ঢাকা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ইতিহাসবিদ ড. আব্দুল করিম তাঁর বইতে সুফিদের সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ও গবেষক মহলের দীর্ঘদিনের বদ্ধমূল ধারণাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন তাত্ত্বিক গবেষণার সুগভীর দৃষ্টিতে এটি বড় বেশি দিনের কথা নয়; সুফিদের সম্পর্কে বিদ্বৎ সমাজ ইতিহাসবিদ ও গবেষক মহলের এমন একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, চলমান সামজের সাথে এঁদের কোন সম্পর্কই নাই, এরা জাগতিক জীবনের অনেক উর্ধ্বে বহু উর্ধ্বে। এমনকি কেউ কেউ এ গুলোকে ঈশ্বর নিষ্ঠ প্রতারণা নামেও আখ্যায়িত করেছেন (মুসলমানদের সামাজিক ইতিহাস, ড. আবদুল করিম বাংলা একাডেমি, ঢাকা-১৯৯৩, )
* ঐতিহাসিক প্রেক্ষপটে নির্মোহ নৈব্যর্ত্তিক ভাবে বিচার বিশ্লেষণ করলে এতে যে, চিত্রটি ফুটে উঠেছে তা খণ্ডিত সত্য বলাবাহুল্য; পুরো সত্যটি হিমশৈলের মতো ৯০% অদৃশ্যই রয়ে গেছে। এ পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের অপ্রত্যাশিত গলদ হলো, সুফিবাদ সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানের অভাবে সুফিবাদ ও সুফিদের গুণগত ও মাত্রাগত অন্তর্নিহিত মৌলিক বিশেষত্বের বিপরীতে তাঁদের সম্পর্কে জনশ্রুতি নির্ভর ধারণা, বিশেষত: প্রকৃত সুফিদের বহুমাত্রিক সমীহ জাগানিয়া প্রবহমান অবদানকে পুঁজি করে (সুফি নামধারীদের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সর্বাধিক এবং তা নিয়েই হয়েছে যত মাতামাতি ভ্রান্তি বিলাসের কল্পকাহিনী।
* এ প্রচলিত ধারণার বিপরীতে এ ভূখণ্ডে সুফিদের প্রকৃতচিত্র তুলে ধরার এক অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন ড. মুহম্মদ এনামুল হক। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই পণ্ডিত গবেষক বাঙালি মনীষা ১৯৪০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তাঁর পিএইচডি থিসিসে (A History Sufism’s in Bengal) ব্যাপক ফিল্ডওয়ার্ক ও সু-গভীর তাত্ত্বিক গবেষণায় সু-সমন্বিত পর্যবেক্ষণ গবেষক ও বুদ্ধিজীবি মহলকে নতুন ভাবে গভীর ভাবে ভাববার অবকাশ তৈরি করে দিয়ে দিয়েছে সুগভীর তাৎপর্য পূর্ণভাবে They (Sufis) dedicated their livers for the cause of Islam and for the service of Mankind. (1975, P.-231)
* ড. এনামুল হকের এই প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চতর গবেষণায় দুটো বাস্তব সত্য ফুটে উঠেছে ১। They dedicated their live of The cause of Islam, উল্লেখ্য, মুসলিম অধ্যুষিত এই ভূখণ্ডে তাঁদের ডেডিকেট-এর ধরণ কি? এর গুণগত ও মাত্রাগত বিশেষত্ব কি এগুলো আজ গভীর গবেষণার বিষয়ে ও পরিগণিত উল্লেখ্য বৃহত্তর জন গোষ্ঠীরকে নিয়েই সমাজ ও রাষ্ট্রের যাবতীয় রসায়ন আবর্তিত ও বিবর্তিত।
২। “For the service of Mankind” এটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য আরো বেশি এবং বহু মাত্রিক। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকলকে আপন করে জড়িয়ে রেখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং চির কাঙ্ক্ষিত উন্নততর মানবিক সমাজ গঠনে সর্বজন শ্রদ্ধেয় সুফি সাধকেরা ফল্গুধারার মতো, মাটির মমতারসের মতো নীরবে নিভৃতে প্রবহমান ধারায় কি অমূল্য ভূমিকা রেখে চলেছেন তদবিষয়ে আমাদের জ্ঞানের (তত্ত্ব তথ্য ও বাস্তবতার সু-সমন্বয়মূলক) জগত বড়ই সীমিত ও সেকেলে। ফলে তাঁদের সামগ্রিক অবদানের বিষয়টি সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক মহল আমলে নেওয়ার প্রয়োজনীতাও অনুভব করে না। অথচ অভিধানের মতো এর ছত্রে ছত্রে লুকায়িত রয়েছে বহুমাত্রিক একান্ত জীবন ঘনিষ্ঠ সুগভীর তাত্ত্বিক গুণগত ও মাত্রাগত বিশেষত্ব সমূহ, যা অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ গঠনের ধারাকে ঋদ্ধ করে তোলে পলে পলে, অথচ একান্ত নীরবে নিভৃতে।
এ প্রসঙ্গে সুফিবাদের মৌলিক বিশেষত্ব বিষয়ে প্রয়োজনীয় কিছু ধারণা রাখা আবশ্যক। তাঁরা স্বয়ং স্রষ্টার পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে নির্ধারিত, নির্বাচিত এলাকায় সমাজের গণ-মানুষের মধ্যে অবস্থান করে তাদের অতি প্রয়োজনীয় ক্ষুধা নিবারণ ও অষ্টপ্রহর সুখ দুঃখের সাথী হয়ে তাদের আধ্যাত্মিক (ইনসানকে ইনসানে কামেলে উন্নীত করণ) ও জাগতিক সমস্যা সমাধানে কাজ করে চলেন অহোরাত্র।
এখানে প্রণিধানযোগ্য ভাবে যে বাস্তব অথচ অনালোচিত বিষয়টি সুস্পষ্ট করা দরকার তা হলো প্রকৃত সুফি সাধকেরা স্রষ্টার পক্ষ থেকে সরাসরি ক্ষমতা প্রাপ্ত বলে মৌলিকভাবে আধ্যাত্মিক বিষয়াদির পাশাপাশি জাগতিক সর্ববিষয়েও তাঁরা ওয়াকিবহাল থাকেন সদাসর্বদা। এমনকি রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে সামাজিক অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির ব্যক্ত-অব্যক্ত প্রতিটি অলি-গলি পর্যন্ত তাঁদের আধ্যাত্মিক নজরের আওতাধীন। কিন্তু এত ক্ষমতা ধারণ করা সত্ত্বেও স্রষ্টার সন্তুষ্টি এবং প্রাপ্ত দায়িত্ব পালনের কারণে তাঁরা এ গুলো থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেন সচেতনে সযতনে।
এ প্রসঙ্গে (ভারতের) রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল প্রশ্নে হযরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানীর অবিশ্বাস্য ঘটনা এবং শত শত বছর ধরে আধ্যাত্মিক সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তিতে খাজা আজমিরী ও সেলিম চিশতির কিংবদন্তীতুল্য অবস্থান এবং বাংলাদেশে হযরত শাহজালাল ও হযরত শাহ্ আমানত (রা.) এর অবস্থান অবিসংবাদিতভাবে স্মরণযোগ্য। ক্ষমতা দখল নয়, নীতিগত প্রশ্নে সম্রাট আকবর কর্তৃক অপমান জনকভাবে কারা নির্যাতন ভোগ, সামরিক বাহিনীতে তাঁর মুরিদানদের নেতৃত্বে সফল সামরিক অভ্যুত্থান, সেনা প্রধান কর্তৃক হযরত মোজাদ্দেস আল ফেসানীকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পরও তিনি সবিনয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নিজের খানকায় ফিরে যান সানন্দচিত্তে। প্রশ্ন উঠে কোন অদৃশ্য শক্তি বলে বলিয়ান হয়ে হযরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানী মোগল সাম্রাজ্যের সিংহাসন ত্যাগ করে নিজের খানকায় ফিরে গেলেন? রাষ্ট্র ক্ষমতা ও সুফিদের বিশেষত্বের এই সুক্ষম অথচ সুগভীর তাৎপর্য পূর্ণ অধ্যায়টি সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক মহলের রীতিমতো গবেষণার বিষয়ে পরিগণিত।
সময়ের প্রেক্ষাপটে বিংশ শতাব্দীতে এসে পরিবেশ পরিস্থিতি অনেক পাল্টিয়েছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালা বদলের সাথে পাল্লা দিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পাল্টানোর প্রতিযোগিতায় অগত্যা দুই মহান সুফিসাধক (হযরত শাহ জালাল, হযরত শাহ আমানত (র.) এর নামে নামকরণের মধ্যে ইতিহাসের শিক্ষণীয় বিষয় কিভাবে নিহিত তা গভীরভাবে পাট করা আবশ্যক।
তবে প্রকৃত সুফি সাধকদের অবিস্মরণীয় সুদূর প্রসারী বহুমাত্রিক অবদানের বিষয়গুলো অনুধাবনের ক্ষেত্রে সতর্কতা প্রসঙ্গটি রয়েছে মারাত্মক ভাবে। স্বঘোষিত ভেজাল সুফিদের অপ্রতিরোধ্য দৌরাত্ম্যর বিপরীতে হিম শৈলের মতো ৯০% অদৃশ্য প্রকৃত সুফিসাধকদের খুঁজে নেওয়া সত্যিই এক ধৈর্য্য, শ্রম ও নিষ্ঠাসাধ্য দুরুহ কাজ। এক্ষেত্রে মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমীর সতর্ক বাণী (আল্লামা রুমী, কেলীদে মসনবী, কলিকাতা ১৯৩০, পৃ:- ৭), সৈয়দ আমীর আলীর অভিজ্ঞতার কথা (The Spirit of Islam, 1923, P-77-78). আবুল মনসুর আহমদের “হুযুর কেবলা” গল্প এবং সুফি তত্ত্বের তাত্ত্বিক গবেষক A.J. ARBARY এর সুগভীর মর্মভেদী মন্তব্য (A JA ARBARY, SUFI ISM 1950, P-119) ইত্যাদি প্রণিধানযোগ্য ভাবে স্মরণীয়। তা না হলে বিচ্যুতির চোরাবালি ও চোরা গলিতে ঢুকে হাবুডুবু খেতে হবে। আসল সুফির সন্ধান থেকে যাবে অধরাই।
প্রকৃত সুফিসাধকদের কালের অগ্নি পরীক্ষায় চীনে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এক অগ্নিযুগের ঐতিহাসিক মাইল ফলক। ঢালাওভাবে ধর্মের নামে জালেম পাক হানাদার বাহিনীর দালালিতে অংশ গ্রহণ করে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে ধর্মীয় অঙ্গনে কলংকিত অধ্যায় রচনা করেছে, তার সম্পূর্ণ বিপরীতে সুফিসাধক এবং তাঁদের মাযার ও খানকাগুলো ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দিশেহারা মজলুম জনগোষ্ঠীর আত্মিক ও জাগতিক নিরাপদ আশ্রয় স্থল। সর্বোপরি সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়ারণ্য। এতে খানকার পীর ও সংশ্লিষ্টজনদের হানাদার বাহিনী ও তাদের দালালদের রোষানলেও পড়তে হয়েছে নানাভাবে। কালের কষ্টি পাথর হিসেবে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি জাগতিকভাবে জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলার সুফি সাধকদের মানবতাবাদী চরিত্রের এই অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টি তাত্ত্বিকভাবেও উচ্চতর ফ্রিলেন্স ও প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার বিষয়েও পরিগণিত হওয়ার দাবী রাখে। বলাবাহুল্য অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ গঠনের মৌলিক উপাদান হিসেবে যার গবেষণালব্দ উপাদানগুলো নিয়ামক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণেও।
আমার বিবেচনায় শুধু নিদান কালে সুফি সাধকদের স্মরণ নয়; কিংবা ভোটের সময় ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতা আকাঙ্ক্ষীদের সাড়ম্বর মাযার জিয়ারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে নিভিড়ভাবে বেষ্টন করে থাকা সুফি সাধকদের আধ্যাত্মিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিক প্রভাবগুলোর আশ্রয় নেওয়ার পাশাপাশি ভালো সময়ে (স্থিতিশীল অবস্থায়) সুফিসাধক ও তাঁদের খানকা কেন্দ্রিক সংস্কৃতির একান্ত জীবন ঘনিষ্ঠ প্রবহমান প্রভাবের বিষয়গুলো সুদীর্ঘ ইতিহাসের আলোকে জ্ঞানের জগতে তাত্ত্বিকভাবে গভীর থেকে গভীরতর পর্যায়ে গবেষণা করে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বৃহত্তর জনগগোষ্ঠীকে বেষ্টন করে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং সাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ গঠনের মৌলিক ভিত্তি ভূমি হিসেবে এ গুলোর অনিঃশোষিত তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাবে বিষয়গুলো যত কম সময়ে কার্যকরভাবে আমলে নেওয়া যাবে ততই মঙ্গল।
মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞানের জগতের এই বিষয়টি ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও সততার সাথে সু-সমন্বিত করে উপস্থাপন এবং একই সাথে পরীক্ষিত বিশেষজ্ঞ জনদের সহায়তা প্রয়োগ করতে পারলে তা শুধু আমাদের নয়, অন্যান্য দেশেও মডেল হিসেবে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করতে সমর্থ হবে। বিশ্বের বিস্ময় মাত্র ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নতুনভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে দৃষ্টি আকর্ষণীয় নতুন মাত্রিকতা নিয়ে। হয়ে উঠবে অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ গঠনের উন্নততর সৃজনশীল নান্দনিক নতুন মডেল।