অপার অপেরা মহাবিশ্বে কবিতার নাট্যমঞ্চ

আলম তৌহিদ | বৃহস্পতিবার , ২১ জুলাই, ২০২২ at ১০:১৭ পূর্বাহ্ণ

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অনুকরণপ্রিয় কবিদের ভয় করতেন, কেননা অনুকারক কোনো অর্থেই কবি নন। তিনিই কবি, যিনি ভাব ও অভিজ্ঞতার সারৎসার এবং অলংকারের মাধুরীতে কবিতাকে রসোত্তীর্ণ করে তুলেন। কবিকে চেনা যায় তার স্বতন্ত্র কাব্যভঙ্গি দ্বারা। সাম্প্রতিক কবিদের মধ্যে আসিফ নূর তার স্বতন্ত্র কাব্যভঙ্গির কারণে স্বীয় আসন পোক্ত করেছেন সুনির্দিষ্টভাবে।

‘মৃগয়া সুন্দরী’ (২০০১) কাব্যে আসিফ কবিতার রহস্যময় জগতে প্রবেশ করেন। ‘বিষকন্যা এসেছিল বেহুলার বেশে’ (২০০৭) কাব্যে কোনো মানুষরূপী বিষকন্যার সাক্ষাৎ মিলে না। এই বিষকন্যা সময়গ্রন্থি। আসিফের কালিক ভাবনার দার্শনিক নিরীক্ষণের সূচনামাত্র। ‘শরবিদ্ধ স্বরের শহর’ (২০১১) কাব্যে তার একটা পরিণতি দেখা যায়। তা হলো বস্তু, মানুষ ও প্রকৃতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দার্শনিক বোধ। হয়তো আসিফ কোল্‌রিজের এই কথাটির সারৎসার উপলব্ধি করেছিলেন-‘No man was ever yet a great poet without being at the same time a profound philosopher ’। ‘খেয়ালি খেয়া’ (২০১৭) কাব্যটি জাগতিক চেতনার দ্বিপদী আপ্তবাক্যের সমাহার। আসিফের পঞ্চম কাব্য ‘অপার অপেরা’ (২০২০)।

‘অপার অপেরা’ নামটি বাংলা ও ইংরেজি শব্দের সমন্বয়ে অনুপ্রাসের অনুরণনে পাঠককে মুগ্ধ করে। ১০১টি কবিতার সমাহার এ-কাব্যকে রিষ্টপুষ্ট করেছে। কবিতার বিন্যাস ও বিষয়বৈচিত্র্যে আসিফের মনোভঙ্গিতে ওঠে এসেছে কেবল দশদিগন্তের চিত্র নয়, মহাবিশ্বকে অবলোকনের স্পৃহাও। ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’র বিবরবাসী শামসুর রাহমান যেমন ‘রৌদ্র করোটিতে’ এসে নগরের পথে পথে হেঁটে বেড়িয়েছেন, জীবনানন্দ যেমন হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে হেঁটেছেন, আসিফকেও দেখি অনুরূপ নিজের লক্ষ্যে স্থির ও অটল। তাই আসিফ হয়ে পড়েন স্বদেশ ও বৈশ্বিক গণ্ডি পেরিয়ে মহাকালের পদাতিক।

মহামতি দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন-‘Know thyself-অর্থাৎ ‘নিজেকে জান’। আসিফও প্রথম কবিতায় ক’টি পংক্তিতে জানিয়ে দেন নিজের আত্মজীবনী। যে জীবনে নেই সুখের ফল্গুধারা, আছে কেবল দুঃখের দহন। তাই তার ভেতরে সাঁতার কাটে নদী, দাঁড় টানে মাঝি, চঞ্চল মাছেরা করে জলকেলি, আর বয়ে যাওয়া পাথুরিয়া ঝর্না তাও আসিফের কান্নার ষড়ঋতু। এক দুঃখবাদী জীবন চলার বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস, অনন্ত আকাশের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছে। দুঃখ-যন্ত্রণায় জীবন দগ্ধ হলেও আসিফ নিশানা থেকে বিচ্যুত নয়। কবিতার পংক্তিতেই এর প্রমাণ মিলে-‘আমার শীতল দীর্ঘশ্বাসে কেঁপে ওঠে বাতাসের মেরুদণ্ড,/চিতার আগুনে আমি নই-চিতাই পুড়ছে লাল তোমার আগুনে।/ এইসব ছাইঘুড়ি মেঘ নামে ঘিরছে আকাশ।’(আত্মজীবনী ,পৃ : ৯)
মহাকালের পদাতিক হলেও আসিফ জাগতিক জগত ও বস্তুর অপার রহস্যকে অস্বীকার করেন না। বরং প্রকৃতি ও বস্তুর মধ্যে এক অদৃশ্য সম্পর্ক বিনির্মাণে মনোযোগী। তাই আসিফ ভাব ও লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে বেঁধে দেন নদীর প্রতি নদীর, আবার নদী-পাহাড়-সমুদ্রের পরম আত্মীয়তার বন্ধন। আসিফের এই প্রবণতা নতুন নয় বলে ‘লুসাই’ কবিতা পাঠে আমাদের মনে পড়িয়ে দেয় ‘বিষকন্যা এসেছিল বেহুলার বেশে’ কাব্যের ‘পাঁচ নদী সহোদরা’ কবিতার কথা। সেই পাঁচ নদীবোনের মধ্যে এক নদীবোন ছিল কর্ণফুলি। ‘অপার অপেরা’ কাব্যে আসিফ আবিষ্কার করেন কর্ণফুলির মাতা হলেন লুসাই। এই সত্যই তার মুখে উচ্চারিত হয়েছে এভাবে-‘আকাশের কাছাকাছি বাড়ি।/ও লুসাই, পাহাড়ি জননী-/…তোমার একটিই মেয়ে নদী কর্ণফুলি-’। (লুসাই, পৃ: ১০)

আসিফ ভাবুক। ভাবের অপেরায় প্রকৃতির বিভিন্ন দৃশ্যপট বহুবিধ ব্যঞ্জনায় হোরেসের ‘As is painting, so is poetry’ ব্যাখ্যাকে আত্মস্থ করে আসিফ উপস্থাপন করেন নান্দনিকভাবে। তার উপলব্ধিতে আসে বর্ষার অজস্র বারিপাত-‘টিনের চালায় চলে মুড়িভাজা শব্দের মিছিল…’ (জলবর্শার এ বর্ষা, পৃ:১২) হিসেবে। কিংবা ‘রূপকথা’ কবিতায় তিনি রোদকে দেখেন গান হয়ে যেতে। ‘বাউল রোদেরা গান হয়ে ঝলসে উঠলো আকাশের জলসায়,’। চাঁদ তার কাছে ডিমপোচ, সাগরের ঢেউরা নর্তকী, আবার অন্যদিকে তার কলম থেকে ঝরে রক্ত, নানান রং এর রক্ত-লাল-কালো-বেগুনি-সবুজ…। আলের কোপে, শিকারকাহিনি, আকাশকড়াই, কস্তরীর ঘ্রাণে, জলসাগরের জলসাঘরে, পাহাড়ের চোখ, এক বিকেলের পদযাত্রা, বর্ষার বগার বিল, সন্ধ্যা, নদীকাহিনি, সুন্দরবন, নিসর্গসংগীত প্রভৃতি কবিতায় আসিফ প্রকৃতিকে অত্যন্ত বাক্সময় করে তুলেছেন।

সবকিছু ছাপিয়ে আসিফ অনন্তেরই যাত্রী। তার কাছে মহাবিশ্বটাই এক বিশাল নাট্যমঞ্চ। এই অপেরার কোনো বিরতি নেই, চলছে তো চলছেই। আসিফের ভাষায়-‘অদ্ভুত আকাশ-যদ্দুর জল তদ্দুরই মঞ্চ তার,/দর্শকের হিসাব নেই, টিকেট নেই; রাতদিন চলছেই/ অবিরাম অভিরাম এই থিয়েটার।’ (আকাশথিয়েটার, পৃ:৩৬)।

শেষ কথা এই-আসিফ সত্য ও সুন্দরের কবি। ‘Truth is beauty, beauty is truth’-কীট্‌সের এই বাণীকেই ধারণ করে আছে আসিফ নূরের ‘অপার অপেরা’। দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদের কারণে মুগ্ধ পাঠকের ধন্যবাদ পেতেই পরেন প্রচ্ছদের বরপুত্র ধ্রুব এষ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভালোবাসুন নিজেকে
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল