বহুদিন ধরে সর্বসাধারণের একটি অভিযোগ ছিল, বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রীসেবার মান কমতে কমতে সর্বনিম্নে নেমেছিল কয়েক বছর আগে। তবে ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করেছে যাত্রীসেবার মান, বাড়ছে সুযোগ সুবিধা। রেলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রেলযাত্রা হচ্ছে নির্ঝঞ্ঝাট ও বাধাহীন। তবু ইঞ্জিন সংকটে ভোগান্তি বাড়ছে বলে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে। গত ২৫ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ ইঞ্জিন সংকটে যাত্রী ভোগান্তি দিনদিন বেড়েই চলেছে। ইঞ্জিন সংকটের কারণে অনেক ট্রেন নির্দিষ্ট সময়ে স্টেশনে পৌঁছছে না। না পৌঁছা এবং নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়তে না পারার কারণে প্রায় সময় চট্টগ্রাম স্টেশনে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।
গত ২৪ আগস্টও মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেন নির্দিষ্ট সময়ে চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছাতে না পারার কারণে এই ট্রেনের শতাধিক যাত্রী কক্সবাজারগামী সৈকত এক্সপ্রেস ট্রেন ধরতে না পেরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। এসময় তারা সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেনের সামনে এসে ইঞ্জিন লাগাতে বাধা সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে সৈকত এক্সপ্রেসের যাত্রীদের রেল কর্তৃপক্ষ পর্যটন এক্সপ্রেস ট্রেনে করে কক্সবাজার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এসময় আরএনবি এবং জিআরপি পুলিশের সদস্যরা পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন লাগাতে সহযোগিতা করলে এক ঘণ্টা বিলম্বে সিলেটের উদ্দেশ্যে ট্রেনটি স্টেশন ছেড়ে যায়। চট্টগ্রাম স্টেশনে রেলওয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারী, আরএনবির সদস্যরা জানান, রেলওয়ের অনেক যাত্রী আছেন যারা একটি ট্রেনে করে চট্টগ্রাম স্টেশনে নেমে কানেক্টিং আরেকটি ট্রেনে করে কক্সবাজার কিংবা উদয়নে করে সিলেট অথবা ঢাকায় যান। কিন্তু সামপ্রতিক সময়ে ইঞ্জিন সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় কোনো ট্রেনই নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়তে পারছে না এবং গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। জিআরপি এবং আরএনবির বেশ কয়েকজন সদস্য আজাদীকে জানান, প্রতিদিন ঢাকা–চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ও সিলেটের অনেক যাত্রী ঢাকা–কুমিল্লা– লাকসাম–আখাউড়া থেকে একটি ট্রেনে করে চট্টগ্রাম এসে চট্টগ্রাম থেকে আরেকটি ট্রেনে করে কক্সবাজার যান। আবার কক্সবাজার থেকে অনেকেই সৈকত–প্রবাল, কক্সবাজার এক্সপ্রেস ও পর্যটক এক্সপ্রেসে করে চট্টগ্রাম স্টেশনে নেমে পাহাড়িকা, মেঘনা, সোনার বাংলাসহ বিভিন্ন ট্রেনে করে গন্তব্যে যান। কিন্তু এখন ইঞ্জিন সংকটের কারণে প্রায় ট্রেন নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়তে পারছে না। আবার পথের মধ্যে ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে প্রায় ট্রেন নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যেও পৌঁছাতে পারছে না। যার কারণে প্রায় সময় চট্টগ্রাম স্টেশনে বিক্ষুব্ধ যাত্রীরা বিক্ষোভ– ভাঙচুরের মত ঘটনা ঘটাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিবছর রেলের সেবা সপ্তাহে কর্তৃপক্ষ যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও সার্বিক অব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে খুব একটা পরিবর্তন আসে না। বস্তুত দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর করা না হলে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রীসেবায় খুব একটা পরিবর্তন আসবে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, গত এক যুগে রেলে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে; চলমান রয়েছে আরও বিপুল অঙ্কের অর্থের উন্নয়ন প্রকল্প। তারপরও যাত্রীসেবার মান বাড়ছে না; দুর্ভোগ যেন যাত্রীদের নিত্যসঙ্গী। জরাজীর্ণ রেলপথ আর চরম ঝুঁকিতে থাকা লেভেল ক্রসিংয়ে প্রতিনিয়তই ঝরছে প্রাণ। তাঁরা বলেন, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি দূর করার পদক্ষেপ না নিলে যত অর্থই বিনিয়োগ করা হোক না কেন, তার সুফল পাওয়া নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। অদক্ষতার কারণে সংশ্লিষ্টরা বরাদ্দকৃত অর্থ সময়মতো খরচও করতে পারেন না। দেশে ভয়াবহ যানজট, বেহাল সড়ক ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষাপটে রেল লাভজনক সংস্থায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও এ সংস্থার রুগ্ণ দশাই কাটছে না।
রেল খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্নীতিমুক্ত সেবা খাত বাস্তবায়নে লোক দেখানো নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও গত ১৫ বছরে রেলের দুর্নীতি সামান্য কমানো যায়নি। বরং এ সময়ে তা হু হু করে বেড়েছে। তবে নানা অনিয়ম–দুর্নীতি তদন্তে যারা দোষী প্রমাণিত হয়েছে তারা বরাবরই থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেউ কেউ আবার দুর্নীতির মামলায় জেল খেটেও আসীন হয়েছেন রেলের স্বপদে। দলীয় প্রভাব বিস্তার করে বছরের পর বছর এরকম অনিয়ম চালিয়েছিল কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। রেলের গতি বাড়িয়ে এ খাতকে আধুনিক ও জনবান্ধব করতে বিশেষজ্ঞরা নানা পরামর্শ দিলেও বিগত সরকারের আমলে কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। রেলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু যাত্রীরা সেসব উদ্যোগের সুফল পাননি। কেন পাননি, তা খতিয়ে দেখা দরকার। ইঞ্জিন সংকট সমাধানে পদক্ষেপ নিতে হবে। রেলের অভ্যন্তরে যেসব দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা রয়েছে, তা দূর করতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে জবাবদিহিতা।