শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতি বিজড়িত খরনা গ্রামে

মৃত্যুবার্ষিকীতে- স্মরণ

রশীদ এনাম | সোমবার , ২০ অক্টোবর, ২০২৫ at ১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ

খরনা গ্রামের নামকরণটি বেশ সুন্দর। খরনা ছিল একসময় প্রকৃতির আঁধার পাহাড়ি অঞ্চল। চতুর্দিকে সবুজে ঘেরা গ্রামের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে খরনা খাল। খালটি একসময় ছিল ছড়া বা পানির লেক। পাহাড় থেকে ঝরনা গড়িয়ে ছড়ার সৃষ্টি হয়। ছোটো ছোটো ছড়া থেকে আস্ত খরস্রোত। কথিত আছে খরস্রোত থেকে খরনা খাল, খরনা খালের নামানুসারে খরনার নামকরণ হয়েছে। পটিয়া উপজেলা থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে হজরত শাহজাহান আউলিয়ার পুণ্যভূমি খরনা গ্রাম।

খরনা গ্রামের অদূরে রয়েছে পাখি ডাকা ছায়াঘেরা চির সবুজের হাতছানি দেওয়া মোজাফফরাবাদ গ্রাম। মোজাফফরাবাদের একটু আগে আরাকান সড়ক থেকে পূর্বদিকে যে সড়কটি সোজা চলে গিয়েছে সেটি খরনা গ্রাম। রাস্তার পাশে সারি সারি গাছ, সবুজ ধানিজমি। শরতের আকাশে শুভ্র মেঘের বেলা নিচে চির সবুজের ধানখেত। ধানের শিষের ডগায় রাতে ঝরে পরা শিশির কণাগুলো রোদের আলো পড়াতে মুক্তো দানার মতো জ্বলছে। ধান খেতে পানি জমে আছে। ধলি বক মাছ ধরার জন্য ধ্যানে বসেছে। ঠোঁটের নাগালে মাছ পেলে টুপ করে গিলে ফেলবে। কিষানকিষানি রাস্তার ধারে লাগানো সবজি বাগান থেকে বরবটি, ঢ্যাঁড়শ ছিঁড়তে ব্যস্ত। দুএকজন কৃষক ধানগাছের আগাছা পরিষ্কার করছে। শোয়েব নামে এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুদের বাড়ি কোন দিকে ? সে দেখিয়ে দিলো, খরনা রেলস্টেশন থেকে একটু পূর্বদিকে হেঁটে গেলে দেখতে পাবেন নুরুজ্জামান সওদাগরে বাড়ি ওইটাই শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর বাড়ি।

হাজি নুরুজ্জামান সওদাগর আইয়ুব বাচ্চুর দাদা। প্রয়াত নুরুজ্জামান সওদাগর ছিলেন খরনার দানবীর। তাঁন দান করা জায়গায় নির্মিত হয়েছে খরনা ইউনিয়ন পরিষদ, নুরুজ্জামান সওদাগরের নামে হাটবাজার, হাজি নুরুজ্জামান স্মৃতি সংসদ। খরনা রেলস্টেশন, মসজিদ, মাদ্রাসা, শানবাঁধানো পুকুরঘাট। পুকুরের পাশে মসজিদ, কবরস্থান। পুকুরে হাঁসের পাল সাঁতার কাটতে ব্যস্ত। গ্রামের ছেলেরা কাদামাখা শরীর নিয়ে পুকুরে লাফ দিচ্ছে। ছবির মতো সাজানো গ্রাম খরনা। একটু দূরে গেলে খরনা শ্রী শ্রী জগজ্জননী জ্বালাকুমারী মায়ের মন্দির। খরনা মায়ের বাড়ি নামে পরিচিত। ১৯৪৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের অনেকে পুণ্যলাভের আশায় মায়ের মন্দিরে পুজো দিতে আসেন।

খরনা রেলস্টেশনের পূর্বপাশে বাড়িটি নুরুজ্জামান সওদাগরের বাড়ি। বাড়ির সামনে কাঠ, টিন দিয়ে ঘেরা শৈল্পিক ফটক। বাড়ির সামনে সারি সারি মাটির ঘর, জরাজীর্ণ টিন সামনে দুএকটি নারিকেল সুপারি গাছ দেখলাম জীবন্ত মূর্তিও মতো দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের সামনে কলাগাছ, আমগাছ, বেলম্বি, কাঁঠাল গাছ। বাড়ির উঠোনে প্রকৃতি বিছিয়ে দেওয়া সবুজ ঘাসের গালিচা। সেমি পাকা টিন শেড পাশে পাকা দালান এটি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর দাদার বাড়ি। বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখি এক বৃদ্ধ লোক চশমা পরিধান করা খুক খুক করে কাশি দিয়ে বললেন, কাকে চাই ? সাথে ছিলেন পটিয়া বন্ধুসভার সভাপতি বাচিত শিল্পী ফারুক আহমেদ রাজু, আমরা দুজনে পরিচয় দিয়ে বললাম, শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু সম্পর্কে জানতে এসেছি চাচা। বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোকের নাম আবদুল আজিজ সম্পর্কে তিনি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর চাচা। তিনি জানালেন, ‘আমার চাচা নুরুজ্জামান সওদাগর ছিলেন তৎকালীন জমিদার ও জনহিতৈষী। তিনি পেশায় ছিলেন একজন কাপড় ব্যবসায়ী। নুরুজ্জামান সওদাগর প্রায় ১০ দুন বা ২০০ খানি জমির মালিক ছিলেন। নিজেই প্রতিষ্ঠা করেছেন, ইশকুল (এন. জেড. উচ্চ বিদ্যালয়), কলেজ (মোজাফফরাবাদ কলেজ), মাদ্রাসা, মসজিদ, হাটবাজার, তহশিল অফিস, কৃষি অফিস, খরনা গ্রামে প্রায় ১১টি প্রতিষ্ঠানের জায়গা দান করেছেন নুরুজ্জামান সওদাগর। এলাকার লোকের কথা ভেবে নিজের জায়গায় খনন করেছেন পুকুর, দিঘি। হাজি নুরুজ্জামান সওদাগরের ৫ সন্তান। ইয়াকুব সওদাগর, ইসহাক সওদাগর, মুসা সওদাগর, আবদুল বারেক সওদাগর। ইসহাক সওদাগর সপরিবারে থাকতেন এনায়েত বাজারে। শিল্পী মোহাম্মদ আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর এনায়েত বাজারস্থ ৩৪৪ জুবিলী রোডে জন্মগ্রহণ করেন।

ডাকনাম ছিল রবিন। আইয়ুব বাচ্চু নামে তাকে সবাই চিনে। অনেকে এবি. বলে ডাকেন। ভাতিজা আইয়ুব বাচ্চু ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার গ্রামে এসেছে। আসলে গ্রামের ছেলেদের সাথে মিশত। পাহাড়ে বেড়াতে পছন্দ করত।

খরনা গ্রামের অদূরে পাহাড়ি এলাকায় নুরুজ্জামান সওদাগরের পেয়ারা বাগান ছিল। আইয়ুব বাচ্চু ছেলেবেলায় গ্রামে গেলে পেয়ারা বাগানে গাছে উঠে পেয়ারা পেড়ে খেত। গ্রামের ছেলেদের সাথে চুটিয়ে ফুটবল খেলত। খুব মিশুক প্রকৃতি ছিল বাচ্চু। খরনা এন. জেড ইশকুলে একটা কনসার্ট করার কথা ছিল। করা হয়ে ওঠেনি তার আগে ওপারে চলে গেল ভাতিজা বাচ্চু। সে খুব বিনয়ী এবং অভিমানী ছিল । তাঁর মধ্যে কোনো অহমিকা ছিল না। বাপচাচাদের খুব সম্মান করত এবং তাঁর মাকে বেশি ভালোবাসত। মায়ের প্রতি খুব টান ছিল। গানবাজনা এবং গিটার বাজানোর বিষয়টা বাপদাদারা খুব একটা পছন্দ করত না। কোনো একটা পারিবারিক বিষয় নিয়ে তাঁর খুব অভিমান হয়েছিল। সে অভিমান নিয়ে চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকা চলে যায় ঢাকায়। একসময় ভাতিজা আইয়ুব বাচ্চু দেশবরেণ্য ব্যান্ড তারকা শিল্পী হয়ে ওঠে। বাচ্চুর গিটারের সুর আজও কানে বাজে। ১৯৮২ সালের দিকে সোলস ব্যান্ডে বাজাতো। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালের দিকে বাচ্চু নিজেই এলআরবি (লাভ রানস ব্লাইন্ড) ব্যান্ড গঠন করে। আইয়ুব বাচ্চু একাধারে এলআরবি ব্যান্ডের গায়ক, লিড গিটারিস্ট, গীতিকার ও সুরকার ছিল। আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম গাওয়া গান ছিল গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখা “হারানো বিকেলের গল্প”। একদিন ঘুম ভাঙা শহরে, কি জানি কি একদিন ছিল ঘাসের দোলায় ফুল ছিল। বাচ্চুর গাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় গান “সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে”, “সে তারা ভরা রাতে”, “আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি”, এক আকাশের তারা তুই একা গুনিস নে ইত্যাদি। এত সুন্দর করে গাইত এবং গিটার বাজাত মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। বাচ্চু এভাবে অকালে চলে যাবে তা কখনো ভাবিনি। বাচ্চু নেই বিশ্বাস হয় না। বাচ্চুর তুলনা বাচ্চু নিজেই। আজও বেঁচে আছে লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয়ে। ভাতিজার মনে অনেক কষ্ট ছিল, এত অভিমানী ছেলে আমাদের বংশে আমি দেখিনি।’ কথাগুলো বলতে বলতে আবদুল আজিজ কেঁদে ফেললেন।

বেলা গড়িয়ে দুপুর দেড়টা। সূর্যের লাল রশ্মি এসে পড়েছে বাচ্চুদের দেউড়ি ঘরে। ট্রেভরতি নাশতা এলো। আজিজ চাচা আমাদের নাশতা নিতে বললেন। আমরা যখন বাচ্চু ভাইয়ের দাদাবাড়ি থেকে বের হচ্ছিলাম। খরনা রেলস্টেশন দিয়ে পর্যটক এক্সপ্রেস হুইসেল বাজিয়ে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে কক্সবাজারের উদ্দেশ্য। ভাবছি আইয়ুব বাচ্চু খরনা গ্রামে আসলে আকাশের তারা একা গুণেনি সবাইকে নিয়ে গুণেছেন।

আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতি বিজড়িত খরনা গ্রামে উপমহাদেশবরেণ্য গিটার জাদুকর শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর বহুবার এসেছেন অথচ এই গ্রামে তাঁর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। বাচিক শিল্পী রাজুকে বললাম, গিটার জাদুকর শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু স্মৃতিবিজড়িত খরনা গ্রামে আইয়ুব বাচ্চুর নামে একটি ‘গিটার একাডেমি’ অথবা ‘আইয়ুব বাচ্চু সংগীত একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করলে ভালো হবে। আগামী প্রজন্ম আইয়ুব বাচ্চুর গানের চর্চা করবে। আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতি সংরক্ষণ করবে। ২০১০ সালে পটিয়ায় সনাকের আয়োজনে মাদকবিরোধী কনসার্টে এসেছিলেন শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু, এটাই তাঁর দাদা বাড়ি এলাকার শেষ স্মৃতি। ২০১৮ সালে ১৮ অক্টোবর লক্ষ কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। চৈতন্যগলী কবরস্থানে তাঁর মায়ের পাশে হলো তাঁর শেষের ঠিকানা।

বাচিক শিল্পী রাজুকে বললাম একটা আইয়ুব বাচ্চুর গান ধরো। সে গলা ছেড়ে গাইতে লাগল, ‘তুমি প্রিয় কবিতার ছোট্ট উপমা, তুমি ছন্দের অন্ত্যমিল তুমি বর্ষার প্রথম বৃষ্টি, তুমি পদ্ম ফোটা ঝিল তুমি প্রিয়তমার স্নিগ্ধ হাতে বন্ধনের রাখি তুমি কষ্টের, নিভৃত কান্নায়, ভরা যন্ত্রণার সবই তুমি শীর্ষ অনুভূতির পরে শূন্যতার বোধ, তুমি আলতো স্পর্শে প্রিয়ার চাহনি, গুমরে থাকা ক্রোধ। তোমার মাঝেই স্বপ্নের শুরু তোমার মাঝেই শেষ ভালোলাগার ভালোবাসার তুমি আমার বাংলাদেশ! আমার বাংলাদেশ!’

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেই এক সময় ছিল
পরবর্তী নিবন্ধআল-হামিম ইনস্টিটিউট ও আন-নিসা একাডেমির মতবিনিময় সভা