জুলাই বিপ্লব, জুলাই সনদ এবং রাজনীতি

এম.এ. মাসুদ | শুক্রবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১০:৫৬ পূর্বাহ্ণ

২০২৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ই আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এর পর থেকে আজ পর্যন্ত একদিনও এই সরকার শান্তিতেস্বস্তিতে কাটাতে পারেনি। একাত্তর সালে স্বাধীনতা লাভের পর বার বার নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিতপ্রতারিত এদেশের সাধারণ মানুষ ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে আশাবাদী হয়েছিল এই ভেবে যে এবার নিশ্চয় দেশে শান্তি ফিরে আসবে, দেশের রাজনীতিবিদগণ পতিত সরকারের অপকর্মের কারণে তাদের পরিণতির কথা স্মরণে রেখে দুর্নীতি থেকে শত যোজন দূরে থাকবেন, দেশে ব্যাংক লুট তথা খেলাপী ঋণের মচ্ছব আর চাঁদাবাজি বন্ধ হবে, দেশে সুস্থ রাজনৈতিক ধারার সংস্কৃতিক চালু হবে, ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষকে মামলায় জড়িয়ে আর গুম করে হেনস্থা করা হবে না। কিন্তু গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দিনসমূহে ইউনূস সরকারের প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, বিশেষ করে আওয়ামী সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সীমাহীন বাড়াবাড়ির জন্য ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে ইউনূস সরকারের অধীনে তাদের নৈতিক দুর্বলতা ও হীনম্মন্যতার কারণে যথাযথ দায়িত্ব পালনে অসমর্থতার সুযোগ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ঢাকার শাহবাগ আর জাতীয় প্রেসক্লাব প্রভৃতি স্থানে দাবী দাওয়া আদায়ের নামে সড়ক অবরোধ করে বিভিন্ন সংগঠন জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে চলেছে। শাহবাগ এলাকার তিনটি বড় বিশেষায়িত হাসপাতালের শত শত রোগীদের চরম ভোগান্তি অগ্রাহ্য করে শাহবাগ এলাকা অবরোধ করে রাখা হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে এসব সুযোগ সন্ধানী নিত্য নূতন দাবী দাওয়া উত্থাপন করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে চলেছে। স্বল্পকালীন সময়ের জন্য ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে তাদের এসব দাবী পূরণের সামর্থ্য বা এখতিয়ার আছে কি না, এ বিষয়ে কোন ধারনা দাবী উত্থাপনকারীদের মাথায় আছে বলে মনে হয় না। তবে তারা দেশ ও জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে দাবী আদায়ের জন্য সড়ক অবরোধ করে আর সচিবালয়ের গেট ভেঙে সরকারকে ব্ল্যাক মেইল করে চলেছে।

আশ্চর্যের বিষয় হল, এ সকল নিত্য নতুন দাবী উত্থাপনকারীদের সড়ক অবরোধ, গেইট ভেঙে সচিবালয়ের অনুপ্রবেশ ইত্যাদির বিষয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা কোন মন্তব্য বা বিবৃতি প্রদান করা থেকে বিরত থাকেন। এর মানে হল ৫ই আগস্টের অভ্যুত্থান দেশে সরকার পরিবর্তন সহ অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটালেও আমাদের রাজনীতিবিদদের মনমানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। তাঁরা তাঁদের চিরাচরিত ধ্যানধারণা আর মনমানসিকতা লালন করে চলেছেন। সড়ক অবরোধ, যমুনা অভিযান, সচিবালয় ঘেরাও এবং শহরবন্দর, প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত চাঁদাবাজী, বালি আর পাথর লুটপাটের বিরুদ্ধে দেশবাসী রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে কঠোর এবং দৃঢ় ভূমিকা প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁদের নিষ্ক্রিয়তা আর নীরবতায় জনগণ চরমভাবে হতাশ।

জুলাই সনদ, সংস্কার এবং জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিগত বেশ কিছুদিন ধরে অনৈক্য এবং বাহাস দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে। এসব বিষয়ে তাদের মতভিন্নতা জনগণকে আশাহত করে চলেছে। তাদের মধ্যকার এই পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনৈক্যের কারণে জনগণ মনে করছে যে, দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে ঘাপটি মেরে থাকা পতিত স্বৈরাচারের দোসররা শক্তিশালী হচ্ছে। দেশবাসী রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে এমন সব দাবি দাওয়া সম্বলিত বক্তব্য বিবৃতি পাচ্ছেন যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলির পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং উন্নাসিকতা দেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। এখন রাজনৈতিক দল সমূহের যা করা প্রয়োজন তা হল, জুলাই সনদ, সংস্কার এবং নির্বাচন বিষয়ে ছাড় দিয়ে হলেও সমঝোতায় এসে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা যাতে দেশের স্থিতিশীলতা ফিরে আসে।

জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন বিগত দিনে নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করে গেছে এবং এখনও যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করে তাদের মত ভিন্নতা কমিয়ে আনার জন্য সংলাপ অব্যাহত আছে। অনেকগুলি সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলি একমত পোষণ করেছে। যে কয়েকটির বিষয়ে মত পার্থক্য রয়েছে তা দূর করার আলোচনা চলমান রয়েছে। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়েও রাজনৈতিক দল সমূহের মধ্যে মত পার্থক্য আছে। এসব মত ভিন্নতার কারণে জুলাই সনদ জুলাই মাসে স্বাক্ষরিত হওয়া সম্ভব হল না, এরপর আগস্ট মাসও গত হয়ে গেল। জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি এবং সংস্কার প্রস্তাবের বাস্তবায়ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলি বিভিন্ন উদ্ভট প্রশ্নের অবতারণা করে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের দীর্ঘদিন যাবৎ করে আসা তাদের চলমান কাজের গতিকে শ্লথ করে দিয়েছে। অতীতে কখনোই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলি জাতীয় ইস্যুতে এক মত হতে পারেনি। এবারও পারল না। জুলাই বিপ্লব পরবর্তীতে জাতি যে সুখকর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিল, অচিরেই জাতির সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে গেল। রাজনৈতিক দলগুলি সেই পুরোনো রাজনৈতিক ধারার গণ্ডির মধ্যেই রয়ে গেল। দেশের নীরব জনগোষ্ঠী তাদের অন্তরের হতাশা আর বেদনা তাদের অন্তরেই চেপে রাখল।

ভিপি নূরকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা পিটিয়ে আধমরা করে ফেলল। অথচ জানা গেল না নূরকে এভাবে পেটানোর কারণ। এইতো সেদিন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য সব কমিশনারের উপস্থিতিতে একজন নেত্রীর সমর্থকরা একটি দলের সমর্থকদের পেটাল। এই নেত্রী আবার মিডিয়ায় এই পেটানোর পক্ষে সাফাই গাইলেন। কিছুদিন ধরে রাজনীতিতে ব্যক্তিগত আক্রমণ, অশ্লীল ভাষার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। যার ফলে রাজনৈতিক আবহাওয়া কলুষিত হয়ে পড়েছে। শোনা যায় বিগত সরকারের সময় খেলাপী ঋণ এবং ব্যাংক লুটের অনেক পলাতক হোতাদের সাথে রাজনৈতিক দলের কোন কোন নেতার যোগাযোগ আছে এবং এসব নেতাদের কেউ কেউ নাকি এদের ব্যবসাবাণিজ্য দেখভাল করেন। এসব যদি সত্যি হয়, তাহলে মানুষের আস্থার জায়গা থাকে কি? দেশের নীরব জনগোষ্ঠী প্রকৃত পর্যবেক্ষক এবং বিচারক। তারা সবই দেখছেন। তারা বিচার বিশ্লেষণ করে আগামী নির্বাচনে এসব নেতাদের ব্যাপারে সঠিক রায় দিবেন।

সীমান্তের ওপারের দেশের পতিত সরকারের অনেক নেতা সেদেশের সরকারের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যমত্যের বিকল্প নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলসমূহের একমাত্র কর্তব্য হল দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে জুলাই সনদের প্রতি ঐক্যমত্য পোষণ করে আগামী ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার মাধ্যমে দেশে একটি স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখা। দেশ পরিচালনা করবেন রাজনীতিবিদরা। জুলাই বিপ্লব পূর্ববর্তী ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে এসে, বিপ্লব পরবর্তী নতুন চিন্তা চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আমাদের রাজনীতিবিদগণ জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নূতন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা করবেন দেশবাসী এটাই প্রত্যাশা করে।

লেখক : বর্ষীয়ান নাগরিক ও সমাজকর্র্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধআল্লাহর বন্দেগী ও তাগুতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
পরবর্তী নিবন্ধকানাইমাদারী কাদেরীয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসায় মতবিনিময় সভা