এজাহার, চার্জশিট কোথাও অন্তর্ভুক্ত ছিল না মূল আসামি মাদ্রাসা শিক্ষক শাহ জালালের নাম। বিচার শুরুর পর সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তা জেনে আদালত কক্ষে অবাক বাদী। থানায় গিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া সত্ত্বেও নিজের নিরক্ষরতার সুযোগে শাহ জালালকে থানা পুলিশ এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করেনি জানিয়ে তিনি আদালতকে বলেন, শাহ জালালই তার ৯ বছরের শিশুকে প্রথমে ধর্ষণ করেন। বাদীর এমন বক্তব্যের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীও অবাক। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আদালতের কাছে মামলাটি অধিকতর তদন্তের আদেশ চেয়ে আবেদন করেন। আদালতও সেটি গ্রহণ করেন এবং পিবিআইকে অধিকতর তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। আদেশে আদালত এও বলেন, প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। এরই ধারাবাহিকতায় শাহ জালালকে এক নম্বর আসামি করে চার্জশিট দাখিল করেছে পিবিআই। সম্প্রতি আদালত সেটি আমলে নিয়ে চার্জগঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন। ফলে শিশু ধর্ষণের ঘটনায় রক্ষা পেয়েও ধর্ষক শাহ জালাল শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেলেন না বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
জোরারগঞ্জ থানা এলাকায় ২০১৯ সালে তালিমুননিছা মহিলা মাদ্রাসায় ৯ বছরের মেয়ে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শিশুর মা ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি জোরারগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর ৯ বছরের ওই শিশুকে ধর্ষণ করেন মাদ্রাসার শিক্ষক মো. জাহেদুল আলম। মামলাটি তদন্ত করে থানা পুলিশ। তদন্ত শেষ করে এজাহারের মতো করে পুলিশ শুধু মো. জাহেদুল আলমের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে। এরই ভিত্তিতে আদালত তার বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন এবং সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেন। ধার্যকৃত উক্ত তারিখে সাক্ষ্য দিতে গিয়েই ঘটনার মূল আসামি শিক্ষক শাহ জালালের নাম মামলায় অন্তর্ভুক্ত নেই বলে আদালতে জানান ভিকটিমের মা ও বাদী। সাক্ষীর এ বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি অধিকতর তদন্তের আদেশ চেয়ে আবেদন করলে ২০২৩ সালের ২১ জুন আদালত পিবিআইকে মামলাটি অধিকতর তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। আদালত সূত্র জানায়, নির্দেশ পেয়ে পিবিআই তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি মূল আসামি শাহ জালালকে ১ নম্বর আসামি করে মোট দুইজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে। অপর আসামি হলেন পরে ধর্ষণে যোগ দেওয়া মো. জাহেদুল আলম। গত ৫ মে আদালত পিবিআইয়ের উক্ত চার্জশিট আমলে নেন এবং সম্প্রতি তাদের দুজনের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। আগামী ৯ জুন থেকে সাক্ষ্য শুরু হবে জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী খন্দকার আরিফুল আলম আজাদীকে বলেন, পিবিআইয়ের নিরপেক্ষ ও বিচক্ষণ তদন্তে সত্য বেরিয়ে আসে।
তবে মূল কাজটি করেছেন ভিকটিমের মা। তিনি বাদী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে এসে আদালতকে জানান, মামলায় তো শুধু মো. জাহেদুল ইসলাম রয়েছে। মূল আসামি শাহ জালালকে তো মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ কথা শুনে আমরা অবাক হয়েছি। একপর্যায়ে আদালতে আমরা একটা আবেদন করি। সেখানে উল্লেখ করি যে, মামলাটি অধিকতর তদন্ত করা হোক। এরই ধারাবাহিকতায় আদালত আদেশ দিলে পিবিআই তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মূল আসামি শাহ জালাল তালিমুননিছা মহিলা মাদ্রাসার পরিচালক। তার স্ত্রী সেখানের শিক্ষক। মাদ্রাসার একটি কক্ষে তারা বসবাস করতেন। ভিকটিমসহ অন্যান্য ছাত্রীরা মাদ্রাসার হোস্টেলে থাকতেন। স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে শাহ জালাল নানা প্রলোভন দেখিয়ে ও ভয় দেখিয়ে ৯ বছরের শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং তিনি তা নানা সময়ে করতেন। এর মধ্যে মাদ্রাসায় ছেলেদের হেফজ বিভাগ চালু হলে সেখানে যোগদান করেন মো. জাহেদুল আলম। জাহেদুল আলমের স্ত্রীও সেখানে শিক্ষিকা হিসেবে ছিলেন। মাদ্রাসার একটি কক্ষে তারাও থাকতেন। ঘটনার সর্বশেষ তারিখ অর্থাৎ ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর শিক্ষক মো. জাহেদুল আলম ভিকটিমকে জিজ্ঞাসা করেন কেন সে বার বার শিক্ষক শাহ জালালের কক্ষে যায়। জবাবে সে পুরো ঘটনা তাকে বলে। এটা জেনে শিক্ষক মো. জাহেদুল আলম একই কাজ তাকেও করতে দিতে হবে বলে ভিকটিমকে জানায়। অন্যথায় ঘটনা সবাইকে বলে দেবেন। একপর্যায়ে ওইদিনই ভিকটিমকে ধর্ষণ করেন শিক্ষক মো. জাহেদুল আলম। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জানান, মাদ্রাসা বন্ধের সময় হলে ভিকটিমের মা মাদ্রাসায় যান এবং মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মেয়ে যখন হাঁটছিলো তখন মা তাকে জিজ্ঞাসা করেন সে ভালো মতো হাঁটতে পারছে না কেন? জবাবে ভিকটিম শিশু মাকে সবকিছু বলে দেয়। ঘটনা জানাজানির পর মাদ্রাসা পরিচালক (শিক্ষক) শাহ জালাল ভিকটিমের বাড়িতে গিয়ে টাকা লেনদেন করে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন উল্লেখ করে আইনজীবী খন্দকার আরিফুল আলম বলেন, কিন্তু ভিকটিমের পরিবার শিক্ষকের সে প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। তিনি আরো বলেন, ঘটনা জানাজানির পর শিক্ষক শাহ জালাল ও মো. জাহেদুল আলমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিন্তু তখন শাহ জালালকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে দুই আসামিই কারাগারে রয়েছেন। আদালতের অধিকতর তদন্তের নির্দেশ পেয়ে পিবিআই শাহ জালালকে গ্রেপ্তার করে। ঘটনার পর মামলা ও মামলার পরবর্তী তদন্ত এবং চার্জশিট তৈরি সব কিছুতেই থানা পুলিশের গাফিলতি ছিল বলেও জানান খন্দকার আরিফুল আলম।