রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির সুযোগ নিয়ে বাসে যাত্রী পরিবহনে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার নারী–পুরুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েন। টাকা দিয়েও বাসের টিকেট না পাওয়া এবং নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণে টিকেট কেনাসহ নানাভাবে ভুগতে হয়েছে মানুষকে। বিভিন্ন রুটে বাসের টিকেট কালোবাজারি হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা যায়, মাইলেজের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক দেওয়াসহ কয়েক দফা দাবিতে সোমবার রাত ১২টা থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেছেন রেলওয়ের রানিং স্টাফরা। এর ফলে সারা দেশে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। যাত্রীরা সচরাচর ট্রেনের টিকেট আগেভাগে কিনে থাকেন। সোমবার মধ্যরাত থেকে ধর্মঘটের কথা অনেক যাত্রী জানতেন না। তারা সকালের ট্রেনগুলো ধরার জন্য শীতের ভোরে স্টেশনে আসেন। এসে শুনতে পান, ট্রেন চলাচল করবে না। ধর্মঘটের খবরে অনেক যাত্রীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। নানা জরুরি কাজে অনেকের ঢাকাসহ দেশের নানা অঞ্চলে যাওয়া দরকার। আবার ঢাকা থেকেও একইভাবে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের নানা গন্তব্যে যাওয়ার জন্য ঘর ছাড়া মানুষগুলো ট্রেন বন্ধের খবরে দিশেহারা হয়ে পড়েন। রেলের পক্ষ থেকে বিআরটিসির বাস ম্যানেজ করে কিছু যাত্রীকে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলেও হাজার হাজার যাত্রীর চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। একেকটি ট্রেনে গড়ে ৮শ জনের মতো যাত্রী থাকেন। কোনো কোনো ট্রেনে এই সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যায়। এতে একটি ট্রেনের যাত্রীকে বাসে পাঠাতে হলে ২০টির বেশি বাস দরকার। তাৎক্ষণিকভাবে যা যোগাড় করা কঠিন। চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন ১২টি আন্তঃনগরসহ ১৫টির বেশি ট্রেনে ১০ হাজারের বেশি মানুষ ঢাকা, সিলেট, চাঁদপুর, কুমিল্লাসহ নানা গন্তব্যে যাতায়াত করেন। ধর্মঘটের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে যাত্রীরা বিভিন্ন বেসরকারি বাস কোম্পানির কাউন্টারে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। হাজার হাজার যাত্রীর চাপে বাস কাউন্টারের লোকজন টিকেট নেই বলে জানিয়ে দেন। পরবর্তীতে বাড়তি টাকা দিয়ে টিকেট ম্যানেজ করে কিছু কিছু যাত্রী গন্তব্যে যেতে পারলেও অধিকাংশ মানুষ মন খারাপ করে ঘরে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। স্টেশন রোড, দামপাড়া এবং এ কে খান গেট এলাকা গতকাল যাত্রীতে গিজগিজ করতে থাকে।
গতকাল সকালে ট্রেনে টিকেট কেটেও যাত্রা করতে না পারা মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, আমি জানতাম না যে ট্রেন ধর্মঘট শুরু হয়েছে। অনেক কষ্টে সকালে স্টেশনে যাই। কিন্তু গিয়ে শুনি, ট্রেন চলবে না। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। ঢাকায় সচিবালয়ে জরুরি কাজ, যেতেই হবে। তাই উপায়ান্তর না দেখে বাস কাউন্টারে গেলাম। সেখানে গিয়ে ভিতরে ঢোকার মতো অবস্থাও ছিল না। প্রতিটি কাউন্টারে শত শত মানুষ। বাড়তি দাম দিয়েও টিকেট না পাওয়ার কথা জানান বহু যাত্রী। আমি ওখান থেকে এ কে খান চলে গেলাম। সেখান থেকে এক হাজার টাকা দামের একটি টিকেট দুই হাজার টাকায় কিনে ঢাকার পথ ধরলাম।
আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চট্টগ্রাম থেকে দেশের অন্তত ৬০টি রুটে ৬০০টির মতো বাস চলাচল করে। এসব বাসে গড়ে ১৮ থেকে ২০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। কিন্তু গতকাল ট্রেন বন্ধ থাকায় এই যাত্রী সংখ্যা দ্বিগুণে গিয়ে ঠেকে। এত যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা বাসের নেই। তাছাড়া অনেকে বাসে আগে টিকেট কিনে রাখেন। তাৎক্ষণিকভাবে এত মানুষের টিকেটের যোগান দেওয়া অসম্ভব। তাই বহু মানুষ টিকেট পাননি।
মোহাম্মদ জহুরুল ইসলাম নামে একজন যাত্রী বলেন, টিকেট কালোবাজারি হয়েছে। আমাদের হাতে আর কোনো বিকল্প ছিল না। তাই কাউন্টার থেকে না নিয়ে তাদের লোকের কাছ থেকে কালোবাজারিতে টিকেট কিনতে বাধ্য হয়েছি। তবুও স্বস্তি যে গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছি। তিনি বলেন, প্রতিটি কাউন্টার থেকে শত শত যাত্রী মন খারাপ করে ফিরে গেছে। টাকা দিয়েও টিকেট জুটেনি।
ট্রেন ধর্মঘটের কারণে বাসে ঠাঁই না পেয়ে অবস্থাপন্নদের কেউ কেউ ফ্লাইটে যাতায়াত করেছেন। সেখানেও চলেছে ভাড়া নৈরাজ্য। সচরাচর ফ্লাইট ছাড়ার সময়ে টিকেটের দাম চড়া থাকে। গতকাল এই দাম আরো চড়া ছিল।
চট্টগ্রামের মতো অবস্থা বিরাজ করেছে ঢাকায়। ঢাকা রেল স্টেশনে পৌঁছে ট্রেন না পেয়ে হাজার হাজার মানুষ চট্টগ্রামমুখী বাসগুলোর কাউন্টারে গিয়ে ভিড় করেন। কিন্তু টিকেট জুটেনি হাজারো মানুষের। চড়া দামে কেউ কেউ টিকেট কেনার সুযোগ পেলেও অনেক যাত্রী ঘরে ফিরতে পারেননি।
আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির একজন নেতা বলেন, গতকাল প্রতিটি কোম্পানি অতিরিক্ত বাসের যোগান দিয়েছে। তবে নিয়মিত চলাচলের বাইরে খুব বেশি বাস তো অলস থাকে না। যাত্রীদের বিপুল চাহিদা মেটাতে প্রতিটি কোম্পানি চেষ্টা করেছে। কিন্তু এরপরও অনেক যাত্রীকে টিকেট দেওয়া সম্ভব হয়নি।
ট্রেন ধর্মঘট লাগাতার হলে দেশব্যাপী যাত্রী পরিবহনে সংকট সৃষ্টি হবে বলে সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।