বাসে করে ঢাকা যাচ্ছি। কুমিল্লা যাওয়ার পর দেখি রাস্তার দুই পাশে প্রচুর জ্যাম। কোন গাড়ি নড়ছে না। ঘন্টা দুয়েক বসে থাকার পর গাড়ি আস্তে আস্তে চলা শুরু করলো। প্রায় ২০ কিলোমিটার বিস্তৃত জ্যাম। এই বিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে আরো আড়াই তিন ঘন্টা চলে গেল। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ঢাকা অভিমুখী একটি ট্রাক এঙিডেন্ট করে রাস্তার উপর উল্টে গেছে, ফলে ঢাকামুখী রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পিছনের গাড়ি জ্যামে পড়েছে। জ্যাম দীর্ঘ হওয়ায় পিছনের কিছু গাড়ি উল্টো পথে ঢুকে ঢাকার দিকে এলোপাতাড়ি রওনা হয়। পরবর্তীতে উল্টোমুখি গাড়ির সাথে মুখোমুখি হওয়ায় সেই রাস্তাটিও বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে দু’দিকের রাস্তাতে গাড়ি মুখোমুখি হয়ে যাওয়ায় উভয় দিকের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। পরে হাইওয়ে পুলিশ এসে চট্টগ্রামমুখী রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে সিঙ্গেল লাইনে গাড়ি চলাচল শুরু করান। প্রায় পাঁচ ঘন্টা পর এঙিডেন্ট করা ট্রাকটি সরানো হলে আবার দুই রাস্তায় গাড়ি চলাচল শুরু হয়। যদি উল্টোমুখী রাস্তায় প্রথম হতে সিঙ্গেল লাইনে গাড়ি চলতো, তবে এতো লম্বা জ্যাম হতো না বা এতো দীর্ঘ সময়ও অপেক্ষা করতে হতো না।এই যে রাস্তায় এতো বিচ্ছৃঙ্খলা- এটার জন্য দায়ী বাস ট্রাকের ড্রাইভার। যদিও তারা অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত। তাদের উপযুক্ত ট্রেনিং ও ট্রাফিক আইনের অজ্ঞতার অভাবে তারা এমনটা করে। কিন্তু আমরা যারা উচ্চ শিক্ষিত মানুষ, তারাও রাস্তায় জ্যাম দেখলে উল্টো পথে গাড়ি চালাই এবং অনেকক্ষেত্রে সাইরেন বাজিয়ে চলি। কেউ বাধা দিলে তাকে ধমক ও ক্ষমতা দেখাই। আর জনপ্রতিনিধি হলে তো কথা নাই। পারলে মানুষের গায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিই। তাহলে প্রশ্ন হলো, সেই অশিক্ষিত মূর্খ ড্রাইভারের সাথে আমাদের মত উচ্চ শিক্ষিত মানুষের তফাৎটা কোথায়?
ধরুন, কোন ব্যাংকে টাকা তুলতে গেলাম। দেখলাম কাউন্টারে ৫-৬ জনের সিরিয়াল। ভাবলাম আমি এতো পাওয়ারফুল ও ধনাঢ্য মানুষ, লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা তুলবো, এটা কিভাবে হয়! তাই লাইন বাইপাস করে টাকা তুললাম বা ম্যানেজারের রুমে বসে টাকা উঠালাম। এ ক্ষেত্রে আমার শিক্ষা বা বিবেক কাজ করলো না। আবার ধরুন কোথাও কোন জিনিসপত্র কিনতে গিয়েছি, সেখানে লাইন ধরে জিনিস কিনতে হবে। আমি অনেক প্রভাবশালী মানুষ, লাইন ধরে জিনিস কিনবো? প্রেস্টিজে লাগে, তাই লাইন ছাড়া সবার আগে গিয়ে জিনিস কিনি। কেউ কিছু বললে আমার সাথে থাকা আমার লোকজন তাকে অপদস্ত করবে। নিজেকে এলিট শ্রেণীর মানুষ ও নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য আমরা এগুলো করি। অথচ বিশ্বের সেরা ধনী বিল গেইটস লাইন দিয়ে জিনিস কিনলেও তাঁর প্রেস্টিজে লাগে না। কারণ তিনি নিজে ভদ্র ও ভদ্র সমাজে বসবাস করেন। নিজেরা নিয়ম মানেন এবং অন্যকে মানতে উৎসাহিত করেন।
এবার ধরুন আমি কোন অফিসের মধ্যম শ্রেণীর এক জন কর্মকর্তা। উপরি বা ঘুষ আদায়ের জন্য আমি একজনের কাজ সময়মতো করছি না বা করতে গড়িমসি করছি। তিনি গিয়ে আমার উপরস্ত কর্মকর্তাকে বললেন। আমার বসের চাপে আমি কাজটি করে দিলাম, কিন্তু মনে মনে ক্ষুব্ধ হলাম। আবার কখনো যদি সেই লোকটি আমার কাছে কোন কাজে আসে, তবে তার থেকে আগের পাওনাসহ সুদাসলে ঘুষ আদায় করলাম এবং আরো বেশি সময় ঘুরালাম। অথচ এই আমি কোথাও কোন কাজে গেলে সেখানে আমার কাজটি ঘুষ ছাড়া দ্রুত ও নির্বিঘ্নে করে আসতে চাই। অর্থাৎ আমি কাউকে সার্ভিস দেওয়ার সময় সৎ না হলেও সার্ভিস নেওয়ার সময় অন্যের থেকে সততা প্রত্যাশা করি।
আবার, মনে করুন আমি একজন জনপ্রতিনিধি, এলাকায় আমার থেকে আমার দলের অন্য একজনের জনপ্রিয়তা, শক্তি ও লোকবল বেশী। আমি এটা কখনো সহ্য করবো না। যত ভাবে তাকে অপদস্ত করা যায়, তার সব চেষ্টা আমি করবো। প্রয়োজনে দলের ভিতরে তার গ্রহণযোগ্যতা কমানোর জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করবো। আমার পরিবারের লোকজন যোগ্য হোক বা না হোক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর ব্যবস্থা করবো, যাতে আমার পরে আমার পরিবারের লোকজন ছাড়া অন্য কেউ দলের পদে আসতে না পারে।এই বিষয়টাতে কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র আমাদের দেশের পীরদের চরিত্রের মত। পীরের ইন্তেকালের পর যেমন তাঁর ছেলেই পীর হয়। ঠিক রাজনৈতিক নেতাদের মৃত্যুর পর তাঁদের পরিবারের লোকজন তাঁর জায়গায় অধিষ্ঠিত হয়, অন্য কেউ নয়। এক্ষেত্রে একমাত্র যোগ্যতা মৃত ব্যক্তির সন্তান। খেয়াল করলে দেখবেন, দেশ এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের দখলে আছে। তাঁরা হচ্ছেন রাজা আর সাধারণ জনগণ হচ্ছে প্রজা।
আমাদের দেশে প্রতিটা রাজনৈতিক দলে প্রচুর সৎ, যোগ্য, ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক নেতা ও কর্মী রয়েছে। যারা শত দুঃখ কষ্ট অত্যাচার সহ্য করেও সেই দলের আদর্শ ধরে রাখেন। কিন্তু দলের সুদিনে তাঁদের মূল্যায়ন করা হয় কদাচিৎ। দলের বিভিন্ন পদে মনোনয়নের সময় তাঁদেরকে বিবেচনায় নেয়া হয় না। ব্যতিক্রম বাদে। দেখবেন অনেকে উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো, দলে যোগ দিয়েই মনোনয়ন পেয়ে যান। আর আমরা সাধারণ জনগণও ভোট দেওয়ার সময় দলের মার্কা দেখে ভোট দিই বা সাপোর্ট করি। যদি আমরা বিবেক চালিত হয়ে ভাল ত্যাগী মানুষকে ভোট দিই তবে রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্র পরিবর্তন হতে বাধ্য। কিন্তু সেই দিকে আমরা সাধারণ মানুষেরা যাই না। যা পরবর্তীতে আমাদের জন্যই কাল হয়ে দাঁড়ায়। আর একটি বিষয়, দেশ এখন রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। হয় আমাকে এ দল করতে হবে না হয় বি দল করতে হবে। কোন অবস্থাতেই নিরপেক্ষ থাকতে পারবো না। ঠেলে আমাকে যে কোন এক দলে ফেলে দেয়া হবে।এই যে ঠেলাঠেলির প্রবণতা, এর পরিণাম যে ভয়াবহ তা আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতারা বুঝতে চান না। আবার আমি যে দলকে সাপোর্ট করি সেই দলের খারাপ কোন কার্যক্রম আমার চোখে পড়ে না। আমার ব্যক্তিগত সমালোচনা আমি সহ্য করলেও আমার সাপোর্ট করা দলের সমালোচনা আমি সহ্য করি না। প্রয়োজনে সমালোচকের সাথে সম্পর্ক ছেদ করি।
আমাদের দেশে আইনের কোন অভাব নাই। অভাব হচ্ছে প্রয়োগের। এতো আইন থাকলেও আমরা আইনের ফাঁকফোকর বেশী খুঁজি ও আইন অমান্য করতে বেশী পছন্দ করি। আপনি আপনার আশেপাশে তাকালেই দেখবেন প্রতিনিয়ত কি হারে আমরা আইন অমান্য করছি। এই যে আইন অমান্যের প্রবণতা, এটা হলো আমাদের সহজাত অভ্যাস। জিনগত সমস্যার জন্য আমরা সবসময় আইন অমান্য করি। একটু ভেবে দেখুন, আমাদের প্রপিতামহ বা তাঁর বাবা কি ছিলেন। হয়ত মূর্খ, অশিক্ষিত, লেস স্ট্যাটাসের কোন মানুষ ছিলেন, যারা যুগ যুগ ধরে অন্যের দ্বারা শোষিত ছিল।
এই জন্য তাদের মনে তীব্র ক্ষোভও ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি দেশ পেলেও সেই জিনগত সমস্যার কারণে আমাদের অভদ্রতা থেকে যায়। অন্যদিকে এই স্বাধীন দেশে যখন কিছু মানুষ আক্রমণাত্মক ও নেতিবাচক আচরণ করে সমাজে বিত্ত বৈভবের মালিক হয় ও এলিট শ্রেণীর মর্যাদা লাভ করে, তখন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আক্রমণাত্মক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সেজন্য আমরা এখন এত আক্রমণাত্মক, এত অসৎ, এত অস্থির, এত একরোখা ও এত অবলীলায় মিথ্যা বলতে পারি। এই যে অভদ্রতা ও একরোখা মানসিকতা, এর থেকে দ্রুত বের হতে না পারলে উন্নত জাতি হিসাবে আমরা কখনো বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক