সময় হলে সবাইকে চলে যেতে হয়, আমার বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদেরও সময় হয়েছিলো, তাই তিনিও চলে গেছেন। আবুল কালাম আজাদ সীতাকুণ্ড থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, সীতাকুণ্ড পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত মেয়র এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট কমান্ডের নির্বাচিত কমান্ডার।
আবুল কালাম আজাদ আমার অর্ধশতাব্দিকালের বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন, যে কারণে তাঁর মৃত্যুতে বেদনার ভার, তাঁর স্ত্রী, পুত্র-কন্যা এবং ভাইবোনের পর, আমাকেই বেশি বহন করতে হচ্ছে।
একটা আফসোস থেকে গেল। মৃত্যুর পূর্বে শেষ দেখাটা তাঁকে দেখতে পারলাম না। কারণ তিনি মারা গেলেন যুক্তরাষ্ট্্ের। আর আমি তখন বাংলাদেশে। এমনকি তাঁর মরদেহ যখন দেশে এনে জানাজা এবং দাফন করা হলো, তখনো আমার পক্ষে উপস্থিত থাকা সম্ভব হলো না, কারণ সীতাকুণ্ডে যাওয়া আমার শারীরিক অবস্থায় অসম্ভব ছিলো।
খুব মনে পড়ছে তাঁকে। ২০১৮ সালে আমি যখন বস্টনে একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ পেলাম, তখন রথ দেখা কলা বেচার মতো সংবর্ধনার পাশাপাশি আমার আপাত নিরাময়অযোগ্য হৃদরোগেরও চিকিৎসার একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে-এই ভেবে আমি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম। যে ক’দিন (সম্ভবত পনের দিন) আমি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম, সে ক’দিন আবুল কালাম আজাদ এয়ারপোর্টে রিসিভ করা থেকে শুরু করে থাকা-খাওয়া পর্যন্ত আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছিলো। তীব্র শীতের মধ্যে সে কোথায় কি কাজ করতো, সে সময়টুকু বাদে কালাম আমার সঙ্গে লেগে ছিলো। আসার সময় বিদায় জানাতে বিমানবন্দরেও হাজির ছিলো। এরপর ফেসবুকে কালামকে দেখতাম, সেও আমাকে দেখতো।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাঙালি জাতিকে তা’ রক্ষার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত করার আহবান জানালে আমরা ‘স্বাধীনতা সূর্য’ ছিনিয়ে আনার অভিযানে বের হয়ে ৭১-এর মধ্য এপ্রিলে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ‘বগাফা’ নামক একটি শৈলচূড়ায় উপনীত হয়েছিলাম। ‘বগাফা’ ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) একটি প্রশিক্ষণ শিবির। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারত সরকার বিএসএফ-এর ঐ ট্রেনিং ক্যাম্পটি উন্মুক্ত করে দিয়েছিলো। আমাদের আগে একটি ব্যাচের প্রশিক্ষণ হয়েছিলো ঐ ক্যাম্পে। বাগাফা থেকে ২য় ব্যাচে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে আমরা সাতজন বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের সাতজনের নাম- আবুল কালাম আজাদ (সীতাকুণ্ড), চন্দ্রঘোনা থেকে আসা শাহ আলম বীর উত্তম (ওর বাড়ি নোয়াখালী, কিন্তু এর বাবা সেখানে কেপিএম-এ চাকরি করতেন। নৌকমান্ডো গঠিত হলে শাহ আলম নৌ কমান্ডো দলে যোগ দেয় এবং মধ্য আগস্টে বঙ্গোপসাগরে অপারেশন জ্যাকপটে নেতৃত্ব দিয়ে সফল আক্রমণ পরিচালনা করে বীর উত্তম উপাধি পায়; স্বাধীনতার পর শাহ আলম ডা. হয়ে চিকিৎসা পেশা আরম্ভ করেছিলো। কিন্তু দুরারোগ্য কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করে; মেডিক্যালে শাহ আলমের নামে একটি মিলনায়তন আছে), ক্যাপ্টেন মনসুরুল আমিন বাবলু (মুক্তিযুদ্ধকালেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন র্যাংকে লোক নিয়োগ করা হলে বাবলু পরীক্ষা দিয়ে সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে ক্যাপ্টেন হয়েছিলেন, বাবলু শাহ আলমের চাচাত ভাই), এস এম মাহবুব উল আলম (ঘাটফরহাদবেগ, এফএফ-এর একটি গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে দেশে প্রবেশ করে অনেক অপারেশন করে বিশেষ খ্যাতি পায়; সাকা চৌ-এর ওপর আক্রমণ তার একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন।), আবুল কাশেম চিশতি (রাঙ্গুনিয়া, তিব্বত-খ্যাত ব্যবসায়ী অছি মিয়া সওদাগরের পৌত্র বা প্রপৌত্র, সিগন্যাল কোরের সদস্য হয়ে আগরতলা মামলার আসামী মানিকদার সঙ্গে দেশে এসে যুদ্ধ করে), তাতু (রণবিক্রম ত্রিপুরা-খাগড়াছড়ি নিবাসী; তাতু খুব শক্তিশালী এবং সাহসী পুরুষ ছিলো, ওর ভাই নববিক্রম বহু পরে পুলিশের আইজি হয়েছিলো) এবং অধম নাসিরুদ্দিন চৌধুরী। ফখরুল কিংবা বশীর নামে অন্য আরেকজন হয়তো ছিলেন কিন্তু তাঁর নাম সম্পর্কে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। যাঁদের নাম আমি এখানে উল্লেখ করলাম, ট্রেনিং-এর সূত্রে আমাদের মধ্যে যে বিশেষ সম্পর্কে গড়ে উঠেছিলো, তার রসায়নেই হয়তো আমরা একটি স্থায়ী সম্পর্কে বাঁধা পড়েছি। মুক্তিযুদ্ধ তো একাত্তরেই শেষ গিয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে সৃষ্ট সম্পর্ক আমরা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। ট্রেনিং-য়ের ক্ষণস্থায়ী সম্পর্ক দীর্ঘতর হতে থাকলো, যখন প্রথমবারের মতো আমাদের ট্রেনিং-য়ের মেয়াদ বাড়িয়ে পনের দিন করা হলো। আমাদের আগে পটিয়ারই একটি গ্রুপ বগাফা থেকে এক সপ্তাহ ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে গিয়েছিলো। পটিয়ার করণখাইন নিবাসী নাজিরহাট কলেজের প্রফেসর শামসুল ইসলাম ছিলেন সে গ্রুপের কমান্ডার। সদস্যের মধ্যে আমার গ্রাম হুলাইন নিবাসী ও সহপাঠী আসলাম ও রফিক, গোবিন্দরখীল নিবাসী মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব পটিয়ার অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতা শামসুদ্দিন আহমদ, সাদারপাড়া নিবাসী ম্যাজিস্ট্রেট শফিকুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র গোলাম কিবরিয়া বাবুল এবং খরনা নিবাসী ছাত্রনেতা এ কে এম আবদুল মতিন চৌধুরী। বলা হলো আমাদেরকে স্পেশাল ট্রেনিং দেয়া হবে। স্পেশাল ট্রেনিং-এ ৩ ইঞ্চি মর্টার এবং এমএমজি অর্থাৎ মিডিয়াম মেশিন গান চালানো শেখানো হবে আমাদের। যাদের সঙ্গে বগাফা এসেছিলাম, তারা সবাই চলে গেলো; স্পেশাল ট্রেনিয়ের জন্য থেকে গেলাম শুধু আমরা ৭ জন। পনের দিনের স্পেশাল ট্রেনিং কোর্স শেষ হলো, ভেবেছিলাম এবার ছুটি পাবো। তা’ হলো না। এবার ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অম্পিনগর নামক একটি স্থানে আমাদেরকে নতুন করে ট্রেনিং-এর জন্য দাখিল করা হলো। অম্পি নগরকে ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে মাত্র তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে অনেক ব্যারাক, অনেক প্রশিক্ষণার্থী। সারাদেশে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আনা হয়েছিলো। ব্যারাক তৈরির কাজে আমরাও লেগে গেলাম। আবুল কালাম আজাদ ব্যারাকে আমার সঙ্গেই ছিলো। অম্পিনগরে সম্ভবত রাউজানের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তোফায়েল আহমদ ও এ কে এম আবু জাফর চৌধুরী, ফটিকছড়ির খায়রুল বশর, পাখি, মীর আহমদ, আনোয়ার নামেও সম্ভবত একজন ছিলো; রাঙ্গুনিয়ার আমিন শরীফ ছিলো কিনা মনে পড়ছে না। আমি পঞ্চাশ বছর পরে স্মৃতি হাতড়ে লিখছি-আমার বর্ণনায় ভুল থাকতে পারে, সেজন্য যাদের মনে আছে আমি তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। অম্পিনগরে সম্ভবত এক মাস ট্রেনিং নিয়েছিলাম। তারপর হরিণা ক্যাম্প, যেখান থেকে বগাফা গিয়েছিলাম, অনেকদিন পর আবার সেখানেই ফিরে আসলাম। হরিণা ক্যাম্পে দু’চারদিন থাকতে না থাকতে ইউসুফ ভাই (জেলার অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রনেতা এসএম ইউসুফ; তিনি আমাদের পাশের গ্রাম মনসার বাসিন্দা; আমার পিতা শিক্ষক এবং সাহিত্যিচর্চা করতেন সেজন্য তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন; তাঁর পিতাও ছিলেন শিক্ষক); ডেকে বললেন; অনেক তো ট্রেনিং নিয়েছ, এখন আরো একটা ট্রেনিংয়ের সুযোগ এসেছে, তোমাকে সেখানে পাঠাতে চাই, তুমি কি বলো, শুধুমাত্র ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের এই ট্রেনিংটা দেয়া হচ্ছে। আমি বললাম ইউসুফ ভাই, এখানে আপনিই আমার অভিভাবক, আপনি যা বলেন তাই করবো আমি। এই ট্রেনিংটা হলো মুজিব বাহিনী বা বিএলএফ-এর ট্রেনিং- ‘টানডুয়া’ এবং ‘হাফলং’-এই দু’জায়গায় ট্রেনিং হয়েছিলো। হাফলং তখন ভারতের আসাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো, বর্তমানে মিজোরামের অন্তর্গত। ইউসুফ ভাই আমাকে যেদিন বললেন, সেদিনই একটা ব্যাচ হাফলং যাচ্ছে। আমাকে বললেন, তুমি হাফলং চলে যাও, এটা মিস্ করা ঠিক হবে না। আমি একাই গিয়েছিলাম হাফলং; আবুল কালাম আজাদ বা আমার বগাফা ও অম্পিনগর ট্রেনিং- মেটরা আমার সঙ্গে হাফলং যাননি। আবুল কালাম আজাদ সম্ভবত টানডুয়া গিয়েছিলো। হাফলং-এর কথা এখানে বলার প্রয়োজন নেই।
হাফলং-এ যাবার আগে একটি ঘটনা ঘটেছিলো, যে ঘটনায় আবুল কালাম আজাদ, আবুল কাশেম চিশতি, শাহ আলম বীর উত্তম, ক্যাপ্টেন মনসুরুল আমিন বাবলু এবং আমি জড়িত ছিলাম। মাহবুব ছিলো না, রণবিক্রম ত্রিপুরা ছিলো কিনা সেটাও ভালো করে মনে পড়ছে না। যাই হোক, হরিণায় দুই পাহাড়ে দুটি ক্যাম্প- একদিকে আর্মি ক্যাম্প, অপরদিকে ইয়থ ক্যাম্প। আমরা ইয়থ ক্যাম্পে থাকতাম, তবে আর্মি ক্যাম্পেও যাতায়াত করতাম। আমাদের অপরিসীম কৌতূহল তখন। প্রয়াত বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক রইসুল হক বাহারের সঙ্গেও আমার প্রথম দেখা হয়েছিলো হরিণা ক্যাম্পে। আর্মি ক্যাম্পের লিয়াঁজো ছিলেন রব্বান ভাই, নিজাম ভাই। ইউসুফ ভাই রব্বান ভাই বন্ধু, এভাবেই হয়তো ইউসুফ ভাইর প্ররোচনায় আমরা একদিন মেজর জিয়ার নজরে পড়লাম। তিনি ঠিক করলেন, কালাম, চিশতী, শাহ আলম, বাবলু এবং আমাকে নিয়ে একটি অপারেশনে যাবেন। অপারেশনের কথা বিস্তারিত কিছু আমাদেরকে জানালো হয়নি। আমাদেরকে নিয়ে একদিন তিনি শুভপুর ব্রিজের কাছাকাছি নালুয়া নামক এক জায়গায় ভারতীয় বাহিনীর বিওপি (বর্ডার আউট পোস্ট) ছিলো, সেখানে গেলেন, সঙ্গে ভারতীয় সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন ঘোষ। নালুয়া বিওপি থেকে শুভপুর ব্রিজ খালিচোখে স্পষ্ট দেখা যায়।
আমরা যেদিন গেলাম, সেদিন ব্রিজে খুব কড়া পাহারা দেখা গেলো। ব্রিজের কাছে ঘেঁষার কোন উপায় নেই। মেজর জিয়ার পরিকল্পনা ছিলো বিস্ফোরক লাগিয়ে ব্রিজটা উড়িয়ে দেয়া। কিন্তু আর্মি টহলের জন্য সেটা সম্ভব ছিলো না। ফলে বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর অফিসারদ্বয় শুভপুর ব্রিজ ধ্বংসের পরিকল্পনা মূলতবী রেখে আমাদেরকে নিয়ে ফিরে আসলেন হরিণায়।
এরপর আবুল কালাম আজাদকে নিয়ে ভারতে আর কোনো স্মৃতি নেই।
মুক্তিযুদ্ধের পরপরই আবুল কালাম আজাদের আকর্ষণে আমি সীতাকুণ্ড চলে যাই। মাত্র দেশ স্বাধীন হচ্ছে, যুদ্ধের রেশ তখনো রয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ার সালাউদ্দিন ভাই (ইউসুফ সালাউদ্দিন-থানা কমান্ডার বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী), মোয়াজ ভাই (মোয়াজউদ্দিন আহমদ, ডেপুটি কমান্ডার-সীতাকুণ্ড থানা বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী)। কালামের বাড়িতে ক’দিন ছিলাম ওর ভাইয়ের মতো। ওর ভাই বোনদের কাছেও আমি ভাইয়ের মত গৃহীত হয়েছিলাম। কালামের ছোট ভাই আবু ছৈয়দের কথা খুব মনে পড়ছে। আবু ছৈয়দকে পরে আমি বিশ্ববিদ্যালয়েও পেয়েছিলাম। কালামের চাচাত ভাই সালাউদ্দিন ছিলো, ফরিদপুরের সিরাজ, শহীদ টিপুর ভাই রুহুল আমিন, ছাত্রনেতা ও অপারেশন ঈগলে অংশগ্রহণকারী মুজিববাহিনীর সদস্য এ কে এম সরওয়ার কামাল (দুলু), মোজাফফর ছিলো। দুলু’র বড় ভাই হরিণা ক্যাম্পের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এখলাসউদ্দিন ছিলেন কালামদের মুরব্বি। তিনি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর জন্য আমার খুব দুঃখ হয়। কারণ তাঁর উপযুক্ত পুত্র ডা. মাসুদ পারভেজ হঠাৎ করে মৃত্যুবরণ করে। সে ছিলো চক্ষু বিশেষজ্ঞ, এখলাস সাহেবের ছেলে একথা না জেনে আমি তাঁকে দু’বার আমার চোখ দেখিয়েছিলাম। আমার স্ত্রীকেও দেখিয়েছিলাম। এখলাস সাহেব নিজেও কর্কট রোগে আক্রমণে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন। তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আরো গভীর হয় যখন জানতে পারি আমাদের ছোট ভাই সাবেক ছাত্রনেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মনোয়ার তাঁর জামাতা।
জমজমাট আড্ডা, হাসি-ঠাট্টা-তামাসার মধ্যে কটা দিন কাটিয়ে দিয়েছিলাম। কালাম যখন চিরদিনের জন্য চলে গেল, সেইসব স্মৃতি এখন জ্বলজ্বল করে উঠলো।
পরে জাসদ করতে গিয়েও কালামকে আবার পেলাম। হরিণা, বগাফা, অম্পিনগরের সপ্তরথীর চারজন-কালাম, শাহ আলম বীর উত্তম, মাহবুব, আমি জাসদে যোগ দিয়েছিলাম। কালাম জাসদের বড় নেতা ছিলো। স্বাধীনতার পূর্বেও সে সীতাকুণ্ডের ছাত্র রাজনীতির মধ্যমণি ছিলো। ইঞ্জিনিয়ার সালাউদ্দিন ভাই, মোয়াজ ভাইরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছিলেন যুদ্ধের জন্য। কিন্তু কালাম বরবরই সীতাকুণ্ডেই ছিলো-স্বাধীনতার আগেও। পরেও সীতাকুণ্ডেই ছিলো। সীতাকুণ্ডের মাটি ও মানুষের নেতা আবুল কালাম আজাদ। সীতাকুণ্ডের মাটি থেকে উদ্ভূত, সীতাকুণ্ডের আলো-হাওয়ায় বর্ধিত যেজন, তাঁকে সীতাকুণ্ডের মানুষের অপরিসীম ভালোবাসায়, পরম মমতায় মাখামাখি হতে দেখেছি আমি। তাঁকে সীতাকুণ্ড পৌরসভার প্রথম মেয়র নির্বাচিত করে সীতাকুণ্ডের জনগণ তাঁর প্রতি ভালোবাসার প্রমাণই দিয়েছেন।
সীতাকুণ্ড ছাত্রলীগ ও ছাত্র রাজনীতির জন্য যে দু’জন ছাত্রনেতার কাছে ঋণী, তাঁরা হচ্ছেন-কাজী সিরাজুল আলম এবং আবুল কালাম আজাদ। অতঃপর সীতাকুণ্ড কলেজে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ৬৯-এর গণআন্দোলনে আবুল কালাম আজাদের সৈন্যপত্য গ্রহণ, ’৭০ এর নির্বাচন ও ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনে আবুল কালাম আজাদ অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রনেতা। কালাম ভাইয়ের সেই জনপ্রিয়তাই আমি স্বাধীনতার পরপর গিয়ে দেখেছি। এম আর সিদ্দিকী সাহেব এমএনএ, তিনি বড়লোক, অধ্যাপক শামসুল হক পাকিস্তানি বাহিনীর দালালি করে কোন পাতালে তলিয়ে গেছেন কে রাখে তার খোঁজ। সীতাকুণ্ডে তখন আবুল কালাম আজাদেরই পতাকা উড়ছে। জননেতা, ছাত্রনেতা দুই-ই। কালাম জেলা ছাত্রলীগের ধারায় রাজনীতি, ফলে ৬৭-৬৮ সাল থেকে সে নিউক্লিয়াসের সন্ধান পায়। ছাবের ভাই, রুশ্নি ভাই তাকে নিউক্লিয়াসের সদস্য করে নেন। তারপর ছালেহ ভাই, আমার মামা অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ তাকে স্বাধীনতার মন্ত্রগুপ্তি দেন। স্বাধীনতার পর জাসদ গঠিত হলে নিউক্লিয়াসের সংগঠকদের মধ্যে প্রায় সবাই জাসদে চলে আসেন। কালামও এসেছিলো। সে বোধ হয় বাসদও করেছিলো। তারপর বাসদও এক সময় ভেঙে গেলে করার আর কিছু ছিলো না। আমরা নানাদিকে ছিটকে পড়লাম।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক