দোষারোপ করার সংস্কৃতি বিশ্বাস করি না : মেয়র

খনন হলে চাক্তাই খালে পাহাড় সমান মাটি কেন ।। এক-দুই ফুটের নালার জন্য জলাবদ্ধতা হবে ধারণার বাইরে

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১০ আগস্ট, ২০২৩ at ৪:৫০ পূর্বাহ্ণ

খনন করা হলেও খালে ‘পাহাড় সমান’ মাটি কেন সে প্রশ্ন তুলে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, একজন আরেকজনকে দোষারোপ করার সংস্কৃতি আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি না। কাউকে দোষারোপ করবো না। সাংবাদিকরা ‘চসিকসিডিএর মধ্যে দ্বন্দ্ব’ বলে লিখেন। আসলে কোনো দ্বন্দ্ব না। কারও প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ ও বিরূপ মনোভাবও নেই। নগররবাসী যাতে স্বস্তি পায় সে জন্য বলতে হচ্ছে। আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম, খালগুলো দেখে আসেন। আমার কথার যদি যথার্থতা না পান তখন বলবেন, আপনি মিথ্যা বলেছেন ও আরেকজনকে দোষারোপ করছেন।

গতকাল বিকেলে টাইগারপাসস্থ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) অস্থায়ী কার্যালয়ে নগরের জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন মেয়র। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ সিটি কর্পোরেশনের হাতে নেই। এখানে আমি কাজ করতে পারছি না, ওভারলেপিং হয়ে যাবে। যে সংস্থা কাজ করছে মেইনটেইনেন্সের সব দায়িত্ব তাদের। যেমন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে, সেখানে রাস্তাঘাট নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সেখানে সিটি কর্পোরেশন কাজ করতে পারবে না। ওভারলেপিং হলে পরে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। বলবে, একটা প্রকল্পের কাজ চলছে সেখানে তুমি কেন টাকা খরচ করতে গেছ।

মেয়রের বক্তব্য শুনতে নিচের ভিডিওটি দেখুন 

জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ’র মেগা প্রকল্প প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, আমি বারবার বলেছি জলাবদ্ধতার কাজ চলছে। কিন্তু কত মাটি উত্তোলন করা হবে, খালের গভীরতা কত হবে আমরা জানি না। ডিপিপিতে (মেগা প্রকল্পের) দেখেছি, সাড়ে নয় লক্ষ ঘনমিটার মাটি উত্তোলনের কথা। এর জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কথা। হয়তো উনারা বলতে পারে, আমরা ভূমি অধিগ্রহণ না করে মাটি সরিয়েছি।

এসময় মেয়র বলেন, মাটি উত্তোলন করেছেন খুব ভালো কথা। চাক্তাই খাল দৃশ্যমান জিনিস, এখানে কাউকে দোষারোপ করার প্রশ্নই আসে না। মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে চাক্তাই খালের তলা পাকা করা হয়েছে। সাংবাদিক, সুশীল সমাজের প্রতি আবেদন জানাব, আপনারা এখনি গিয়ে দেখে আসেন, যদি এটা (চাক্তাই খাল) খনন করা হয় তাহলে আগের ওই পাকাতলা পর্যন্ত ক্লিয়ার থাকবে। পাহাড় পরিমাণ মাটি কীভাবে চাক্তাই খালে থাকে? বীর্জা খাল, মহেশখাল দেখে আসেন। এগুলোও দৃশ্যমান জিনিস, দোষারোপ নয়। বিষয়গুলো উঠে আসছে এজন্য, যেহেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেই চট্টগ্রামবাসী সুফল পাবে। এ প্রকল্প সিটি কর্পোরেশনের হাতে থাকলে দায়দায়িত্ব আমার ওপর পড়ত। কারণ মানুষ চায় একটু স্বস্তি। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, সেটা আপনারা অবগত আছেন।

মেয়র বলেন, আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায়ও আমি বলেছি, খালের দুই পাশে দেয়াল দেওয়ার আগে মাটি উত্তোলন করেন। নয়তো গতবার একগলা পানি হয়েছে এবার পানি আরো বেশি হবে। গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে সিডিএ’র পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, ‘নালাড্রেন পরিষ্কার না করায় জলবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। নালাড্রেন পরিষ্কারের কাজ সিডিএ’র না, সিটি কর্পোরেশনের’। এ প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, সিটি কর্পোরেশনের একদুই ফুটের ছোট নালা আছে। এগুলো পরিষ্কার করলেও জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি না হওয়ায় সেখানে পলিথিন পেলে, গার্বেজ ফেলে। এই পরিষ্কার করলাম, এক সপ্তাহ পর ভরাট হয়ে গেছে। পরিষ্কার চলমান কাজ। প্রতিনিয়ত আমরা পরিষ্কার করছি। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য লিফলেট দিচ্ছি, মাইকিং করছি। তারপরও মানুষের মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত সচেতনতা আসবে না কিছুই হবে না। কিন্তু ছোট ছোট এ নালার জন্য জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় এটা আমার ধারণায় আসে না।

এসময় মেয়র বলেন, সিডিএ’র চিফ ইঞ্জিনিয়ার একজন কর্মচারী। কোনো অবস্থায় সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কাউন্সিলরদের প্রতি আঙ্গুল উঁচু করে তিনি কথা বলতে পারে না এবং কর্পোরেশনকেও দোষারোপ করতে পারে না। উনি কোন ভিত্তির উপর, কোন জরিপের উপর ভিত্তি করে বলছে, কর্পোরেশনের নালা ভরাট সে জন্য জলাবদ্ধতা হচ্ছে। উনি কি জরিপ চালিয়েছেন, অনুমান করে দোষারোপ করা কোনো অবস্থায় সমীচীন নয়।

মেয়র বলেন, সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করা হচ্ছে, ঠিক আছে আমাদের নালাগুলো মানুষ ময়লাআবর্জনা ফেলে ভরাট করে ফেলছে, সেগুলো পরিষ্কার হচ্ছে না। কিন্তু পানির গতি তো নিচের দিকে। নালা ভরাট হলে সড়কে পানি উঠবে। সড়ক গড়িয়ে সেটা যাবে খালে। খাল দিয়ে যদি পানি নিষ্কাশিত হয় সেটা চলে যাবে নদীতে। এখন কিন্তু খাল ভরাট হওয়াতে পানি আটকে যাচ্ছে।

এ সময় মেয়র বলেন, এবার পানি বেশি হয়েছে, সেটার কারণও আছে। ৩০ বছরের মধ্যে মনে হয় এ রকম বৃষ্টিপাত হয়নি। সাথে জোয়ারের পানি ঢুকেছে। বারইপাড়া নতুন খাল খনন ছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে চসিকের অন্য কোনো প্রকল্প নেই উল্লেখ করে মেয়র বলেন, আমরা বরাইপাড়া নতুন খাল খননে একটা প্রকল্পের কাজ করছি। এটা সাতআট বছর আগের প্রকল্প। প্রায় বাতিলও হয়ে গিয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছি, তিনি চট্টগ্রামের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক বলেই প্রকল্পটি আবার ম্যাচিং ফান্ড এর শর্ত ছাড়াই একনেকে পাশ করিয়ে দিয়েছেন। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর কাজ শুরু করে দিয়েছি এ প্রকল্পের। বর্তমানে সেটার কাজ চলছে। এর পুরো জায়গা অধিগ্রহণ করে আমাকে দেওয়া হয়নি। জায়গা যতটুকু বুঝিয়ে দিচ্ছে সাথে সাথে সেখানে কাজ করছি। কাজ কতটুকু অগ্রসর হয়েছে আপনারাই দেখে আসেন।

এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, আমরা কয়েকটা খালে পরীক্ষামূলকভাবে নেট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। হিজরা খালে নেট দেব এবং সেটা প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করবো। পরীক্ষামূলক করে যদি সুফল পাই তাহলে অন্য খালগুলোতে করতে পারি।

সিডিএ’র সংবাদ সম্মেলনে মেগা প্রকল্পের বাইরে থাকা ২১টি খালের জন্য জলাবদ্ধতা হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। ওই ২১ খাল নিয়ে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, ৩৬ খালের বাইরে যে ২১টি খাল আছে তার দায়িত্ব শুধু আমাদের নয়। কারণ এগুলো উপখাল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা এসব খালের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। এসব খাল নিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠিও লিখেছি। কিছু খাল আরএসে আছে, সিএসে আছে কিন্তু খালের অস্তিত্ব এখন নেই। প্রভাবশালীরা ভরাট করে ফেলেছে। মন্ত্রণালয়ে লিখেছি ফান্ড দেওয়ার জন্য। যদি ফান্ড দেয় তাহলে এগুলো পুর্নখনন করতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের এত অর্থ নেই যে ২১টি খাল পুর্নখনন করে সেখানে কাজ করবে।

খালের মুখে স্লুইচ গেইট দেয়া প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, আমরা আগেও বলেছি, আমাদের এলজিআরডি মন্ত্রীও দেখে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। প্রবল স্রোতে পানি যায়, কিন্তু খালে স্লুইচ গেইট করা হয়েছে সেগুলো সে রকম প্রশস্ত নয়। খালের মুখ ৯০ ফুট, চারিদিকে ভরাট করে স্লুইচ গেইটগুলো করেছে খুব সরু। তাই প্রবল স্রোতে যাওয়া পানি স্লুইচ গেইট দিয়ে তেমন যেতে পারে না। সেখানে ময়লা আটকে থাকে, যা পরিষ্কার করারও কোনো ব্যবস্থা নেই। স্লুইচগেইটের কপাট লাগানো হয়নি। তাই প্রবল জোয়ার ঢুকেছে। তাই পানি বেশি হয়েছে।

বিভিন্ন বিজকালভার্টের নিচে ইউটিলিটি সার্ভিসের পাইপ লাইন প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, যে ব্রিজগুলো আছে তার নিচ দিয়ে ওয়াসা, গ্যাস ও টিঅ্যান্ডটির পাইপ গেছে। সমস্ত ময়লাআবর্জনা সেখানে গিয়ে আটকায়। কতক্ষণ আপনি পরিষ্কার করবেন। সকালে পরিষ্কার করলে দেখবেন বিকেলে আবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। পাইপ সরানোর জন্য ওয়াসাসসহ অন্য সংস্থাগুলোর কাছে চিঠি লিখতে বলেছি। এটা সরানো গেলে গার্বেজ জমে পানি অপসারণে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা অনেকাংশে কমে আসবে।

জলাবদ্ধতা নিয়ে নগরবাসীর সমালোচনা প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, একমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধি হচ্ছে মেয়রকাউন্সিলর। এই মহানগরের মানুষ আমাকে ও কাউন্সিলরদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। অন্য কোনো সংস্থা নির্বাচিত সংস্থা নয়। তাই স্বাভাবিকভাবে চট্টগ্রাম শহরে ভালোমন্দ অন্য যেই করুক না কেন মানুষ তা আঙ্গুল উঁচু করে দেখিয়ে দেয় মেয়রকে। এটা স্বাভাবিক। কারণ মেয়রের প্রতি এদের অনেক প্রত্যাশা, আবদার থাকে। মেয়রকে তারা গালাগালিও করে। আবার সুনামও করে। এটা করবে, কারণ তাদের অধিকার আছে, তারা ভোট দিয়েছে। আমার কথা হচ্ছে, আমি কাউকে দোষারোপ করবো না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা রাখুন
পরবর্তী নিবন্ধচসিক না পারায় সিডিএকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে