আত্মহত্যা সমাধান নয় বরং মহাপাপ

মোঃ শফিকুল আলম খান | বুধবার , ১৬ মার্চ, ২০২২ at ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ

প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই অহরহ চোখে পড়ে আত্মহত্যার খবর। দেশের কোনো না জায়গায় কেউ না কেউ আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে কেহ রশিতে ঝুলে, কেহ বিষ পান করে, কেহ ঘুমের অতিরিক্ত ঔষধ সেবন করে,কেহ ছাদ থেকে লাফ দিয়ে বা কেউ নিজের অস্ত্রে গুলি খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। এগুলো দিনের অন্যান্য স্বাভাবিক ঘটনার মত নিমিষেই হারিয়ে যায়।
কিছুদিন আগে ফেসবুক লাইভে এসে নিজের গুলিতে এক ব্যবসায়ীর আত্মহত্যার ঘটনাটি সারা দেশে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। ঐদিন রাতে চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর আটান্ন বছর বয়সী ব্যবসায়ী তার ধানমন্ডির বাসায় ফেসবুক লাইভে এসে নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। সারা দেশের অগণিত মানুষ সেদিন বা পরে সরাসরি তার আত্মহত্যার দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করেছেন। আত্মহত্যার আগে উক্ত ব্যবসায়ী পনের মিনিটের উর্ধ্ব সময় ধরে তার আত্মহত্যার বিভিন্ন কারণ ফেসবুক লাইভে তুলে ধরেন। শুরুতে আত্মহত্যার কথা বললেও তিনি অত্যন্ত সুস্থ ও স্বাভাবিক গতিতে যেভাবে আত্মহত্যার কারণগুলো বলে যাচ্ছিলেন তাতে ঘুর্ণাক্ষরেও ধারণা করা যায়নি যে তিনি অল্প কিছুক্ষণ পরেই নিজের মাথায় পিস্তল দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করবেন। তার আত্মহত্যার এই ঘটনাটি সারাদেশকে নাড়া দিয়েছে। হাজারো প্রশ্ন সবার মনে জাগ্রত হয়েছে কেন এ আত্মহত্যা? আর মানুষই বা কেন নিজকে নিজে হত্যা করে।
আত্মহত্যা বা আত্মহনন হচ্ছে কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণ নিজে শেষ করে দেয়া। ল্যাটিন শব্দ * সুই সেইডেয়ার * থেকে সুইসাইড বা আত্মহত্যা কথাটি এসেছে যার অর্থ হচ্ছে নিজকে হত্যা করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে বিশ্বে প্রতি বছর দশ লাখ লোক আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে একটি।আমাদের দেশে প্রতি বছর গড়ে এগারো হাজার লোক আত্মহনন করে থাকে। পনের থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সের লোকদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
সাধারণত বিষন্নতায় যারা ভোগেন তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে। মার্কিন লেখক আ্যডওয়াডের্র মতে * যখন কেউ উপলব্ধি করে তার জীবনের কোন মূল্য নেই, তখন সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়* চিকিৎসকরা আত্মহত্যার চেষ্টাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। মূলত মানসিক বিষন্নতাই মানুষকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়। এছাড়া মানুষ আরো অনেক কারণে আত্মঘাতী হয়ে থাকেন। তন্মধ্যে হতাশা, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, পরকীয়া, পারিবারিক কলহ এবং আর্থিক সংকটের কারণে অনেকেই আত্মহত্যা করে থাকেন। অনেকে আবার তুচ্ছ কারণেও আত্মহত্যা করে থাকেন।
যিনি নিজে নিজের জীবন বিনাশ করেন তিনি সমাজে আত্মঘাতক, আত্মঘাতী বা আত্মঘাতীনি হিসেবে পরিচিত। আসলে আত্মহত্যার মধ্যে আত্মঘাতীর সমস্যার কোন সমাধান নেই। বরং ঐ ব্যক্তির আত্মহত্যার কারণে আরো বেশি সমস্যার সৃষ্টি হয়।তার পরিবার পরিজন সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়। প্রতিবেশিরা তাদের দেখে বাকা চোখে। হেনস্ত হতে হয় আইন সংস্থার কাছে। সম্মুখীন হতে হয় শত শত প্রশ্নের। পক্ষান্তরে আত্মঘাতী ব্যক্তি ঘৃণা ছাড়া কিছুই পায় না । পরকালে এ কারণে অনন্তকাল ধরে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। তাই বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় বলেছেন * মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই* আল্লাহতালা এই ধরণীকে সূন্দরভাবে সাজিয়েছেন মানুষের কল্যানে। এর অফুরন্ত ভান্ডারে রয়েছে মানুষের ভোগের সব উপকরণ। তিনি বলেছেন বিপদে ধৈর্য্য ধারণ কর। এরপরে কল্যাণকর কিছু হতে পারে। মানুষের জীবন হচ্ছে বহমান। এখানে সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, আনন্দ বেদনা, সফলতা ব্যর্থতা থাকবেই।এগুলো নিয়েই জীবন। এর মধ্যেই খুজে নিতে হবে মানসিক প্রশান্তি ও কল্যাণ। বিভিন্ন ধর্মে বিশেষ করে ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যাকে মহাপাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রোমে কেহ আত্মহত্যা করলে তাকে সাধারণ কবরস্থানে কবর দেয়া হত না। খ্রীষ্টান ধর্মে আত্মহত্যাকে পাপ হিসেবে গণ্য করে এটাকে শয়তানের কাজ হিসেবে গণ্য করে নিন্দা করা হত। ফ্রান্সের লুই চতুর্দশ এর জারী করা ফৌজদারি অধ্যাদেশ অনুযায়ী আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির লাশ রাস্তায় টেনে আনা হত। তার মাথা নিচু করে তারপর আর্বজনা দিয়ে ঢেকে দেয়া হত। তাছাড়া ঐ ব্যক্তির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হত।
ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী আত্মহত্যাকারীকে অনন্তকাল ধরে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে। আল্লাহ মানুষকে মরণশীল করে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই মানুষকে জন্ম দেন। আবার তিনিই তাদের মৃত্যু ঘটান। কিন্তু আত্মহত্যাকারী নিজের স্বাভাবিক মৃত্যুকে উপেক্ষা করে আল্লাহতালার ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি অবশ্যই কবিরা গুনাহ। আত্মহত্যা সম্পর্কে সুরা নিসার ২৯ আয়াতে আল্লাহ বলেন * আর তোমরা আত্মহত্যা কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াশীল।* সুরা বাকারার১৯৫ আয়াতে আল্লাহ বলেন * তোমরা তোমাদের নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কর না। তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।
আত্মহত্যা সম্পর্কে নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেন,* এক সাহাবী কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আহত হয়ে ব্যথায় চটপট করতে লাগলেন। ব্যথায় কাতর হয়ে সে তলোয়ার দিয়ে নিজেই নিজের হাত কেটে দেন। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু ঘটে। আল্লাহ এ ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন* আমার এ বান্দা নিজের ব্যাপারে খুবই তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে। আমি এ কারণে তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছি। হাদীস বোখারী ৩২৭৬।
তাই দেখা যায় আত্মহত্যায় সমস্যার কোন সমাধান নেই। এতে আত্মঘাতী কোন ফল লাভ করে না বরং তাকে এই ঘৃণ্যতম পাপ কাজের জন্য অনন্তকাল ধরে শাস্তি ভোগ করতে হবে। কাজেই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তাকে উপস্থিত সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। হয়তো দেখা যাবে তার এই সাময়িক সমস্যা পরবর্তীতে তার জন্য কল্যাণই বয়ে আনবে।
লেখক : রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঋষি মেধসের আশ্রম
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বনন্দিত বাঙালি বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলাম