যৌতুকপ্রথা রোধে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে

| বৃহস্পতিবার , ২৭ নভেম্বর, ২০২৫ at ৭:০০ পূর্বাহ্ণ

যৌতুক প্রথা নারী নির্যাতন এবং নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌতুক একটি সামাজিক অভিশাপ। যৌতুকের অভিশাপ শুধু গরিবের ঘরেই নয়, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা ধনীসব ধরনের পরিবারেই ছড়িয়ে আছে। ধর্মীয় এবং আইনগত দিক থেকে অবৈধ এই কুপ্রথার শিকার হয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো নারী নিগৃহীত হচ্ছেন। দেশে যৌতুকবিরোধী কড়া আইন থাকা সত্ত্বেও বন্ধ করা যাচ্ছে না এই ঘৃণ্য প্রথা। যৌতুকের বলি হয়ে দেশে প্রতি বছর অনেক নারী প্রাণ হারিয়েছেন। কেউ কেউ নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। যৌতুকের কারণে যেসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, তার এক ক্ষুদ্র অংশ আইনআদালত কিংবা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

সমাজে যৌতুক আদান প্রদানের বর্তমান অবস্থা নির্ণয় করার লক্ষ্যে আমরা যখন ভাবি, তখন দেখি একটি গবেষণার চিত্র। এতে দেখা গেছে, বাংলাদেশে শতকরা ৫০ শতাংশ বিবাহিত নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। অন্যদিকে, ‘আমরাই পারি জোট’ ছয়টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নারী নির্যাতনের তথ্য নিয়ে একটি গবেষণালব্ধ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক বছরে নারী ও শিশু নির্যাতনের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৪১। এর মধ্যে হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনাই সবচেয়ে বেশি এবং ৫০ শতাংশ ঘটনাই ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। প্রকাশিত তথ্যমতে, সেই বছরে নারী ও শিশু হত্যার বিচার হয়েছে মাত্র ৪১টি ও ধর্ষণের বিচার হয়েছে মাত্র ১৮টি। সংঘটিত হত্যা ও ধর্ষণের তুলনায় বিচারপ্রাপ্তির হার উদ্বেগজনক।

যৌতুক নিরোধ আইন১৯৮০ এর ৩ ধারায় যৌতুক প্রদান বা গ্রহণের দণ্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী, এই আইন বলবৎ হওয়ার পর কোনো ব্যক্তি যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করলে অথবা যৌতুক প্রদান বা গ্রহণে সহায়তা করলে সে অনধিক ৫ বছর পর্যন্ত এবং ১ বছরের কম নয় মেয়াদের কারাদন্ডে বা জরিমানায় কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। যৌতুক প্রথা রোধে এই আইন যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। যৌতুকের জন্য যেমন বহু নারীর বিয়ে হয় না, তেমনি বিয়ে হলেও এই যৌতুকের কারণেই সংসার সুখের হয় না। বহু নারীকে এজন্য স্বামীর ঘরে অপমান ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়। দেশ ও জাতির স্বার্থে যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতনের অবসান জরুরি। যৌতুকবিরোধী আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি গড়ে তুলতে হবে যৌতুকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন।

মানবাধিকার সংগঠন ও এনজিওগুলোও যৌতুকবিরোধী প্রচারণা চালাতে পারে। ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যৌতুকবিরোধী প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নিতে পারে মসজিদের ইমাম ও ধর্মীয় নেতারা। গণমাধ্যমে যৌতুকবিরোধী প্রচারাভিযানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমি মনে করি, যৌতুক বন্ধে আইনগত প্রতিরোধের চেয়েও সামাজিক প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা বেশি। সমাজদেহ থেকে এই আপদ তাড়াতে পারিবারিকভাবেও সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে।

নারী নির্যাতন রোধে আরো কিছু মৌলিক কাজ আগে করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে নারী শিক্ষা, সমাজে নারীর সুষ্ঠু অধিকার নিশ্চিতকরণ, নারীর কর্মসংস্থান ইত্যাদি। যৌতুক তথা নারী নির্যাতনের প্রধান কারণ হচ্ছে নারীর পরনির্ভরশীলতা, শিক্ষার অভাব, দুর্বল মনোভাব। একজন নারী যখন শিক্ষিত হবে, কাজ করবেতখন সে আর অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না, নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে। এ ছাড়া পুরুষের মধ্যে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মনোভাব গড়ে উঠলে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সম্ভব।

দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে আশান্বিত হয়েও বলা যায়, উন্নয়নের অগ্রযাত্রার প্রদীপের আলোর নিচেই রয়েছে গভীর অন্ধকার। সেখানে নারীরা এখনও আলোর পথ খুঁজছেন। এখনও নারী মানে কারও কন্যা, কারও স্ত্রী, কারও মা। এর বাইরে নিজের পথ খুঁজতে হবে নারীদের নিজেদেরই। আর সেই পথকে কণ্টকমুক্ত করতে সহায়তা দেবে রাষ্ট্র। দায়িত্বটা কিন্তু আমাদের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধশহীদ ডা. মিলন : প্রতিবাদী চেতনার আরেক নাম