পেশা তাদের সিএনজি টেক্সি চুরি। দেশব্যাপী রয়েছে নেটওয়ার্ক। চট্টগ্রাম থেকে ভোলা, নোয়াখালী থেকে লামা; বিভিন্ন এলাকাতে রয়েছে তাদের আস্তানা। ঘটনার পর আত্মগোপন কিংবা চোরাই মালামাল লুকিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয় এসব। চুরির পর মালিককে ফোন করে কখনো অর্থ আদায় করে গাড়ি ফেরত দেয়, কখনো আবার ‘দরদামে’ বনিবনা না হলে বিক্রি করে দেয় অন্য কোথাও। চুরি করা থেকে আস্তানায় নিয়ে যাওয়া এবং মূল মালিকের সাথে যোগাযোগ করে অর্থ আদায় পর্যন্ত ধাপে ধাপে নিয়োজিত থাকে তাদের নিজস্ব লোকজন।
এ ব্যাপারে সিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) (গোয়েন্দা-বন্দর) এ কে এম মহিউদ্দিন সেলিম আজাদীকে বলেন, সিএনজি চোরদের ধরতে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। ইতিমধ্যে কিছু চোর ও ছিনতাইকারী ধরা হয়েছে। তবে তারা আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে ফের একই অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, নগরীতে যেসব চোর রয়েছে তাদের একটি তালিকা করা হয়েছে। গাড়ি ছিনতাই রোধ করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত চেকপোস্ট বসিয়ে অভিযান চলছে।
অভিনব কৌশলে চুরি ও বিক্রি : নগরীর চান্দগাঁও থানার খাজা রোডসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে সিএনজি টেক্সি চোর চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ। এ সময় চোরাই ১১টি সিএনজি অটোরিকশা উদ্ধার করা হয়েছে। গত ১৯ আগস্ট রাতে এ তথ্য জানায় মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ।
গোয়েন্দা উত্তর ও দক্ষিণ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ আলী হোসেন আজাদীকে জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মেট্রো ও প্রাইভেট সিএনজি টেক্সি চুরি করে। চুরি করা সিএনজি টেক্সির রং ও ইঞ্জিন চেসিস নম্বর পরিবর্তন ও ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে বিক্রি করে। পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে গাড়ি চুরি ও বিক্রির এক অভিনব পদ্ধতি। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানতে পারেন, কেউ সংগ্রহ করেন পুড়ে যাওয়া ও নষ্ট হয়ে যাওয়া সিএনজি টেক্সির কাগজপত্র। কেউ ওই কাগজপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে চুরি করে নতুন ও পুরাতন সিএনজি টেক্সি। পরে চুরি করা ওই গাড়ি গ্যারেজে নিয়ে একজন পাল্টে দেয় ইঞ্জিন-চেসিস নম্বর। তাতে লাগিয়ে দেয় নষ্ট সিএনজি টেক্সির ইঞ্জিন-চেসিস নম্বর। এরপর সংগ্রহ করা নষ্ট গাড়ির কাগজপত্র দিয়ে বাজারজাত ও ভাড়ায় দেয় চুরি হওয়া গাড়ি। এই গাড়ি চোর চক্রটি পারস্পরিক যোগসাজশে এ কাজটি করে আসছে। জব্দ করা সিএনজি টেক্সিগুলোতে ব্যবহৃত রেজিস্ট্রেশন নম্বরগুলো প্রকৃতপক্ষে বিআরটিএ থেকে সংগ্রহ করেনি। গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে বিভিন্ন জায়গা থেকে চোরাই ও নম্বরবিহীন সিএনজি টেক্সিগুলো সংগ্রহ করে। পরে বিআরটিএ কর্তৃক আগেই বাতিল করা রেজিস্ট্রেশন নম্বর সংগ্রহ করে গ্রেপ্তার ও পলাতক আসামিদের সহায়তায় জাল জালিয়াতির মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন নম্বরগুলোর সঙ্গে মিল রেখে সিএনজি টেক্সির জাল ডকুমেন্ট প্রস্তুতসহ সিএনজি টেক্সির ইঞ্জিন ও চেসিস নম্বর পরিবর্তন (ডকুমেন্ট অনুযায়ী ভুয়া নম্বর প্রতিস্থাপন) করে নিজেদের হেফাজতে রেখে বেচাকেনাসহ ভাড়ায় পরিচালনা করে।
চুরির অন্য উপায় : প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জানায়, তারা প্রথমে যাত্রী সেজে সিএনজি টেক্সিতে চড়ে। এরপর অজ্ঞাত স্থানে গিয়ে চালককে করে মারধর; ছিনিয়ে নেয় গাড়ি ও মোবাইল ফোন। পরবর্তীতে মালিককে ফোন দিয়ে চায় নির্দিষ্ট অংকের টাকা; আর তা দিলেই তবে ফেরত দেয় গাড়ি। একেকটি চক্রের সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে ১৮ জন। তারা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে টেক্সি চুরি করে নোয়াখালী, বাঁশখালী, কক্সবাজারের পেকুয়া, মহেশখালী ও বান্দরবানের লামায় নিয়ে যায়।
পুলিশের কাছে যেতে চান না মালিক : আসামিদের তথ্য মতে, ছিনতাই হওয়ার পর গাড়ির মালিক ও চালকরা পুলিশের কাছে যেতে চান না। অভিযোগ দিতে গেলেই পুলিশ মোটা অংকের টাকা দাবি করে বসে। মাঝে মধ্যে মালিক বা চালককে বুদ্ধি দেয় ছিনতাইকারী ও চোরদের সঙ্গে আপস করে ফেলতে। তাই তারা মালিকের সাথে যোগাযোগ করলে একটা আপসরফা হয়ে যায়।
মুক্তিপণ আদায়ের পদ্ধতি : সিএনজি টেক্সির গায়ে মালিকের মোবাইল নম্বর দেয়া থাকে। ছিনতাইকারীরা সিএনজি ছিনতাইয়ের পরপরই মালিককে ফোন দিয়ে বলে, ‘আপনার গাড়ি আমাদের কাছে। টাকা দিলে ফেরত দেব। আপনার ড্রাইভারকে অজ্ঞান করে অমুক জায়গায় ফেলে রেখেছি।’ সর্বোচ্চ এক লাখ ২০ হাজার টাকা দাবি করা হয়, তবে ৭০-৮০ হাজার টাকার নিচে গাড়ি ফেরত দেয়া হয় না। দালালের মাধ্যমে গাড়ির কাগজ দেখে সরাসরি কিংবা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা নেয়ার পর গাড়ি ফেরত দেয়া হয়। আবার অনেকে মুক্তিপণ নেয়ার পরও সিএনজি ফেরত না দিয়ে বিক্রি করে দেয়।
জাদুর কাঠি ‘মাস্টার চাবি’ : ১৪ সেপ্টেম্বর নগরীর আকবর শাহ এলাকা থেকে চুরি যাওয়া একটি সিএনজি টেক্সি উদ্ধার করা হয় রাউজান থেকে। সে অভিযানের কথা বলতে গিয়ে আকবরশাহ থানার ওসি ওয়ালী উদ্দিন আকবর আজাদীকে বলেন, অভিযানে আমরা যে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছি তাদের কাছে সিএনজি চুরি করা ছিল বাঁ হাতের খেল। এর পেছনে জাদুর কাঠির মতো কাজ করতো ‘মাস্টার চাবি’। এ চাবি দিয়েই লক করা সিএনজি সহজেই আনলক করে চুরি করতো।
গত ১১ সেপ্টেম্বর ভোরে আনোয়ারায় আলী আহমদের বসতঘরের আঙিনা থেকে সিএনজি টেক্সি চুরির ঘটনা ঘটে। ৪ আগস্ট হামজারবাগ ফরেস্ট গেইটের সামনে থেকে সিএনজি টেক্সি চুরি চক্রের চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্ধার করা হয় একটি সিএনজি টেক্সি। ৩ আগস্ট নেশাজাতীয় দ্রব্য পান করিয়ে সিএনজি টেক্সি ছিনতাই চক্রের ২ সদস্যকে আটক করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। এ সময় ছিনতাই করা ৩টি সিএনজি টেক্সি জব্দ করে পুলিশ। তাদের কাছে একাধিক সিএনজি টেক্সির ডকুমেন্টও পাওয়া যায় বলে জানান কোতোয়ারী থানার ওসি জাহিদুল কবীর। ৩ জুলাই হাটহাজারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মুহরীহাট বটতল এলাকার হযরত মোমেনশাহ সিএনজি গ্যারেজে অভিযান চালিয়ে ৫টি চোরাই সিএনজিসহ ইফতেকার হাসান (১৮) নামে এক সিএনজি চোরকে আটক করে র্যাব-৭। ২৭ জুন সিএনজি চোর চক্রের প্রধান হোতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। রোববার মধ্যরাতে নগরীর চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাটের আরাকান সড়ক এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে র্যাব। উদ্ধার করে একটি সিএনজি টেক্সি।