মাটির লড়াই

আবিদা মিলি | শুক্রবার , ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১০:০৪ পূর্বাহ্ণ

বাড়ির উঠোনে ছেলে আর কনে পক্ষের মুরুব্বিরা গোল করে চেয়ার নিয়ে বসা। উঠোনের এক কোণে ইটের চুলোয় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।

ঘরের পালা মোরগ রান্নার সুবাসে দুচারজন উটকো লোক লাকড়ি গুঁজার ছল করে মাতব্বরি করে চলে। হ্যাজাক লাইটের আলো পেয়ে, পুকুরপাড়ের চিকন মেঠোপথটায় শিশুরা বেল্লারি (মার্বেল) খেলায় মগ্ন।

কাদীরের বাবা: না তমিজ ভাই, আমরা দেরি করতে চাই না। আইজ রাইতেই বিয়া হইবো। বিয়ার আয়োজন করেন।

বাবা আজাদ, এই লও ২০০০ টাকা।

নাকফুল, শাড়ি কিন্না একজন কাজী ডাইকা আনো।

বাড়ির পেছনদিকে কম্ফা গাছের (পেঁপে গাছ) তলায় কাদির আর রুবা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে

কাদির: রুবা রুবা, এই রুবা, চোখ তুলে তাকাও।

রুবা চোখ বন্ধ করে লজ্জায় কাঁপছে।

কাদির রুবাকে নিকটে আনে, থুতনি উঁচিয়ে তুলে ধরে

রুবার কাঁধের কাছে ফিসফিস করে বলে, মুখ তুলে তাকাও একবার।

রুবা, আমায় ভুল বুঝো না। এই মুহূর্তে আমি বিয়ে করতে প্রস্তুত না। এখন বিয়ে করার সময় না। আগে আমার মাটিকে বাঁচাতে হবে। মাটি বাঁচলে তবেই না প্রাণ বাঁচবে। শত্রুরা গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে পোড়াচ্ছে। শিশু, বৃদ্ধ, যুবতী কেউ ওদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না।শত শত মাবোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করছে শত্রুরা। এবার চোখের পানির প্রতিশোধ নিতে হবে আমায়। হাঁটুর উপর ছোট সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরা কাদির উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। মট করে কম্ফা গাছের ডাল ভেঙে হাতে নেয় পেঁপের কষ ফোঁটা ফোঁটা মাটিতে গড়িয়ে পড়ে।

কাদির দাঁত চেপে চেয়ে রয়।

গ্রামের নাম আনাখন্ড। রাস্তার একপাশে খাল, অন্যপাশে উজার করা শস্যক্ষেত।২০০০ টাকা পকেটে নিয়ে তাগড়া তরুণ আজাদ হনহন করে হেঁটে চলে। সামনে ভোজেশ্বর বাজার। বাজারে হরেক রকম দোকান।

সব দোকানেই প্রায় বন্ধ, কিছু দোকান হালকা ঝাঁপ খুলে রেখেছে। আজাদ হারাধনের স্বর্ণের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ধুতি পরা হারাধন দোকানে জল ছিটায়।স্বর্ণের বাক্সগুলো একটার উপর আরেকটা গুছিয়ে রাখে।

আজাদ: দেরি হইয়া গেছে, চলো তাড়াতাড়ি।

হারাধন ফ্রেমে বাঁধা ঠাকুরকে প্রণাম করে। ঘাড় ঘুরিয়ে পুরো দোকান দেখে নেয় একবার। গোটা দুয়েক স্বর্ণের বাক্স শক্ত করে বুকের সাথে সেঁটে রাখে। চিকচিক করা চোখের জল ফোঁটা হয়ে হারাধনের গালে গড়িয়ে পড়ে। আজাদ বন্ধুর কাঁধে হাত রাখে, চলো বন্ধু। হারাধন ঝটকা মেরে বাক্স ফেলে বলে ওঠে, হ্যাঁ, চলো।

ছিমছাম ছবির মত সাজানো গ্রাম উপাসী।সেই গ্রামে কালভার্টের লাগোয়া টিনঘেরা আক্কাসের ঘর। মা অন্ধ। বাবা প্যারালাইসিস হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন বহুদিন। চোখে ছেলের হাঁটাচলা দেখেন, মুখে ভাষা নেই।টিমটিমে কুপির আলোতে আক্কাস ত্যাড়া ব্যাড়া রুটি গড়ছে।মা তাগাদা করেন, রুটি বানাইন্না হয় নাই? তাড়াতাড়ি করো।

আক্কাস চৌকিতে লুঙ্গি বিছিয়ে টিনের থালায় মিডা কুমড়া ভাজি, রুটি আর নুন সাজিয়ে রাখে। টিনের খালি জগ হাতে কলপাড়ে যায়। টিউবওয়েল চাপে প্যাঁ পো কুৃ য়ুয়ুৃপুকুর থেকে পানি এনে টিউবওয়েলের ফাঁকায় ঢালে। খটর খটর চেষ্টা চালিয়ে যায়।

মাগো, এইট্টে আহ, গরম গরম খাইয়া নাও।

পুটলিতে দুটো শার্ট, লুঙ্গি ও মাফলার গুছিয়ে বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করে। পঙ্গু বাবা ফ্যালফ্যাল চেয়ে রয়। ছেলের হাতের কব্জি শক্ত করে চেপে ধরেন। বাবা অবুঝ শিশুর মত ঠোঁট বাঁকিয়ে কাঁদতে থাকেন। আক্কাস খামচি দিয়ে বাবাকে ছাড়িয়ে চোখ মুছে রওনা হয়।

নিশীথ রাত।

কীর্তিনাশার গভীর কালো জলে স্পিডবোট দুলছে।

বোটে আনাখন্ড, উপাসী, মশুরা, নড় কলিকাতা, চান্দনী, আচুড়া গ্রামের গোটা কয়েক তরুণ যুবা উঠে বসেছে।

সুবেদার: কাদির কোথায়?

আজাদ: আজ রাতে কাদির আর আমার বোনের বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

সুবেদার: Start the boat.

দূরে সাদা পাঞ্জাবিপায়জামা পরা কাদিরকে দেখতে পাওয়া যায়।

দাঁড়াও আমি আসছি। কাদির লাফিয়ে বোটে চড়ে। আজাদের কাঁধে মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে ওঠে।

সুবেদার: থামো কাদির, কাঁদছো কেন? বিয়ে তো সবাই করে,

আর আমরা যুদ্ধ করি দেশের জন্য যুদ্ধ। দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই।

এ লড়াই প্রাণ বাঁচাবার লড়াই। আজাদ, চলতে থাকোভটভট শব্দে কীর্তিনাশা নদী পেরিয়ে আড়িয়াল খাঁ, পদ্মা নদী হয়ে বোট মাদারীপুর ক্যাম্পে পৌঁছায়।

জুনজুলাই, আগস্ট এই তিন মাস কাঞ্চনপাড়ার জমিদারবাড়িতে ৮০ জন লোক নিয়ে ট্রেনিং শুরু হয়।

গভীর জঙ্গলে খালি বাড়ি।

রুটি, ভাজি আর দুবেলা ভাত খেয়ে আজাদ, হারাধন, কাদির, আক্কাস, বক্কা, রঞ্জু আরো অনেকের ট্রেনিং নিতে থাকে। ৯ নাম্বার সেক্টরের হয়ে বিভিন্ন থানায় অপারেশন শুরু করে তারা।

আক্কাস থেকে থেকে পঙ্গু বাবা ও অন্ধ মায়ের জন্য কেঁদে ওঠে।

কমান্ডারের নেতৃত্বে এক্সমিলিটারি, এক্সইপিআর সদস্যসহ আজাদ,আক্কাস, হারাধন, কাদির সর্বমোট বিশজন ভেদেরগঞ্জ থানা অপারেশনে রওনা হন। ওদের হাতে থাকে মেশিনগান, এলএমজি, রাইফেল, স্টেনগান, গ্রেনেড ছাড়াও আরো অনেক অস্ত্র। পাক মিলিটারি ক্যাম্প দক্ষিণ দিকে। উত্তর দিক, দেড় কিলোমিটার দূর থেকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। এগিয়ে যান আক্কাস।

আক্কাসের পেছনে আজাদ, বক্কা, হারাধন, কাদিরক্যাম্পের খুব নিকটে ঢুকে পড়ে ওরা।

বৃষ্টির মত গুলি ছুঁড়তে থাকে পাক মিলিটারি। ওরা সংখ্যায় অনেক।

বার ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ চলে।অস্ত্র আর শক্তি দুই ফুরিয়ে আসে মুক্তিবাহিনীর। ঘট ঘট করে হেলিকপ্টার ঘুরতে থাকে মুক্তিবাহিনীর মাথার উপর। এমন মুহূর্তে আক্কাসের মাথায় গুলি এসে বিঁধে। কান বেয়ে রক্ত ঝরে। আক্কাসের দেহ ফেলে আজাদসহ সকলে ধীরে ধীরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। মৃত আক্কাস চোখ খুলে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ।

সেপ্টেম্বর মাসে ভোজেশ্বর ইউনিয়নের পাঁচ আনি জমিদারবাড়িতে আনা হয় তাদের। ট্রেনিং চলতে থাকে। কাদির চুপি চুপি চিঠি লিখে রুবাকে।

প্রিয়তমা রুবা,

সেদিন যে কথা বলব বলব করেও বলা হয়নি তোমায়, তোমার কপালের ছোট্ট লাল টিপটিকে বড় হিংসে হয়। দেশ স্বাধীন করে ফিরে আসি, তবে টিপ মুক্ত করব তোমায়। টিপের বদলে, কপালে মেখে দেব ভালোবাসার আদর। দ্বিতীয়বারের মতো ভেদেরগঞ্জ থানা অপারেশনে বের হয় ওরা। দুপক্ষের তুমুল লড়াই শুরু হয়। আটচল্লিশ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয় সেই অপারেশন। কেউ পানিতে, কেউ জঙ্গলে, কেউ বা বাঁশঝাড়ে বসে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। আটচল্লিশ ঘণ্টা পর্যন্ত যে যার স্থানে বসে যুদ্ধ করতে থাকে। গ্রামের মানুষ চাল ভাজা, চিড়া, মুড়ি, গুড়, পানি খেতে দিয়ে সাহায্য করল মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের। সামনে আজাদ, কাদির সবাই; পিছনে গ্রামের শত শত মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল।

কাদির মাইক হাতে সারেন্ডার করার আহ্বান জানিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।

হঠাৎ পেজা তুলোর মতো কাদিরের ডান পা ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়তে লাগল আকাশে। আজাদ ঘাড় ঘুরিয়ে কাদিরের দিকে তাকায়। কাদির বলে ওঠে, “সাবাস ভাইয়া, এগিয়ে যান!”

মৃত্যুর আগে এটিই ছিল কাদিরের শেষ বাক্য।

ভেদেরগঞ্জের ছোট্ট খালে কলাগাছের মতো লাশ জমতে জমতে একসময় যুদ্ধ থামে। যুদ্ধে জয়ী হয় মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা। একে একে নড়িয়া থানা, পালং থানা, গোসাইরহাট থানা অপারেশনে জয়ী হয় মুক্তিবাহিনী। পালং থানা অপারেশনে আজাদ তার বন্ধু হারাধনকে হারায়। শিবচর থানা দখলে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি আজাদদের। জয়ী হয়ে কমান্ডারসহ স্পিডবোটে ফিরছিল ওরা। পদ্মা নদীর বিশাল বিশাল ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে আজাদ। বুকে নেই ভয় ডর। ও যে লড়াইয়ে নেমেছে, এ লড়াই মাটির লড়াই। মাটি বাঁচলে তবেই তো প্রাণ বাঁচবে। দূরে বিরাট গানবোট দেখতে পায় ওরা। বোটে অনেক মিলিটারি। দূরবীন দিয়ে আজাদের স্পিডবোটকে ফলো করছে। ভট ভট শব্দে মেশিনগান ছুঁড়তে শুরু করে মিলিটারিরা।

কমান্ডার কমান্ড করেন, আজাদ, ব্যাক কর!

ব্যাকে নেও, সবাই শুয়ে পড়ো! আজাদ নিঃশ্বাস বন্ধ করে চালাতে থাকে। জোরে, জোরে, আরো জোরে কমান্ডার চিৎকার করেন।

ছোট্ট নদী কীর্তিনাশায় ঢুকে পড়ে ওরা। বৃষ্টির মত গুলি ছুড়ে দেয় মিলিটারি। আজাদের ডান হাতের বুড়ো আঙুল উড়ে ফিনকির মতো রক্ত ছুটতে থাকে। কীর্তিনাশায় কাটা আঙুল ফেলে রক্ত ছিটিয়ে এগিয়ে চলে আজাদ। ফিরে যায় মিলিটারি। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় সুবেদার রেডিও হাতে চিৎকার করতে থাকেন, সবাই আসেন! এখানে আসেন!

পাকিস্তানিরা ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে!

আমরা স্বাধীন!

প্যারাসুটবোমা উড়িয়ে গ্রামবাসী আর মুক্তিযোদ্ধারা উল্লাস করতে থাকেন।

বিশ্বের মানচিত্রে আঁকা হয় একটি নতুন দেশ বাংলাদেশ।

মুক্তিযুদ্ধের বহু বছর পর বৃদ্ধ আজাদ পেঁয়াজক্ষেতে দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেন।

আর বিড়বিড় করে আওড়ান আমার প্রাণের দেশ, বাংলাদেশ। রক্ত দিয়ে জয় করা দেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু যুদ্ধ যে অনেক বাকি। সে যুদ্ধ দেশ গঠনের যুদ্ধ, দেশ সাজাবার যুদ্ধ। সে যুদ্ধের যোদ্ধা শুধু আমি নই, আমি, তুমি, আমরা সকলেই। ঐ যে দূরের কীর্তিনাশায়, উদাম গায়, সিঁদুর মাখা, পাতিল মাজা ‘বউ’ সেও এক যোদ্ধা। কর্দমাক্ত ভেজা ক্ষেতের আলে, মাটির থাল থোয়া, পান্তা খাওয়া যে কৃষক, সেও আরেক যোদ্ধা।

ছুটন্ত মোরগ, পেঁয়াজকলি সবাই মিলে আজ দেশ গড়ি। দেশ গড়ায় থাকবে না কোন দলমত, হিংসা, লোভ। এমন করে ভালোবাসব, দেশ যেন এক নাগমণি তারে ছুপাইয়া রাখব, আড়াল করব বগলে। যেন আঁচড় না লাগে, ফাটল না ফাটে। ভালোবাসা আর ভালোবাসায়, একদিন বিশ্বের বুকে জ্বলজ্বল করে উঠবে একটি নাম বাংলাদেশ।

আমি আজাদ। ক্ষমতার লোভে নয়, সার্টিফিকেটের পরোয়ায় নয়, যদি আবার কালো ছায়া হানা দেয় দেশটায় একটা আঙুল হারিয়েছি, চারটা তো আছে। আরো আছে আমার লক্ষ লক্ষ যোদ্ধা। বিস্তীর্ণ জমিতে বেগুনি আর সাদা থোকা থোকা পেঁয়াজ ফুলের দোলা দেখে আজাদের চোখ জুড়ায়। নিজের মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট কুটি কুটি কেটে বাতাসে উড়িয়ে বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা আজাদ গেয়ে ওঠেন

হায়রে আমার মন মাতানো দেশ,

হায়রে আমার সোনা ফলা মাটি।

রূপ দেখে তোর কেন আমার নয়ন ভরেনা,

তোরে এত ভালোবাসি তবু পরান ভরে না।।

আবেগে তিরতির কেঁপে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা আজাদের কাটা আঙুল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধপঁচিশে প্রকাশিত নতুন দুটি লিটলম্যাগ