পহেলা বৈশাখ: সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি দিন

মৃণালিনী চক্রবর্তী | সোমবার , ১৪ এপ্রিল, ২০২৫ at ৭:১৩ পূর্বাহ্ণ

আজ পহেলা বৈশাখ মানে বাংলার নববর্ষ উদযাপন উৎসব আমরা বুঝি। দুশো বছর আগে নববর্ষের উৎসব বলতে বাংলায় শুধু ইংরেজী নববর্ষকে বোঝানো হতো প্রকৃতপক্ষে এই বর্ষবরণ উৎসব দূর অতীত বাংলায় অনুষ্ঠানে ছিল ‘পহেলা বৈশাখ হালখাতার দিন’। অর্থাৎ এটি ছিল ব্যবসায়ীদের নতুন খাতা খোলার দিন। ‘হাল’ শব্দটি সংস্কৃত ও ফারসি দুটি ভাষাতেই পাওয়া যায়। সংস্কৃত এ হাল শব্দের অর্থ লাঙল। আর ফার্সিতে ‘হাল’ মানে নতুন। আর এই সময় রাজা সম্রাটরা প্রজাদের কাছ থেকে কৃষিজমির খাজনা আদায় করতেন। ভারত উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতেন। চাঁদের হিসেবে হিজরী সন গণনা করা হতো। আর চাষাবাদ নির্ভর করতো সৌরবছরের উপর। এতে অসময়ে কৃষকদের খাজনা দিতে কষ্ট হতো। সেই জন্যে সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ‘ফসলি সন’। পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। অনেকের মতে, বাংলার রাজা শশাঙ্ক এই বঙ্গাব্দের সূচনা করেন। আকবরের আমল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। জানা যায়, এই দিনেই কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হজরত মুহাম্মদ জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় গিয়ে আশ্রয় নেন। এই ঘটনা আরবি ভাষায় ‘হিজরত’ নামে পরিচিত। এর ৯৬৩ বছর পর অর্থাৎ ৯৬৩ হিজরী, ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দ আকবর সিংহাসনে বসেন। তখন থেকে হজরত মুহাম্মদের স্মৃতি বিজড়িত এই পূণ্য দিনটি পালনের রীতি শুরু হয়। প্রত্যেকে প্রত্যেক চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল, শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকতো। বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খান জমিদারদের উপর নবাবি কর্তৃত্ব উপস্থাপনের জন্য বৈশাখে পূণ্যাহ প্রথা চালু করেন। পূণ্যাহ নাম দিলেও এটি ছিল হালখাতারই আর এক রূপ। বাংলার নানা অঞ্চল থেকে প্রায় চারশো জমিদার আর রাজকর্মচারী নৌকাযোগে, পালকিতে করে মুর্শিদাবাদ আসতেন। নবাবের দরবারে খাজনা জমা দিতেন। তারপর সোনার মোহর নজরানা দিলে। তাদের পদমর্যাদা অনুসারে পাগড়ি, পোশাক, কোমরবন্ধ দান করতেন। সম্রাট আকবর প্রচলিত পয়লা বৈশাখ নবাব মারফত বাংলাদেশের বাঙালিদের মধ্যে তথা পশ্চিমবাংলায় বাংলার নববর্ষ পালন শুরু হয়।

পয়লা বৈশাখ যিনি বাংলা ও বাঙালির জীবনে আবার নবধারায় প্রাণের সঙ্গে জুড়িয়ে দিলেন, তিনি হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যা ছিল একসময় বাণিজ্যিক, তা চিরকালের জন্যে আমাদের চিন্তা চেতনার মধ্যে ধরা দিয়ে গেল এ বাঙালির লোকরীতি প্রথা ও সংস্কৃতির রূপ। ধরা পড়লো রাঙিয়ে দিল তার কবিতা, গান, প্রবন্ধ, নাটকে। বারবার রূপ এসেছে নতুন বছরের স্বাগতবাণী।এ তার কাছে নবজন্ম।

পুরণো বছরের দুঃখ বেদনা শোক জীর্ণ জীবনের অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে। নতুন আনন্দ নতুন জীবনে প্রবেশের আনন্দ অনুভূতি নববর্ষ।

১৯৩৯ সালের ১৪ই এপ্রিল পয়লা বৈশাখে শ্যামলী প্রাঙ্গণে সকালবেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘নববর্ষ ধরতে গেলে রোজই তো লোকের নববর্ষ। কেননা এই হচ্ছে মানুষের পর্বের একটা সীমারেখা। রোজই তো লোকের পর্ব নতুন করে শুরু।’

পয়লা বৈশাখ তো দ্বিধাহীন মহামিলনের উৎসব। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, শামসুর রহমান এরা এই দিনটিকে কেন্দ্র করে মিলনের গান গেয়েছেন অশুভকে দূর করে শুভর বার্তা ছড়িয়েছেন। সে কালের লেখকরা নববর্ষকে কীভাবে লেখায় রাঙিয়েছেন

কবি ঈশ্বরগুপ্ত

খৃষ্ট মতে নববর্ষ অতি মনোহর।

প্রেমানন্দে পরিপূর্ণ যত শ্বেত নর।।

চারু পরিচ্ছদযুক্ত রম্য কলেবর।

নানা দ্রব্যে সুশোভিত অট্টালিকা ঘর।।

এর আগে বাংলা নববর্ষে সুশোভিত করার কথা কোথাও পাওয়া যায় না। তখনকার সময়ে বর্ষবিদায়ও ছিল একটি ছোটোখাটো উৎসব। ন্যাড়াও ঔষধি গাছ পুড়িয়ে অমঙ্গল নাশের আবাহন খোলা আকাশের নিচে সকলে উচ্চারণ করতো গ্রামের এই লোকরীতি ঐতিহ্য। আবার নববর্ষ আঁধার ভোরে মঙ্গলের জয়গান একইভাবে করা হতো। তারপর হলুদ নিমপাতা বাটা শরীরে মেখে স্নানে যাওয়ায় আত্মিক এক প্রচ্ছন্ন অনুভূতি। তখন বর্ষবিদায়ে ঊনিশ শতকে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশায়’ উল্লেখ। এদিকে আমাদের বাবুদের গাজনতলা লোকারণ্য হয়ে উঠলো, ঢাক বাজতে লাগলো, শিবের কাছে মাথা চালা আরম্ভ হলো, সন্নাসীরা ভক্তিযোগে হাঁটু গেড়ে বসে মাথা ঘোরাচ্ছে , বামুন গঙ্গাজল ছিটোচ্ছে।

তখন চৈত্র শেষে বাংলার প্রান্তে প্রান্তে হতো গাজন আর চড়কের সম্পূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। আর মেলা। প্রণাম করলেই পাওয়া যেতো টাকা আর আনন্দে নিজেও ছুটেছি মেলায়। অন্যদিকে ফসল তোলার পর পূণ্যাহ উৎসব। পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের প্রজাদের মিষ্টান্ন বিতরণ করতেন আপ্যায়ন করতেন। বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করতেন। এই উৎসব ছিল একান্তভাবেই নতুন ফসলের উৎসব অনুষ্ঠান। তখন বাংলার সমাজ সাহিত্য সংস্কৃতি জগতে এর ছোঁয়া পড়েনি। আসলে সে যুগে নববর্ষের ধারণা ছিল অন্য রকম। দূর অতীতে শীত ঋতু থেকে বর্ষ গণনা শুরু হতো। তিথি নক্ষত্র দেখে বর্ষা আর শরৎকালের সন্ধিক্ষণকেই বলা হতো নববর্ষ প্রবেশের উৎসব। অষ্টমী পূজা শেষে নবমী শুরুর সন্ধিক্ষণ ছিল পুরনো বছর শেষ নতুন বছরের শুরু। একশত আটটি প্রদীপ জ্বালিয়ে বরণ করা হতো নতুন বছরকে। ধীরে ধীরে এই ভাবনা মিলিয়ে গেল উত্তরকালে শারোদৎসব অনুষ্ঠান।

আবার প্রাচীনকালে দেখা যেতো তারা চন্দ্র সূর্যের গতি লক্ষ্য করে বছর গণনা করতে জানতো না তারা অগ্রহায়ণ মাসকে প্রথম মাস হিসেবে বিবেচনা করতো। অগ্রঅর্থাৎ প্রথম। হায়ন অর্থ বৎসর। এই মাস থেকে নতুন বছর গণনা করতো। কারণ ছিল কৃষি প্রধান এই দেশে সেই সময়ে কৃষকের ঘরে নতুন ফসলে ভরে উঠতো। হেমন্তের অগ্রহায়ণ মাসটি ছিল শ্রেষ্ঠ মাস, মার্গ শীর্ষ প্রথম মাস এই ভাবনা গ্রামীণ কৃষিজীবীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অজিত কুমার গুহ লিখছেন

চৈত্রের সংক্রান্তি আসার কয়েকদিন আগে থেকেই আমাদের ঢেঁকিঘরটা মুখর হয়ে উঠতো। নববর্ষের প্রথম দিন ছেলেমেয়েদের হাতে নাড়ু মোয়া, ছানার মুড়কি ও সরভাজা দিতে হবে, তারই আয়োজন চলতে থাকতো। বাড়ি থেকে দূরে মস্ত একটা খামার বাড়ি। সেখানে বাইরের গোলাবাড়িতে চৈতালি ফসল উঠতো। আর আঙিনার প্রান্তে তৈরি হতো বড় বড় খড়ের গাদা। কোনোদিন কালবৈশাখী আসতো প্রলয় রূপ নিয়ে। কচি কচি আমগুলো গাছ থেকে উঠোনের চারদিক ছড়িয়ে পড়তো আর ভেজা মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ নাকে এসে লাগতো। তারপর পুরণো বছরের জীর্ণ ক্লান্ত রাত্রি কেটে গিয়ে নতুন বছরের সুর্যোদয়ের আবির্ভাব ঘটতো।

আবার আহমদ ছফার লেখায় নববর্ষের ভিন্নরূপ দেখি

আমরা ছোটবেলায় দেখেছি বেলা আটটানয়টা বাজার সাথে সাথে বাড়িতে আচার্য বামুন আসতেন। তিনি পাঁজি খুলে অনেকটা আবৃত্তির ঢঙে বলে যেতেন,। এই বছরের রাজা কোন গ্রহ, মন্ত্রী কোন গ্রহ, এবছরের কত বৃষ্টি হবে, কত ভাগ সাগরে আর কত ভাগ স্থলে পড়বে, পোকামাকড়, মশামাছির বাড় বৃদ্ধি কত, তারপর আমাদের কোষ্ঠী দেখে দেখে গণঠাকুর ভালো মন্দ বলে যেতেন। এ বছরটি কার কেমন যাবে। সমস্ত মুসলিম বাড়িতে কোষ্ঠি রাখা হতো না। সব বাড়িতে গণ ঠাকুরও আসতেন না। আমাদের পরিবারের সঙ্গে যে সব হিন্দু পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল সেসব বাড়ি থেকে মুড়ি মুড়কি, মোয়া নাড়ু এগুলির হাঁড়ি আসতো। এ হাঁড়িগুলো ছিল চিত্রিত। আমাদের গ্রামে এগুলোকে বলা হতো ‘সিগ্যাইছা পাতিল।’ আমার মা এ হাঁড়িগুলো যত্ন করে ছাদে রেখে দিতেন। আমরা সুযোগ পেলেই চুরি করে খেতাম। কৃপণ সাধু ময়রা পর্যন্ত সেদিন দাম না নিয়ে দুএকটা কদমা অথবা দুচারখানা গজা অম্লান বদনে খাইয়ে দিত। তখন এইটুকু সৌভাগ্যের জন্যই পয়লা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে দ্বিধা হয়নি। নববর্ষ উৎসব প্রথমে যা ছিল কৃষি ও রাজস্ব আদায়ের বিষয়। পরে তা হয়ে উঠলো নতুন সংস্কার, নতুন সংস্কৃতি, নতুন চিন্তাধারা, তার সাথে নব জীবনের আহ্বান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রথম থেকেই নববর্ষের উৎসব কোনও ধর্মের বাঁধনে বাঁধা পড়েনি। সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ এই উৎসবে বাংলার মানুষ নব্য পোশাকে সে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান মহানন্দে যোগ দিতেন আজও একাকার। পৃথিবীর সব দেশেই পালন করা হয় নববর্ষ। বাঙালির সমাবেশে পয়লা বৈশাখ নববর্ষ নাচগান আনন্দানুষ্ঠানে এক প্রাণবন্ত রূপ। বৈশাখী মেলা, বাড়িতে যাওয়া আসা, শুভেচ্ছা বিনিময়, পানতা ইলিশের নিমন্ত্রণ, বর্ষবিদায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে, সঙ্গীত নৃত্যকলানাট্যকলার আবহে আনন্দ উৎসব মিলে সারা বছরের অন্য দিনগুলির থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এই দিনটি।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, সংগীতশিল্পী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযাত্রায় পহেলা বৈশাখ এবং তার দ্রোহচেতনা
পরবর্তী নিবন্ধবাংলা নববর্র্ষ বাঙালি সংস্কৃতির অনন্য বাহন