মরিস ওয়ার্ম: পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম সাইবার হামলা

সাফ্ফাত আহম্মদ খান | রবিবার , ৯ অক্টোবর, ২০২২ at ৩:২১ পূর্বাহ্ণ

সময়টা ১৯৮৮ সাল, দিনটি নভেম্বর মাসের ৩ তারিখ। আমেরিকার মিলিটারি ডিফেন্স কর্মকতাদের চোখে মুখে একটা আতঙ্কের ছাপ কারণ তাদের কম্পিউটারগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। খুবই ধীর গতির হয়ে গেছে। তার সাথে সাথে অদ্ভুত সব আচরণ করছে। একই ঘটনা নাসার কম্পিউটার সিস্টেমেও। ধীরে ধীরে খবর আসতে লাগলো একই সমস্যা পুরো ইন্টারনেট জুড়েই। বড় বড় ইঞ্জিনিয়াররা সমাধানের কোনো কূল-কিনারা করতে পারছিলেন না। বিশেষজ্ঞদের বুঝতে আর বাকি রইল না যে তারা হয়ত বড় ধরনের কোনো সাইবার হামলার সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন।

নাসা সহ অনান্য মিলিটারি ডিফেন্সের কর্মকর্তারা ডাটা চুরির ভয়ে নিজেদের কম্পিউটারগুলো বন্ধ করে দিতে লাগলো এমনকি অনেকে আবার ডাটা চুরির ভয়ে নিজেদের কম্পিউটারে সংরক্ষিত ডাটাগুলো ডিলিটও করে ফেলেছিলেন।

ঘটনাটি সমাধানে এগিয়ে আসে ইউনিভাসির্টি অভ ক্যালিফোর্নিয়ার একদল প্রোগ্রামার। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ব্যাপারটি বিশ্লেষণে জানা যায় এটি একটি ম্যালওয়্যার প্রোগ্রাম যেটিকে ওয়ার্ম বলা হয়।

ওয়ার্মের কাজই হচ্ছে সিস্টেমের ব্যাকডোর দিয়ে কম্পিউটারে প্রবেশ করে সেই সিস্টেম থেকে নেটওয়ার্কের অন্য কম্পিউটারগুলোতে ছড়িয়ে পড়া। মরিস ওয়ার্ম যেটা করেছিল সেটা হচ্ছে সেই সময় ব্যবহৃত ইউনিক্স সিস্টেমের ই-মেইল করার ংবহফসধরষ সফটওয়্যারের ব্যাকডোর বের করে এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল। ওয়ার্ম সাধারণত একটি থেকে আরেকটি কম্পিউটারে ছড়িয়ে পড়ে এবং একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে সেটিকে আর আক্রমণ করে না কিন্তু মরিস ওয়ার্মের ক্ষেত্রে দেখা যায় আক্রান্ত কম্পিউটারগুলোতেও পুনরায় এটির কয়েক কপি প্রবেশ করেছে এবং একই কাজের পুনরাবৃত্তি করছে যার ফলে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারের ক্ষমতা বেশি পরিমাণ ব্যবহৃত হচ্ছে এবং তা কম্পিউটারটিকে ধীর গতি করে দিচ্ছে।

ইউনিভাসির্টি অভ ক্যালিফোর্নিয়ার প্রোগ্রামাররা ওয়ার্মটিকে প্রাথমিকভাবে দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সেই সময়ে ইন্টারনেটের ব্যাপ্তি তেমন ছিল না। ইন্টারনেটে সংযুক্ত কম্পিউটারের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৬০ হাজারের মতো। মরিস ওয়ার্ম মোটামুটি মোট সিস্টেমের ১০ ভাগ কম্পিউটারকে অচল করে দিয়েছিল। এর ফলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ থেকে ১০ লক্ষ ডলার (উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে)।

এই ঘটনার কয়েক দিন কেটে গেলেও এর উৎপত্তি ও এর পেছনের প্রোগ্রামার কে ধরা সম্ভব হয়নি কিন্তু পুলিশ ও বিশেষজ্ঞরা এর মূল হোতাকে ধরার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮৬ সালে সাইবার ক্রাইম আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। তাই এর সাজা নিয়ে অপরাধী যেমন আতঙ্কে ছিল মানুষের মনেও তেমনি কাজ করছিল কৌতুহল।

এতশত সংশয়ের মাঝে একদিন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা অফিসে একটি ফোন আসে। তাতে বলা হয় তিনি এই ম্যালওয়্যারের প্রোগ্রামার সম্পর্কে জানেন এবং এটি অনিচ্ছাকৃতভাবে ঘটে গিয়েছে। যিনি এই কাজটি করেছেন তিনি এর ক্ষতি সম্পর্কে পূর্বানুমান করতে পারেননি।

সাংবাদিক তাকে নাম জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং এই কাজের শাস্তি কী হতে পারে সেই সম্পর্কে জানতে চান।

সাংবাদিকটি অনেক চেষ্টা করেও তার নাম বের করতে পারেননি। শেষে কথোপকথনের এক পর্যায়ে অপর প্রান্ত থেকে বলে উঠে ‘আর টি এম’।

সাংবাদিকের দেওয়া ক্লু ধরে পুলিশ আসামীকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।

রবার্ট টাপন মরিস

তার নাম ছিলো রবার্ট টাপন মরিস যিনি ছিলেন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র।

তার নামের সূত্র ধরেই ম্যালওয়্যারটির নাম হয় মরিস ওয়ার্ম।

তাকে গ্রেফতারের পর তদন্তে জানা যায় তিনি ১৯৮৮ সালের ২ নভেম্বর রাতে এমআইটি (ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অভ টেকনোলজি)-এর একটি কম্পিউটার হ্যাক করেন এবং সেখান থেকেই এই ওয়ার্মটি আপলোড করেন।

তিনি প্রোগ্রামটি কোনো ক্ষতির উদ্দেশ্যে তৈরি করেননি। এটি এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে তা দেখার চেষ্টা করতে চেয়েছিলেন মাত্র কিন্তু কিছু ভুল কোডিংয়ের কারণে এটি বিধ্বংসী অস্ত্রে রুপ নেয়। মরিস তার কোডিংয়ে এমনভাবে কোড করেছিলেন যে এটি যদি কোনো কমম্পিউটার ব্লক করে দেয় তাহলেও আরেক জায়গা থেকে থেকে নিজেকে কপি করে ছড়িয়ে যেতে পারবে। আর এজন্যই ওয়ার্মটি আক্রান্ত কম্পিউটারটিতেও বার বার নিজের কপি তৈরি করে যাচ্ছিল।

কিন্তু যতক্ষণে তিনি এ ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছিলেন ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। মরিস তার কাজের জন্য অনুতপ্ত ছিলেন তাই তিনি তার দুই বন্ধুর কাছে নিজের দোষ স্বীকার করেছিলেন। তাদেরই একজন পত্রিকা অফিসে ফোন করে দেয়।

এ কাজের জন্য মরিস আমেরিকার তৎকালীন সাইবার আইনের প্রথম সাজা পান। তাকে ৩ বছরের প্রভিশন সাথে ৪০০ ঘণ্টার কমিউনিটি সার্ভিস এবং ১০,০৫০ ডলার জরিমানা করা হয়।

১৯৯৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হ্যাকার চলচ্চিত্রটির সাথে মরিস ওয়ার্মের ঘটনাটির মিল রয়েছে।

জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘হাল্ট এন্ড ক্যাচ ফায়ার’-এ মরিস ওয়ার্মের মতো একটি ম্যালওয়্যার দেখানো হয় যেটা ইন্টারনেটের ব্যাপ্তি মাপতে বানানো হয়েছিল।

সুতরাং মরিস ওয়ার্মকে ইতিহাসের গ্রেট ওয়ার্ম বলা যেতেই পারে।

আমেরিকার সিলিকন ভ্যালির কম্পিউটার জাদুঘরে মরিস ওয়ার্ম-এর সোর্স কোড ফ্লপি ডিস্কে সংরক্ষিত আছে।

লেখক: কম্পিউটার হ্যাকিং ফরেনসিক ইনভেস্টিগেটর

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের গণসমাবেশ হবে লাখো জনতার সমাবেশ
পরবর্তী নিবন্ধওষুধ রাখার ফ্রিজে কাঁচা মাছ-মাংস