-মা, তোমার হাতের আলুভর্তার কোনো তুলনা নেই। এটার কাছে মাংস ফেল।
মুখে বেশ খানিকটা আলুভর্তা ঢুকিয়ে আয়েস করে খেতে খেতে বললো আসিফ। মা সায়মা বেগম হাসিমুখে ছেলের খাওয়া
দেখছিলেন। মা খাচ্ছে না দেখে ছেলে তাড়া লাগালো
-মা,তুমি খাচ্ছো না কেন? খাও খাও।
ছেলের তাড়া পেয়ে মাও খেতে শুরু করেন। সায়মা বেগমের স্বামী থাকেন কাতারে। দুই তিন বছরে একবার দেশে আসেন। চট্টগ্রাম শহরের জলিলগঞ্জে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তিনি থাকেন।আসিফের বয়স যখন তিন বছর তখন তিনি গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে চলে আসেন। আসিফের বাবাও তাই চেয়েছিলেন। শহরে বাসা নিয়েই তিনি ছেলেকে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করে দেন। সেই শুরু। প্রথমদিকে তিনি ছেলেকে নিয়ে সাবলেটে থাকতেন। পরবর্তীতে এক একটি ধাপ পেরিয়ে ছেলে এমএসসি পাস করে এখন একটি বেসরকারি ফার্মে চাকরি করে। এখন অবশ্য তাঁরা আর সাবলেটে থাকেন না। দুই বেডরুম, ড্রয়িং, ডাইনিং মিলিয়ে চাররুমের বাসায় থাকেন। মা ছেলেতে দারুণ সদ্ভাব। যেখানেই যান মাছেলে একসাথেই যান। ছেলে অফিস থেকে ফেরার সময় মায়ের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসবেই। এ নিয়ে সায়মা বেগম খুব আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন। সায়মার ছেলের এমন মাপ্রীতি দেখে সায়মার বান্ধবীরা কেউ কেউ ঈর্ষাতেও ভোগেন। বান্ধবী বলতে সহপাঠিনী কেউ নন,আসিফের বন্ধুর মায়েরাই। অনেকবছর ধরে একসাথে সন্তান নিয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে তাঁরাই সব বান্ধবী হয়ে গেছেন। ছেলে চাকরি পাওয়ার পর থেকে সায়মা এখন ঘরে বৌমা আনার স্বপ্নও দেখছেন। কথাটা আসিফকে বলেছেনও কয়েকবার। আসিফ কোনো উত্তর দেয়নি, শুধু হেসেছে।
ভাত খাওয়া শেষ করে আসিফ মায়ের রুমে চলে যায়। এটা তার প্রতিদিনের অভ্যাস। রাতে ঘুমানোর আগে মায়ের সাথে কিছুক্ষণ গল্প না করলে রাতে তার ভালোমতো ঘুমই হয় না। বাসনপত্র তুলে রেখে, ডাইনিং টেবিল মুছে সায়মা বেগম এসে ঢোকেন নিজের রুমে। এ রুমে তিনি একলা থাকলেও বিছানায় বালিশ রাখা আছে দুটো। তার একটিতে প্রতিদিন এসে কতক্ষণ শুয়ে থাকে ছেলে। আজকেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। আসিফ বলে,
-মা, দেখো, মজার একটা ভিডিও।
-কিসের ভিডিও?
মা জানতে চান। আসিফ বলে,
-না দেখলে বুঝবে না। তুমি তাড়াতাড়ি আসো তো।
ছেলেকে খুশি করার জন্য সায়মা বেগম খাটে গিয়ে শুয়ে পড়েন। তারপর মা ছেলে একসাথে হাসির একটা ভিডিও দেখেন। বোম্বের নায়ক নায়িকাদের মুখে বাংলা সংলাপ দিয়ে তৈরি ওই ভিডিও মা ছেলেকে প্রচুর হাসায়। তারপর ছেলে উঠে পড়ে,বলে,
-মা, আমি গেলাম। তুমি ঘুমাও।
মা বলেন,
-তুইও দেরি করিস না। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়িস।
শুনে আসিফ খুব মিষ্টি করে হাসে, তারপর বলে,
-আমায় নিয়ে চিন্তা করো না তো। আজকে আমি এমন ঘুম দেবো না, তুমি অবাক হয়ে যাবে। আমার ঘুম দেখে তুমি হা করে তাকিয়ে থাকবে!
সায়মা বেগম হাসেন, বলেন,
-আচ্ছা যা, ঘুমা গিয়ে। দেখা যাবে কালকে কেমন ঘুমানো ঘুমাস!
ছেলে চলে গেলে লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে সায়মা বেগম শুয়ে পড়েন। কিন্তু কেন জানি আজ ঘুম আসছে না।এ পাশ ও পাশ করতে করতে রাত প্রায় শেষ। যখনি ঘুমটা একটু লেগে এলো তখনি চারপাশ মুখরিত করে ভেসে আসলো আযানের সুর। উঠে ওযু করে নামাজটা পড়ে নিলেন তিনি। তারপর আবার গাটা এলিয়ে দিলেন বিছানায়। দুচোখের পাতা ভারী করে নেমে এলো ঘুম।
হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গেলো সায়মা বেগমের। কী একটা দুঃস্বপ্ন দেখে বুকটা কেমন ধড়ফড় করছে। অভ্যাসবশত বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলেন কয়টা বাজে! এখনো সাড়ে ছয়টা। আরেকটু শুয়ে থাকা যাবে। কিন্তু প্রশ্রাবের বেগ পেয়েছে প্রচণ্ড। উঠে যেতে হবে। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও সায়মাকে উঠতে হয়। উঠে ওয়াশরুমে যান তিনি। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আবার শুয়ে পড়বে ভেবেও শোন না। এখন শুলে বিপত্তি ঘটবে। ছেলেটা অফিসে যাবে সাড়ে আটটায়। তার জন্য ভাত রাঁধতে হবে। চা বানাতে হবে। গতরাতের রান্না করা মাংস আছে। ওটা গরম করে দিলেই ছেলেটা ভাত খেয়ে অফিসে যেতে পারবে। এসব ভাবতে ভাবতেই সায়মা বেগম রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান।
রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের পানি চড়িয়ে চোখ যায় ছেলের রুমের দিকে। ছেলের রুমে লাইট জ্বলছে। নিশ্চয় কালকে রাতে মোবাইল টিপতে টিপতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আলসেমি করে লাইট নেভায়নি। ছেলেটাকে নিয়ে কী যে করবেন উনি। সারাক্ষণ মোবাইল টেপে। আগে টিপতো নাহয় ছাত্র ছিল,কিন্তু এখন তো চাকরি করে। এখনো কি সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে থাকবে সে! মনে মনে গজ গজ করতে করতে চা বানানোটা সেরে ফেলেন তিনি। তারপর চাউলটা ধুয়ে ভাত বসিয়ে দেন চুলায়। মোবাইলটা হাতে নিয়ে আবার দেখেন কয়টা বাজে। সাতটা দশ। ছেলেকে এখনি ডেকে দিতে হবে। ওর ঘরে যেহেতু লাইট জ্বলছে, বোঝাই যাচ্ছে কাল বেশি রাতে ঘুমিয়েছে।
ডেকচিতে চাউলগুলো টগবগ করে ফুটছে। চামচ দিয়ে কয়েকটা ভাত নিয়ে দেখেন সিদ্ধ ঠিকঠাক হয়েছে কিনা। একটু পরই মাড় ফেলে দিতে হবে। সায়মার মনোযোগ এখন পুরোটাই ভাতের দিকে।চাউলগুলো ভীষণ লাফাচ্ছে। উত্তপ্ত পানিতে তারা যেন যন্ত্রণায় কাতরিয়ে উর্ধ্বমুখী হয়ে নিস্তার চাইছে। সায়মা বেগম আগুনটা কমিয়ে দিয়ে দুই হাতে ডেকচির দুই পাশে ধরে নিপুণ ভঙ্গিমায় মাড়টা ঝরিয়ে নেন। তারপর ভাতের ডেকচিটা নামিয়ে নিয়ে চুলায় মাংসের বাটিটা তুলে দেন। এবার ছেলেটাকে ডেকে দিতে হবে। উঠে একটু চা খেতে চাইলে খেতে পারবে।
চুলার আগুনটা একটু কমিয়ে দেন তিনি,তারপর পা বাড়ান ছেলের রুমের দিকে।
রুমের দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়ে দরজাটা খুলে যায়। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাবার উপক্রম হয় তাঁর। প্রতিদিন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকে। দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে আসিফকে জাগাতে হয়। কাল দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে? কী করেছে কাল সারারাত ছেলেটা? দরজা বাঁধেনি,লাইট নেভায়নি। ভাবতে ভাবতেই তিনি রুমে ঢুকে পড়েন। তারপরই তাঁর চোখ যায় আসিফের দিকে। আসিফ সটান দাঁড়িয়ে আধ খোল চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। সায়মা বেগম প্রথমে বুঝতে পারেন না আসিফ এভাবে ঘরের মাঝখান সটান দাঁড়িয়ে আছে কেন? তিনি শুধু প্রথমে আসিফের দাঁড়িয়ে থাকাটাই দেখেছিলেন। আসিফের এমন করে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ খুঁজতে গিয়েই হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করলেন ফ্যান থেকে ঝুলানো লম্বা দড়িটা। কী আশ্চর্য! দড়িটা ফ্যান থেকে সোজা নেমে আসিফের গলাটায় পেঁচিয়ে আছে!
বিকট চিৎকার করতে গিয়ে সায়মা বেগম লক্ষ্য করেন তাঁর গলা দিয়ে একটু আওয়াজও বের হলো না। ছুটে গিয়ে তিনি আসিফকে জড়িয়ে ধরলেন। শক্ত,ঠাণ্ডা শরীর! তাঁর আসিফ গলায় দড়ি দিলো? কেন? হঠাৎ কী মনে হতেই সায়মা ছুটে যান রান্নাঘরে, তারপর ছুরি এনে আসিফের গলায় লাগানো ফাঁসটা কেটে দেন। পরম মমতায় ছেলেকে কোলে করে শুইয়ে দেন মেঝেতে। জিভটা খানিকটা বেরিয়ে এসেছে আসিফের। সায়মা আশেপাশে তাকান কোনো চিরকুটের সন্ধানে,কিন্তু কিছু চোখে পড়ে না। আসিফ কেন এমন করলো? কী কষ্ট ছিল ওর? কিছু জানালো না কেন সে মাকে? কালরাতে তো একবারও বুঝতে দিলো না ও এমন করবে। শুধু বলেছিল এমন ঘুমানো ঘুমাবে তিনি হা করে তাকিয়ে থাকবেন। কিন্তু কেন? কেন আসিফ এমন করলো? কিছু ভাবতে পারেন না সায়মা। মাংস পুড়ে যাচ্ছে রান্নাঘরে। গন্ধে টের পাচ্ছেন তিনি। কিন্তু তাঁর ছেলে কী কারণে তাঁকে ছেড়ে গেলো এ হিসাব তিনি মেলাতে পারেন না। ছেলের মাথাটা কোলে নিয়ে বসে থাকেন সায়মা বেগম। ততক্ষণে রান্নাঘরে মাংস পুড়ে পাতিলটাও পুড়তে শুরু করেছে।