তাঁর চলে যাওয়া

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ২১ জুন, ২০২৫ at ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ

মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। মনটা অকারণেই ভারী হয়ে আছে। একটা ফোন কলে সকালটা আরও বিষণ্ন হয়ে উঠলো, মেঘটা যেন আরও ভারী হলো। কোন কোন খবর মন সত্যি বলে মেনে নিতে রাজী হয় না! তাই নিশ্চিত হবার জন্য ফোন দিলাম লেডিস ক্লাবের বর্তমান প্রেসিডেন্ট খালেদা আওয়াল আপাকে। জানতে চাইলাম একটা দুঃসংবাদ শুনেছি, সত্যি নয়তো? আপা জানালেন বিষাদগ্রস্ত গলায়, খবরটা সত্যি। তারপর আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফোন দিলাম, জিনাত আজম আপার বড় ছেলে আতিককে। আতিক বললো, গতরাতে একসাথে ডিনার করেছি। একেবারে স্বাভাবিক ছিলেন। সকালে ব্রেকফাস্টের জন্য ডাকতে গিয়ে দেখি, আম্মা নেই! আহা মানব জীবন! কত অনিশ্চিত। রাতে ঘুমাতে গিয়ে পরের সকালটা আর দেখা হলো না। নিঃশব্দে, নীরবে জীবনের ওপারে। সবকিছু থেকে মহামুক্তি! কিছুদিন আগে লেডিস ক্লাবে রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী উদযাপিত হলো। সেই দেখাই শেষ দেখা, শেষ স্নেহময় স্পর্শ! তাঁর শেষ বক্তব্য। শান্তিনিকেতনে বেড়ানোর গল্প, নজরুলকে নিয়ে অনেক কথা, অনেক অজানা তথ্য তাঁর বক্তব্য থেকে উঠে এসেছিলো।

চট্টগ্রামের মতো রক্ষণশীল শহরে লেডিস ক্লাব, লেখিকা সংঘ আরও অনেক প্রগতিশীল সংগঠনকে দীর্ঘদিন যথাযথ নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। একজন জিনাত আজম হয়ে উঠার জন্য কতটা কাঠখড় পোড়াতে হয় এই সমাজে সে তো সবাই জানেন। অনেক সংগ্রাম, অনেক ত্যাগ, অনেক শ্রম, অনেক একাগ্রতা ও ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে এমন জীবন অর্জন করেছিলেন তিনি। বলেছিলাম, একদিন আপনার এই কর্মমুখর জীবনের গল্প শুনতে আসবো। আপনাকে নিয়ে লিখতে চাই, অনেকটা অভিমানের সুরে বলেছিলেন, “আমি মরলে লিখো”। অবিশ্বাস্যভাবে চলে গেলেন। শোনা হলো না এমন জীবনজয়ের গল্পটা। ক্ষমা করে দেবেন আপা। এভাবে লিখতে চাইনি। আমাদের সমাজ নারীদের উঠে আসার পথটাকে আগলে রাখাটাকে নিয়ম মনে করে। পুরুষের অবারিত পৃথিবীতে নারী তার নিয়ন্ত্রিত শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার পথ খুঁজে খুঁজে জীবন পার করে। কেউ কেউ উঠে দাঁড়াতে পারে তার নিজ সক্ষমতায়, নিজ গুনে, নিজ কর্মদক্ষতায়। জিনাত আজমও ছিলেন সেইরকমই একজন। উনার খ্যাতি চট্টগ্রামের সর্বত্রই। তিনি মানুষের জন্য কাজ করতেন নারীপুরুষ নির্বিশেষে। সমাজের অবহেলিত, দুস্থ মানুষের জন্য কাজ করছেন শুধু যে সংগঠনের মাধ্যমে তা নয় ব্যক্তিগতভাবেও করেছেন। আমাদেরকেও উৎসাহিত করেছেন। তিনি শুধু সংগঠক নন তিনি একজন সফল লেখক হিসেবেও খ্যাতি পেয়েছেন। তিনি মূলত রম্য লেখক ছিলেন। তাঁর রচনার মধ্যে রয়েছে অন্য আলোয়, অন্য ভুবন, অন্তরে বাইরে অনিকেত প্রান্তরে,আমি তেলাপোকা বলছি।

তাঁর সেবামূলক কাজে অসংখ্য মানুষের মনে তিনি স্থান করে নিয়েছেন, দোয়া পেয়েছেন। লেডিস ক্লাব ছিল আপার প্রিয় প্রাঙ্গন। ভালোবাসতেন সবাইকে। মাত্র তিয়াত্তর বছর বয়সে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। চলমান জীবন থেমে থাকে না। আবারও হয়তো লেডিস ক্লাবে যাবো। যে চেয়ারটায় আপা বসতেন সেই চেয়ারটা হয়তো একদুইবার ছুঁয়ে দেখবো। আপার অনুপস্থিতি বুকের নিভৃতে কোথাও একটু হয়তো ঝড় বয়ে যাবে। জীবন চলবে জীবনের নিয়মে। তবুও আপনার শূন্যতা কি পূরণ হওয়ার মতো? আপনার এভাবে চলে যাওয়া আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি!

এতো সংক্ষিপ্ত মানুষের জীবন! মনে হয় বড় অসময়ে চলে গেলেন। আপনার অজস্র স্মৃতি, আপনার কর্মযজ্ঞে,আর একজন মানবিক মানুষ হিসেবে আপনি বেঁচে থাকবেন আমাদের সবার হৃদয়ে। একটা কথা আপনি খুব বিশ্বাস করতেন এবং বলতেনও আমরা যদি আমাদের পূর্বসূরি গুণী মানুষদের স্মরণ না করি, উনাদের সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা না করি, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে না পারি তাহলে আমাদেরকে কেউ মনে রাখবে না, স্মরণ করবে না। যথার্থই বলেছিলেন আপা। আমাদের চলার পথে অবশ্যই আপনি অনুসরণীয় হয়ে থাকবেন। স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বিনম্র শ্রদ্ধা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএ কেমন চলে যাওয়া নীরবে নিঃশব্দে!
পরবর্তী নিবন্ধঅপহরণ ও চাঁদাবাজির অভিযোগ বান্দরবানে অস্ত্রহ আটক ৯