দূরের টানের বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কোলকাতায় আমাদের সময় ফুরিয়ে আসছে। দেশের পথে যাত্রা করতে হবে আমাদের। শেষমুহুর্তে ব্যাগ গুছিয়ে নেয়ার কাজ করছেন আমাদের দলের সকলে। বাজার সদাই যা করা হয়েছে তা ঠিকঠাকভাবে নেয়া হয়েছে কিনা, ব্যাগের ওজন বেড়ে যাচ্ছে কিনা, হ্যান্ড লাগেজের কি অবস্থা ইত্যাদি নানা যোগ বিয়োগ করে ফেরার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। আমাদের ফ্লাইট বিকেলে। পুরো সকাল এবং দুপুর হাতে রয়েছে। ইচ্ছে করলে নিউমার্কেটে চক্কর দেয়া যায়, ইচ্ছে করলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গিয়েও হাওয়া খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। রুমেই সময় কাটাচ্ছিলাম।
টিভি দেখছিলাম। দেশে যেসব চ্যানেলে সিনেমা দেখি, খেলা দেখি, সেসব চ্যানেল ভারতে বসে দেখার তৃপ্তিটা একটু মনে হলো আলাদা। মনে হচ্ছিল হোটেল থেকে রাস্তায় নামলেই দেখা হয়ে যাবে অভিনেতা অভিনেত্রীদের সাথে। ক্রাইম পেট্রোলের দারুণ বুদ্ধিমান মানুষগুলোর সাথেও মোলাকাত হয়ে যেতে পারে! হোটেল গ্র্যান্ড ওয়েবয়ের রুমের ঢাউশ সাইজের টিভিতে ঝরঝরে ছবি, একেবারে তকতকে। দীপিকা পাড়ুকুনের একটা সিনেমা পেয়ে গেলাম। ভীষণ নাচানাচি চলছিল, মনে হয় মারধরের ব্যাপার স্যাপারও থাকবে। দীপিকার গালের টোল বরাবরই আমাকে মুগ্ধ করে, ভালো লাগে। আমি চ্যানেল টিপাটিপি না করেই সিনেমাটি দেখতে লাগলাম।
কিন্তু হঠাৎ আমার খেয়াল হলো কোলকাতাতো আমাদের একেবারে পাশেই। দেখিতো বাংলাদেশের কোন চ্যানেল ঝিরঝির করে হলেও আসে কিনা। একসময় তারা আমাদের নাটকের দারুণ ভক্ত ছিল। নানা কসরত করে বিটিভির নাটক নাকি দেখা যেতো। এখনকার অবস্থা কি! দীপিকাকে বাদ দিয়ে আমি একের পর এক চ্যানেল টিপতে শুরু করলাম। না, কোথাও কোন বাংলাদেশী চ্যানেলের নাম গন্ধ নেই। আমাদের ত্রিশটিরও বেশি চ্যানেলের একটিও দেখতে পেলাম না। ভারতে বাংলাদেশী কোন চ্যানেল দেখানো হয় না তা জানি, কিন্তু কোলকাতা প্রতিবেশি শহর হওয়ায় কিছুটা আশা ছিল যে হয়তো ছিঁটেফোটা কিছু একটা দেখা যাবে। নিদারুণভাবে আশাহত হলাম। ভারতের এতগুলো চ্যানেল আমরা দেখি, অথচ ভারত আমাদের একটি চ্যানেলও দেখায়না। ব্যাপারটি কেমন যেন লাগলো!
আমার মন খারাপ হয়ে গেল। দীপিকার টোল আর আমাকে টানছিল না। টিভি বন্ধ করে দিলাম। স্ত্রী ব্যাগে নানা জিনিসপত্র ভাঁজ করছিল। তাকে সহায়তা করতে হাত বাড়ালাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের সবকিছু গুছানো শেষ হয়ে গেল। এডিটর স্যারকে ফোন করলাম। ইন্টারকমে না করে মোবাইলেই করলাম। আমার মোবাইলে অনেক ব্যালেন্স রয়ে গেছে। এগুলো শেষ না করলে বিমানে চড়ার সাথে সাথে ‘অচল’ হয়ে যাবে। তার থেকে এদিক ওদিক কথা বলে শেষ করে দেয়াই ভালো। এডিটর স্যার বললেন যে তিনি রুমেই আছেন। বের হবেন না। স্যার আমাকে বললেন, একটু আর্লি লাঞ্চ সেরে এয়ারপোর্টে চলে যাবো। রাস্তার যানজটের যেই অবস্থা তাতে একটু আগে ভাগে বের হওয়াই ভালো। আমিও স্যারের কথাই সায় দিলাম। ফোন করে লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া এবং লায়ন নিশাত ইমরানকেও একইভাবে তৈরি হওয়ার জন্য বললাম। কোলকাতায় আজাদী পরিবারের সবচেয়ে আপনজন হচ্ছেন সুশান্ত বাবু দাদা এবং ডালিয়া বৌদি। অত্যন্ত প্রাণবন্ত এবং সজ্জন এক দম্পতি। আমার স্যারের পারিবারিক বন্ধু। কোলকাতায় এসেছি পর্যন্ত উনারা কতভাবে যে আমাদের সময় দিয়েছেন, খাইয়েছেন তার কোন ইয়ত্তা নেই। আমরা এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে কখনো কখনো তাঁদের থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও ঠিকই গভীর রাতে কিংবা সকালে তাঁরা আবারো আমাদের সাথে একাকার হয়েছেন।
আজ আমাদের বিদায়কালেও সুশান্ত বাবু এবং ডালিয়া বৌদি হোটেলে এসে স্যারের রুমে আড্ডা দিচ্ছেন। তাঁরা আমাদের সাথে এয়ারপোর্টেও যাবেন। কোলকাতার মানুষজনকে নিয়ে নানা ধরনের গল্প চালু থাকলেও সুশান্ত বাবুর পরিবারে তার ছিটেফোঁটার মিলও কোনদিন দেখিনি। নিজেদের বেড রুম ছেড়ে দিয়ে অনাত্মীয় এই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেয়ার নজিরও তাঁরা দেখিয়েছেন। খাইয়েছেন বাড়িতে, ক্লাবে, রেস্তোরাঁয়।
মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্ত্রীর গুতোয় ঘুম ভাঙলো। বললো, স্যার ফোন করেছেন। লাঞ্চ করে ফেললে ভালো হবে বলে জানালেন স্যার। বললেন, ‘আমরা ১টার মধ্যেই চেক আউট করে ফেলবো।’ রেস্তোরাঁয় গিয়ে সকলে মিলে লাঞ্চ করলাম। বিদায়বেলার লাঞ্চ। তেমন একটা প্রাণ ছিল না। খেতে হবে বলে খাওয়া। খাওয়া দাওয়া সেরে রুমে ফিরেই আবারো নিচে নামলাম। লবিতে গিয়ে চাবি জমা দিয়ে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে নিলাম। কিছুটা বাড়তি সময় লাগলেও একটি নিদারুণ ঘটনা থেকেই জীবনে একটি শিক্ষা পেয়েছিলাম আমি। তাই হোটেল থেকে চেকআউট করার সময় বাড়তি এই সতর্কতা।
একবার গ্রামীণ টেলিকম আমাকে প্যারিস নিয়ে গিয়েছিল। মারকিউর নামের অভিজাত এক হোটেলে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সপ্তাহ খানেক বেশ আরামে ছিলাম। ফেরার সময় রিসিপশনে চাবি (প্লাস্টিক কার্ড) জমা দিয়ে, রুমের ফ্রিশ থেকে খাওয়া এক প্যাকেট চিফস, বাদাম এবং এক বোতল পানির বিল পরিশোধ করে কি বুঝে যেন একটি ক্লিয়ারেন্স নিয়েছিলাম। কাগজটি বেশ অনাদরে পড়েছিল আমার হ্যান্ডব্যাগে।
প্যারিস থেকে আমি চলে গিয়েছিলাম লন্ডন। সেখানে বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে একের পর এক ফোন করে আমাকে না পেয়ে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার এবং হোয়াটস আপে ম্যাসেজ দিয়ে রাখে স্ত্রী। যেন ম্যাসেজ দেখার সাথে সাথেই ফোন করি। ম্যাসেজ দেখে কলজে মুছড়ে উঠেছিল। ফোন করে যা জানলাম তাতে আমার অন্তর শুকিয়ে গেল। স্ত্রী বললো, এখনি গ্রামীণ টেলিকমে ফোন করো। তুমি নাকি প্যারিসের হোটেলে কি এক গোলমাল বাঁধিয়ে এসেছো! আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। আমি গ্রামীণ টেলিকমের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে ফোন করলাম। তিনি আমাকে জানালেন যে, হোটেল মারকিউর থেকে গ্রামীণ টেলিকমের কাছে সাতদিনের এঙট্রা টাকা দাবি করে মেইল করা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে যে, ‘আমি কাউকে কিছু না বলে রুম লক করে চলে গেছি। চাবি জমা দিইনি। এতে করে তারা সাতদিন রুম খোলেনি। এই সাতদিনের ভাড়া পরিশোধ করতে হবে।’ আমার মনে হলো বিষয়টি টাকার চেয়ে ইজ্জতের। এটি শুধু আমারই ইজ্জত নয়, সাংবাদিক সমাজের ইজ্জত। আরো একটু বড় পরিসরে ভাবলে আমার দেশের ইজ্জত। গ্রামীণ টেলিকমের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে আমি বললাম, ‘আমি চাবি জমা দিয়েছি এবং কিছু খাবারের টাকা পয়সা পরিশোধ করেই রুম ছেড়ে এসেছি।’ কিন্তু ওই কর্মকর্তা আমাকে বিশ্বাস করলেন। বললেন, আপনার মতো একজন মানুষ এমনটি করতে পারেন না। সেটি আমি বুঝি। কিন্তু তাদেরকে প্রমাণ না দিলে তো তারা বিশ্বাস করবে না। কথাটির যুক্তি আছে। প্রমাণ দিতে হবে। কিন্তু কাগজটি কি আমি ব্যাগে নিয়েছিলাম? আমি তন্ন তন্ন করে ব্যাগের ভিতরে কাগজটি খুঁজতে লাগলাম। অনেক কাগজ, অনেক স্যুভেনির। বহু কাগজের ভিতর থেকে দুমড়ানো অবস্থায় হোটেল মারকিউরের প্যাডে দেয়া ক্লিয়ারেন্সটি পেয়ে গেলাম। আর্কিমিডিস তাঁর সূত্র আবিষ্কার করে এমন করে ইউরেকা বলেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু লন্ডনে ওই সময় আমার মনে হয়েছিল দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটি আমি হাতে পেয়েছি। আমার বুকের উপর থেকে কত বড় একটি বোঝা যে সরে গিয়েছিল তা কাউকে বলে বুঝানো কঠিন। আমি কাগজটির ছবি তুলে হোয়াটস আপে পাঠিয়ে দিলাম এবং গ্রামীণের ওই কর্মকর্তাকে বললাম যে, তাদের কাছ থেকে ক্ষমা চাইয়ে তবেই ছাড়বেন। ওই রাতে কি যে স্বস্তির একটি ঘুম দিয়েছিলাম!
ওই ঘটনার পর থেকে দেশে বিদেশে কোথাও হোটেলে থাকলে চেক আউটের সময় আমি ক্লিয়ারেন্স নিয়ে নিই এবং বেশ যত্ন করে কয়েকদিন সংরক্ষণ করি। এর জন্য পাঁচ দশ মিনিট বাড়তি সময় লাগলেও অনেক স্বস্তিতে থাকি।
আমাদের গাড়ি ছুটছে। পাঁচটি গাড়ির বহর। আমরা ছুটছি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে। আমাদের প্রতি পরিবারের জন্য একটি করে গাড়ি দিয়েছে ট্যুর অপারেটর লায়ন আনোয়ারুল আজিম ভাই। বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়ার পরই এসব গাড়ি ছুটি পাবে। দারুণ একটি ট্যুর করে ফেললাম পাশের দেশে। সত্যি অসাধারণ ছিল আমাদের সব আয়োজন। গাড়িতে হেলান দিয়ে পুরো ট্যুর নিয়ে নানা কিছু ভাবছিলাম। হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম বর্ণিল সব স্মৃতি। কত কত কিছু যে দেখলাম। কতভাবে যে ভারত দেখা হলো। বহুবার ভারত বেড়ালেও এবার মনে হলো সবকিছু একটু অন্যরকম ছিল।
বিমানবন্দরে ব্যাপক কড়াকড়ি। ব্যাপক মানে ব্যাপক। এত ব্যাপক যে মাঝে মধ্যে হয়রানি বলে মনে হয়। এমন কড়াকড়ি মোকাবেলা না করলে ‘বিরক্তি’র কারণটা অনুধাবন করা কঠিন। অবশ্য গত কয়েকবছর ধরে বিশ্বব্যাপী বিমানবন্দরগুলোতে নিরাপত্তা তল্লাশির নামে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। জুতা-মুজা থেকে শুরু করে বেল্ট পর্যন্ত খুলে ফেলা হয়। সিনিয়র,জুনিয়র কোন সিটিজেনই বাদ রাখে না। কড়াকড়ির বাড়াবাড়িতে বিরক্ত লাগলেও কিছু করার নেই। আমাদের স্বার্থেই আমাদের সবকিছুই উলট পালট করে দেখা হয়!
ভালোয় ভালোয় আমাদের সব প্রস্তুতি সাঙ্গ হলো। ইমিগ্রেশনেও বাড়তি কোন প্রশ্ন করা হলো না। শুধুমাত্র ‘এক্সিট সিল’ দিয়ে পাসপোর্ট দিয়ে দেয়া হলো। আহা, আসার সময় কত ধরনের প্রশ্ন যে করা হয়! বিমানে চড়ে বসলাম। স্ত্রীকে জানালার পাশে দিয়ে আমি ‘আইল’ সিটে হেলান দিলাম। নির্দিষ্ট সময়েই আমাদের ফ্লাইট যাত্রা করলো। দেশের পথ ধরে আমাদের এয়ারক্রাফটি কেবলই উপরে উঠছিল।
লেখক: চীফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধআইনে কোর্ট ম্যারেজ বলে কিছু নেই
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ