শুনলে অবাক হবেন অনেকেই। কেননা আইনে কোর্ট ম্যারেজ বলে কিছু নেই। এটি একটি লোকমুখে প্রচলিত কথা। এমনকি আদালতে কোর্ট ম্যারেজ করানোর জন্য সরকার কর্তৃক কোনও অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়নি। নোটারী পাবলিক কিংবা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বর ও কনের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে হলফ করে ঘোষণা দেওয়ার নামেই এফিডেভিট। এটাকে সচারাচরভাবে সবাই -‘কোর্ট ম্যারেজ’ বলে থাকেন। অনেক টন্নি টাউট হাজার টাকা সংশ্লিষ্টদের থেকে হাতিয়ে নেয়। অথচ নোটারীকৃত হলফনামাতেই উল্লেখ থাকে কাবিন রেজিঃ এর কথা। প্রতারণা রোধে বর্তমানে ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়গণ এধরনের হলফনামা বন্ধ করে দিয়েছেন। মুসলিম আইনে বিবাহ অত্যন্ত সহজ । যে কোন সুস্থ সাবালক (মেয়ে ১৮ বছর, ছেলে ২১ বছর) যুবক যুবতী দুই জন পুরুষ বা একজন পুরুষ দুইজন মহিলাকে সাক্ষী রেখে তাদের মোকাবিলায় ইজাব কবুলের মাধ্যমে বিবাহ করতে পারে। এ ধরনের বিয়ের কাবিন রেজিস্ট্রি করতে নিকাহ রেজিস্ট্রার আইনত বাধ্য। সাবালক ও সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন মুসলিম স্বেচ্ছায় বিয়ে করতে পারেন, তবে বিশেষ প্রয়োজনে নাবালকের ক্ষেত্রে আদালত ও অভিভাবক এর অনুমোদন আবশ্যক। পারিবারিক আইন অনুযায়ী বিয়ে না করে শুধু এ হলফনামা সম্পন্ন করা উচিত নয়। অনেক সময় বিয়ের হলফনামায় বিয়ের জন্য আইন অনুযায়ী প্রযোজ্য শর্তগুলো না মেনেই হলফ করা হয়, বিশেষত সাক্ষীদের উপস্থিতি ছাড়াই। এতে বিয়ের হলফনামাটি পরিপূর্ণ হবে না। ছেলে ও মেয়েকে অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে বর কনের বয়স ২১ ও ১৮ না হলে এফিডেফিটের মাধ্যমে বয়স বাড়িয়ে কৌশলে বাল্যবিবাহের অনুষ্ঠান করা হয়। মুসলিম বিয়ে ও তালাক (নিবন্ধন) আইন অনুযায়ী, প্রতিটি বিয়ে অবশ্যই নিবন্ধন করতে হবে। ছেলে মেয়ের নাম, কোন তারিখে, কোন জায়গায়, কত টাকা দেনমোহর ধার্য্য, কী কী শর্তে বিয়ে সম্পন্ন হলো, কে বিয়ে পড়ালো, সাক্ষী ও উকিলের নাম প্রভৃতির একটা বর্ণনা (সাক্ষ্য) প্রমাণ হিসাব সরকারি নথিতে লিখে রাখাই হলো নিবন্ধন। নিকাহনামা বা কাবিননামা ছাড়া বিয়ে প্রমাণ করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিয়ে নিবন্ধন করা থাকলে তালাকের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা সহজ হয়। স্ত্রীর দেনমোহর ও ভরণপোষণ আদায়ের জন্য কাবিননামার প্রয়োজন হয়। সন্তানের উত্তরাধিকার নির্ণয় ও সন্তানের বৈধ পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য কাবিননামার প্রয়োজন হয়। কাবিননামা ছাড়া শুধু বিয়ের হলফনামা সম্পন্ন করা হলে বৈবাহিক অধিকার আদায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের আইন-আদালত সম্পর্কে যাদের ধারণা কম তাদের এই লেখা কাজে আসতে পারে। আর এই লেখার উদ্দেশ্য পালিয়ে বিয়ে করতে উৎসাহিত করা নয়, বরং পালিয়ে বিয়ে করার পর আইনি ঝুঁকির বিষয়ে সাবধান করা। পালিয়ে বিয়ে করতে গেলে আপনাদের, মুসলিম ছেলেমেয়েদের অনেকের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। যেমন- বিয়ের পরে কোনো সমস্যা হবে না তো বা বিয়েটার বৈধতা কেমন হবে। বিয়েটাই বা কোথায় করতে হবে? কোর্টে নাকি কাজী বা নিকাহ রেজিঃ অফিসে? বিশেষ করে ছেলেরা ভাবে- মেয়ের বাবা যদি মামলা করে দেয় অপহরণ ও নারী নির্যাতনের? তাহলে কি জেল খাটতে হবে? ইত্যাদি। অনেকে ভাবেন-এসব ক্ষেত্রে হয়ত কোর্ট ম্যারেজ করতে হবে। বর্তমান আইন অনুযায়ী বিয়ে নিবন্ধন করানোর দায়িত্ব মূলত বর এর। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে বিয়ে নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। অন্যথায় নিকাহ রেজিঃ বা কাজী ও পাত্রের দুই বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা তিন হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় ধরনের সাজার বিধান রাখা হয়েছে। যে ক্ষেত্রে কাজি বিয়ে পড়িয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে কাজি তাৎক্ষণিকভাবে বিয়ে নিবন্ধন করবেন।
বর্তমানে হিন্দু বিবাহ ও রেজিস্ট্রি করা যায়, তবে এটা বাধ্যতামূলক নয়। তবে বিবাহ রেজিস্ট্রির সুফল ইতিমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। এতে নানা ধরনের বৈবাহিক প্রতারণা রোধ করা সম্ভব। দাম্পত্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, সন্তানের বৈধতা, অভিভাবকত্ব, ভরণপোষণ, উত্তরাধিকার নির্ণয়, বিদেশ গমন, নাগরিকত্ব ইত্যাদির জন্য বিবাহ রেজিস্ট্রেশন খুবই জরুরি। খ্রীষ্টানদের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়, খ্রীষ্টান ম্যারেজ এ্যাক্ট ১৮৭২ এর বিধান মতে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় আইনে কোর্ট ম্যারেজ বলে কিছু নেই। সাবালক ছেলে মেয়ে পরস্পর বিয়ের সহজ পদ্ধতি হল ইজাব কবুল, আক্দ, সাক্ষ্য সাবুদ সহ বিবাহ রেজিস্ট্রেশন, তবে এই ক্ষেত্রে এক স্ত্রী বা এক স্বামী বহাল থাকার বিষয় তথ্য গোপন রেখে বিবাহ রেজিস্ট্রি করলে সংশ্লিষ্টরা শাস্তি পাবেন। নাবালকের বিয়ের ক্ষেত্রেও বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন প্রয়োগ হবে ।
দু’ধর্মের ব্যক্তি ও ব্যক্তিনীর মধ্যে বিবাহ হয় কি : এক পক্ষ হিন্দু বা মুসলিম কিংবা অন্য ধর্মের হলেও, ধর্ম পরিবর্তন না করেই বিয়ে করার নাম স্পেশাল ম্যারেজ। ধর্ম এটাকে সমর্থন না করলেও আইনে তার বিধান রয়েছে, আর তা হয় স্পেশাল ম্যারেজ এ্যাক্ট-৩ অফ ১৮৭২ এর আওতায়। এর জন্য কাজীর মত আলাদা স্পেশাল ম্যারেজ রেজিস্ট্রার আছেন। আইনে এই বিয়ে অবৈধ নয়, এই বিয়ে বৈধ।
পরিবারের অমতে বিবাহ করার পর মামলা হয় কি ঃ- মা-বাবা বা অভিভাবকের অমতে বিয়ে হয়ে গেলে অনেক সময় পরে দুই পক্ষের বাবা-মা মেনে নেন, অনেক সময় মেনে নেন না। কখনো কখনো মেয়ের বাবা ক্ষেপে গিয়ে ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করে বসেন। মামলাগুলো হয় সাধারণত অপহরণপূর্বক ধর্ষণের। এই মামলাগুলোর জামিন বা রিমান্ড শুনানি এবং বিচার হয় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। মামলার ধারাগুলো জামিন-অযোগ্য এবং আমলযোগ্য বিধায়, পুলিশ এসব ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট বা আদালতের অনুমতি ছাড়াই আসামিকে গ্রেফতার করতে পারে। পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে হয়তো প্রথমেই জামিন হবে না। আর মানসিকভাবে শক্ত থাকুন, দুজনেই। মামলা (উক্তরূপ) হওয়ার পর তদন্ত শুরু হবে। ভিকটিমের (মেয়ের বাবার চোখে মেয়েটি এখানে ভিকটিম) জবানবন্দি দিতে হবে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। এটি ২২ ধারার জবানবন্দি, ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ের চেম্বারে হয়। কেউ কোনো প্রভাব খাটাতে পারে না। জবানবন্দিতে মেয়েকে বলতে হবে, আমি সাবালক, আমি স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছি। আমাকে কেউ অপহরণ করেনি। ব্যাস, তাহলে মামলায় পুলিশ আর চার্জশিট দেবে না। আসামি (ছেলে) অব্যাহতি পাবে। চার্জশীট দিলেও আদালতে ভিক্টিমের সাক্ষ্যের মূল্য অনেক বেশি ।
বিয়ের খরচ কত হবে ঃ- বিয়ে খুবই সহজ একটি বিষয়। কাবিন নামার ক্ষেত্রে খরচ যেকোনো বিয়ের ক্ষেত্রে একই। মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে একজন বিবাহ রেজিস্ট্রার দেনমোহরের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে একটি বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের ফি নির্ধারণ করে থাকেন। ধার্য্যকৃত দেনমোহরের প্রতি হাজার বা তার অংশবিশেষের জন্য ১০ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি। তবে রেজিস্ট্রেশন ফি এর পরিমাণ ১০০ টাকার কম হবে না এবং ৪০০০ টাকার উপরে হবে না। যেমন : কারো বিয়ের দেনমোহর ১০,০০০ টাকা হলে ফি হবে ১০০ টাকা, ১০,৫০১ টাকা হলে ১১০ টাকা (প্রতি হাজারের অংশবিশেষের জন্যও ১০ টাকা), ১১,০০০ টাকা হলেও ১১০ টাকা, দেনমোহরের পরিমাণ ৫০০,০০০ টাকা হলেও ৪০০০ টাকা (সর্বোচ্চ পরিমাণ ৪০০০ টাকা) আবার দেনমোহর ১০০০ টাকা হলেও ফি দিতে হবে ১০০ টাকা (যেহেতু সর্বনিম্ন পরিমাণ ১০০ টাকা)। উল্লেখ্য রেজিস্ট্রেশন ফি পরিশোধের দায়িত্ব বরপক্ষের। যদিও বা আমাদের দেশে তা কনে পক্ষের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় । উপোরক্ত আলোচনা থেকে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম বিয়ের সহজ পদ্ধতি সম্পর্কে । আর ‘কোর্ট ম্যারেজ’ বলে কোনো বিয়ে নেই ।
লেখক : আইনজীবী, মানবাধিকার সংগঠক ও সুশাসনকর্মী, কলামিস্ট ।