোন রকম বাধা দিতে পারবে না। তাই প্রজারা রবীন্দ্রনাথকে যেমন ভালোবাসতো তেমনি সম্মান করতো। আধুনিক কৃষিবিদ্যা ও চাষীদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রচেষ্টা আজ সবাই জানেন।
রবীন্দ্রনাথ মানুষকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় একটি ঘটনা থেকে। একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বজরায় ছিলেন। সে সময় তিন দিন ধরে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছিলেন নদীতে অদূরে একজন মানুষ ডুবে যাচ্ছে। সে পানির স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাঝিদের লাইফবোট বের করে তাঁকে উদ্ধার করতে বললেন। কিন্তু মাঝিরা বললো ঝড়ের মধ্যে যাওয়া ঠিক হবে না। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই লাইফবোটে চড়ে রওনা দিলেন। মাঝিরা তখন লজ্জিত হয়ে রবীন্দ্রনাথকে ফিরিয়ে এনে তারা ছোট নৌকায় রওনা দিয়েছিল এবং অনেক দূর থেকে ডুবন্ত মানুষটিকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল। সে একজন তরুণ গৃহবধু। সে আত্নহত্যা করতে চেয়েছিল কিন্তু সাঁতার জানতো তাই আত্নহত্যা করতে পারছিল না। রবীন্দ্রনাথ পরে খোঁজখবর নিয়ে দেখলেন মেয়েটি তার জমিদারির প্রজার স্ত্রী। তিনি প্রজাকে ডেকে সব কথা জেনে সমস্যা সমাধান করে দিয়েছিলেন। প্রজাটি তার স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিল এবং পরে জানা যায় তারা সুখেই বসবাস করেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষকে ভালোবেসেই শান্তি নিকেতনে আশ্রম-বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
শান্তি নিকেতনে আশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি ট্রাস্ট গঠন করে সেখানকার জমি ও দালান সমূহ দান করেছিলেন। আরও অর্থের প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরীর সমুদ্র সৈকতে অবস্থিত তাঁর মালিকাধীন বাংলোটি বিক্রি করে প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করেছিলেন। শান্তি নিকেতনে তখন আশ্রমের ছাত্ররা হলুদ ইউনিফর্ম পরে পোশাকের অভাব লুকিয়ে রাখতো। জুতা, স্যান্ডেল পরতো না। নিরামিষ খেতো। সেখানে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। তিনি স্বহস্তে রান্না করে প্রায় সময় শিক্ষক ছাত্রদের সুস্বাদু খাবারে আপ্যায়ন করাতেন।
যত কৃচ্ছসাধন করা হোক না কেন আশ্রম চালাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব কষ্ট হতো। শাস্তি নিকেতনের ট্রাস্ট থেকে পেতেন বার্ষিক আঠারো শত টাকা। নিজের আয় ছিল মাত্র দু’শত টাকা। ১৯০২ সালে মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর আগেই তিনি স্ত্রীর প্রায় সব গয়না আশ্রমের জন্য বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে, মানুষের দাক্ষিন্য গ্রহণ করতে তাঁর মন সায় দিতো না। তিনি বিভিন্ন নৃত্যানুষ্ঠান করে অর্থ সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করতেন। তাঁর বন্ধু লোকেন পালিতের কাছে অর্থ ঋণ করেছিলেন। লোকেন পালিতের মৃত্যুর পর তাঁর পিতা সব সম্পত্তি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে দেন। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঋণের টাকা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে শোধ করতে হতো। সব সময়ে শান্তি নিকেতনের জন্য তাঁকে অর্থ কষ্টে থাকতে হয়েছে।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিন কন্যা ও দু’পুত্রকে দেখাশোনার দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথকে পালন করতে হতো। যহ্মারোগে তাঁর কন্যাদের মৃত্যু যন্ত্রণা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। বালক পুত্র শমীর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ তীব্র কষ্ট পেয়েছিলেন। তবু সব দু:খকষ্ট নীরবে সহ্য করে সাহিত্যচর্চার সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন।
আশ্চর্যের বিষয় পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিশ্বভারতীর উপাচার্র্যের পদ থেকে ১৯৫৩সালে পদত্যাগ করতে হয় এবং তিনি দেরাদূনে চলে যান। ১৯৬১ সালে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রশত বার্ষিকী। একটি গ্রন্থে পড়েছিলাম রথীন্দ্রনাথ তখন উপাচার্য ছিলেন না, কিন্তু বিশ্বভারতী সোসাইটির সম্পাদক, বিশ্বভারতী সংসদের সম্পাদক এবং রবীন্দ্রভারতীর পরিচালক ছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাঁর কোন পরামর্শ নেওয়া হয় নি। এমনকি নিমন্ত্রণ পত্রও বিলম্বে পাঠানো হয়েছিল। ব্যথিত রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন নি। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একমাত্র জীবিত পুত্র হিসাবেও তো রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়া উচিৎ ছিল।
১৫ আগস্ট সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদিবস। তাই অনেক বাঙালির অকৃতজ্ঞতার একটি নিদর্শন অত্যন্ত দুঃখিত চিত্তে উল্লেখ না করে পারলাম না। বাঙালি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ জাতি বটে !
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক; কবি, সাহিত্যিক, কলামিস্ট