নগরীর আলকরণে আত্মসাৎ হয়ে পড়া শত কোটি টাকার সরকারি অর্পিত সম্পত্তি হস্তান্তরে ৬ মাসের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত। সেই সাথে উক্ত সম্পদ আত্মসাৎকারী এলবার্ট সরকার ও তার পরিবারের সদস্যদের জাতীয় পরিচয়পত্রও (এনআইডি) আগামী ৬ মাসের জন্য ব্লক করা হয়েছে। গতকাল চট্টগ্রামের মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ (মহানগর দায়রা জজ) মো. হাসানুল ইসলাম এ আদেশ দেন।
কোতোয়ালী থানাধীন জিপিও’র বিপরীতের আলকরণ রোডের মুখের দু’পাশে অবস্থিত প্রায় ৭০ শতকের উক্ত ভূমির মূল মালিক ডেভিড ইজিক্যাল নামের একজন ইহুদি। দেশভাগের আগে তিনি এবং পরবর্তীতে তার পরিবার চট্টগ্রাম ত্যাগ করলে সরকারি অর্পিত সম্পত্তিতে পরিণত হওয়া উক্ত সম্পদের দিকে নজর পড়ে এলবার্ট সরকারের। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার খ্রিষ্টান বাসিন্দা এলবার্ট সরকার ডেভিড ইজিক্যালকে খ্রিষ্টান হিসেবে দেখিয়ে জাল–জালিয়াতির মাধ্যমে মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশ সনদ, এমনকি কবর সনদ (সার্টিফিকেট অফ বুরিয়াল) তৈরি করে তার ওয়ারিশ দাবি করেন। এরপর এসব ডকুমেন্ট আদালতে দাখিল ও প্রদর্শন করে রায়, ডিক্রি হাসিল করে মূল্যবান এ সম্পত্তি দখলে নিয়ে নেন। বিষয়টি নজরে পড়লে গত ১৯ মার্চ থেকে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। সম্প্রতি অনুসন্ধান কর্মকর্তা তার অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ করে মামলা রুজুর সুপারিশসহ প্রতিবেদনও দাখিল করেছেন। যাতে উক্ত সম্পদ এলবার্ট সরকার কর্তৃক আত্মসাতের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এরমধ্যে দুদকের কাছে খবর গিয়েছে যে, আদালত কর্তৃক এলবার্ট সরকারের নামে অবমুক্ত হওয়া শত কোটি টাকার সম্পদ বিক্রি বা হস্তান্তরের অপচেষ্টা চলছে। এরই প্রেক্ষিতে দুদক চট্টগ্রাম উক্ত অপচেষ্টা ঠেকাতে আদালতের কাছে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে গতকাল একটি আবেদন করে। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত উক্ত সম্পদ হস্তান্তরে ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে জানিয়ে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম–১ এর উপপরিচালক সুবেল আহমেদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, আদালতকে ভ্রমে পতিত করে (বিভ্রান্তিতে ফেলা) রায়, ডিক্রি হাসিল করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সরকারি অর্পিত সম্পত্তি আত্মসাৎ করে নেওয়া হয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানে তা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিতও হয়েছে। এলবার্ট সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা সম্প্রতি অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। মামলা রুজুর অনুমোদনের বিষয়টি বর্তমানে দুদক প্রধান কার্যালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এরমধ্যে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় তা ঠেকাতে আদালতে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করলে বিচারক তা মঞ্জুর করেছেন। তিনি আরো বলেন, এলবার্ট সরকার তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের এনআইডির তথ্য পরিবর্তন করারও অপচেষ্টায় রয়েছেন। এ জন্য তার ও তার পরিবারের সদস্যদের এনআইডি ব্লকের আদেশও চাওয়া হয়। আদালত সেটিও মঞ্জুর করেছেন। সম্পত্তি হস্তান্তর, এনআইডি ব্লক করা সংক্রান্ত আদেশ বাস্তবায়ন করবেন জেলা প্রশাসক, জেলা রেজিস্ট্রার, জেলা নির্বাচন অফিসার ও প্রধান নির্বাচন কমিশন বলেও জানান দুদক কর্মকর্তা সুবেল।
দুদক পরিচালিত অনুসন্ধানে এলবার্ট সরকারের পাশাপাশি ঘটনায় আরো ৫ জনের নাম এসেছে। তারা এলবার্ট সরকারকে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের ক্ষেত্রে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। এই ৫ জন হলেন– ৩২ নং আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের সাবেক সচিব ও বর্তমান দেওয়ান বাজার ওয়ার্ডের সচিব মোহাম্মদ মনজুর আলম, পাঁচলাইশের সুগন্ধা আবাসিকের আফরোজা বুলবুল, পটিয়ার কাশীয়াইশ এলাকার রতন কুমার মল্লিক, চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণের মো. শামসুল আলম রানা ও সংশ্লিষ্ট একজন আইনজীবী।
দুদক জানায়, ইজিক্যাল নামের একটি ইহুদি পরিবার উনিশ শতকের শেষের দিকে চট্টগ্রামে ব্যবসা করতো। পরিবারটি নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন জিপিওর সামনে আলকরণ এলাকায় প্রায় ৬৯.৭ শতক ভূমিতে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন প্লটে কয়েকটি ভবন নির্মাণ করে সেখানে বসবাস এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতো। ইজিক্যাল পরিবারের সদস্য ডেভিড ইজিক্যাল ১৯৩৫ সালের মার্চ মাসে শেষবারের মতো ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন এবং আর কখনো ফিরে আসেননি। পরবর্তী সময়ে তার পরিবারের সকল সদস্য লন্ডন চলে গেলে তার যাবতীয় সম্পত্তি সরকার কর্তৃক অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ডভুক্ত হয়।
দুদক জানায়, সরকার অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করার পর ২০১৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এলবার্ট সরকার নামের একজন খ্রিষ্টান ব্যক্তি নিজেকে ডেভিড ইজিক্যালের ওয়ারিশ (মেয়ের ঘরের নাতি) দাবি করেন এবং ডেভিড ইজিক্যালের সম্পত্তি সরকারের অর্পিত সম্পত্তির তালিকা থেকে অবমুক্ত করে তার বরাবরে প্রত্যর্পণ করার জন্য নিযুক্ত আমমোক্তারদের মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনাল আদালত, চট্টগ্রামে মামলা দায়ের করেন। এলবার্ট সরকারের মতে, ডেভিড ইজিক্যালের স্ত্রীর নাম কেরিন ইজিক্যাল এবং একমাত্র মেয়ের নাম কনক ইজিক্যাল। এলবার্ট সরকারের পিতা গোপাল সরকারের সাথে বিয়ের পর কনক ইজিক্যালের নাম হয় কনক সরকার। সে হিসেবে তিনি ওয়ারিশ সূত্রে ডেভিড ইজিক্যালের সম্পত্তির মালিক। দুদক আরো জানায়, এলবার্ট সরকারের দাখিলকৃত কাগজপত্র সত্য ধরে নিয়ে ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ও ৬ অক্টোবর আদালত রায়, ডিক্রি প্রদান করেন। উক্ত রায়, ডিক্রির বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আপিল ট্রাইব্যুনাল, চট্টগ্রামে আপিল মামলা রুজু করে। আদালত ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর ও ৬ নভেম্বর রায়, ডিক্রি মূলে উক্ত আপিল না মঞ্জুর করেন অর্থাৎ নিম্ন আদালতের রায়, ডিক্রি বহাল রাখেন। এরই প্রেক্ষিতে নামজারি খতিয়ান নং ২৫–৯১৫ সৃজন করে জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম উল্লিখিত সম্পত্তি অবমুক্ত করে ও উক্ত সম্পত্তির লিজ গ্রহীতাদের উচ্ছেদ করে বাদী এলবার্ট সরকারকে চলতি বছরের ৫ মার্চ সম্পত্তির দখল বুঝিয়ে দেয়।










