গ্যাস ও বিদ্যুৎ দেশের শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে এবং অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। সম্প্রতি গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে অস্থিরতা বাড়ছে। কিছু কিছু নেতিবাচক সিদ্ধান্তে নানা শঙ্কায় ভুগছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। বিগত সরকারের সময় শিল্প কারখানা ও ক্যাপটিভে দাম দ্বি–গুণের চেয়ে বেশি বৃদ্ধি করার পর অনেক শিল্প কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। অনেক শ্রমিক হয়ে পড়ে বেকার। বর্তমানেও সরকারের উচ্চমহল হতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির তোড়জোড় শুরু হয়েছে। জ্বালানি বিভাগ হতে জানানো হয়েছে, আমদানিকৃত এলএনজির খরচ যা পড়বে সেই দর অনুযায়ী নতুন শিল্প কারখানার মালিকদের কাছ থেকে গ্যাস দাম আদায় করা হবে।
শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতি। এ সিদ্ধান্ত যদি বাস্তবায়ন হয় ধ্বংস হয়ে যাবে দেশের শিল্প খাত, বন্ধ হয়ে যাবে শিল্পে বিনিয়োগ। নতুন করে এদেশে আর কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে না। খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন সরকারের আত্মঘাতি ও অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে দেশি ও বিদেশী বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে যা দেশের অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব পড়বে। বিগত সরকারের সময়ে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সাালে নির্বাহী আদেশে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে তিনগুণ করে। কিন্তু দুই বছর পরও শিল্পে গ্যাস সংকট কাটেনি। বরঞ্চ সরকারের এসব সিদ্ধান্তে অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাস বিদ্যুৎ সেক্টর একটি জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান কিন্তু প্রতিনিয়ত লাগামহীনভাবে মূল্য বৃদ্ধি হলেও সেবার মান দিন দিন নিম্নমুখী হয়েছে।
পেশাগত কারণে গ্যাস সেক্টরের সাথে আমার সম্পর্ক বিদ্যমান। এ সেক্টরে গ্রাহক সেবার বালাইতো নেই প্রতিদিন চলছে নানা রকম পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও মিটিং, আলোচনা, ফলে সময় চলে যায় দিন দিন। কর্মকর্তাদের মাঝে গ্রাহক সেবার পরিবর্তে গ্রাহক হয়রানির মনমানসিকতা বেশি। কিছু সময়ের জন্য বাইরের কর্মকর্তা এনে দায়িত্ব দিলে তার নিকট হতে আন্তরিকতাপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে সময় কাটিয়ে যাওয়ায় প্রাধান্য পায়। উন্নত আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় সেবার মান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণের কথা বলা হলেও গ্যাস সেক্টরে প্রতিনিয়ত ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ করা হচ্ছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা গ্যাস সেক্টরের কোম্পানীগুলোতে নেই। ইতিপূর্বে যে সব সিদ্ধান্ত কোম্পানীগুলোর ব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মকর্তারা গ্রহণ করতেন সে সব বিষয়ে অনুমোদন দেয়ার ক্ষমতাও কোম্পনীর বোর্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সরঞ্জাম পরিবর্তন, সরঞ্জাম পুনঃবিন্যাসের ন্যায় আবেদনগুলো মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে অনুমোদন করার বিধান ছিল। কিন্তু বর্তমানে সে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও কোম্পানীগুলোর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা খর্ব করে কোম্পানী গঠিত বোর্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। কোম্পানীর বোর্ড মিটিং ও একটি প্রক্রিয়ার বিষয় মাসে একটি বোর্ড মিটিংও হয় না। ফলে গ্রাহক সেবার ক্ষেত্রে কোম্পানীগুলোর কোনো ক্ষমতায় নেই। যার কারণে গ্রাহক হয়রানি ও ভোগান্তি দিন দিন বেড়েই চলছে। বোর্ডে একবার নিতে না পারলে তা ২/৩ মাস এমনকি বছর পর্যন্ত গড়িয়ে যায় কোন অনুমোদন হয় না। কোম্পানীগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা অনুমোদনের কোনো ক্ষমতা না থাকায় কর্মকর্তাদের মাঝে অলসতা, কর্মবিমুখতা লক্ষ্যণীয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে গ্রাহকদের মাঝে ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার পরিবর্তন হলেও গ্রাহক হয়রানি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণের পরিবর্তে কেন্দ্রীয়করণের যে প্রবণতা তা পরিবর্তন হয় না। সরকার যায় সরকার আসে সাধারণ মানুষকে সেবা প্রদানের মান দিন দিন নিম্নগামী হচ্ছে। অপর দিকে করের ভার, মূল্য বৃদ্ধি, ভ্যাট–টেঙ সকল ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণ নিরুপায় ও অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
এ অবস্থার পরিবর্তন খুবই জরুরি। পেট্রোবাংলার অধীনস্থ কোম্পানীগুলোকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তাদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোম্পানীগুলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করা প্রয়োজন। যে সব বিষয়ে অতীতে কোম্পানী পর্যায়ে অনুমোদনের ব্যবস্থা ছিল সে একইভাবে লোড বৃদ্ধি সরঞ্জাম পুনঃবিন্যাস ইত্যাদি বিষয়ে অনুমোদনের ক্ষমতা কোম্পানী পর্যায়ে প্রদান করা দরকার। এতে গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধি পাবে এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠবে, দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশীলতা অর্জন করবে। স্বল্প সময়ে গ্রাহকের চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে। কোম্পানীর বোর্ড সমূহে যেন সব পরিচালকরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য নিয়োজিত তাঁদেরকে খাটো না করে শুধুমাত্র বলা যায় বাস্তবতার দৃষ্টিকোণে। গ্যাস সংযোগ ও কারিগরি বিষয়ে তাদের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই তাছাড়া সংক্ষিপ্ত মিটিং এ কারিগরি সিদ্ধান্ত নেয়াও যায় না। ফলে দিন দিন পুঞ্জীভূত সমস্যায় জর্জড়িত হয়ে পড়ছে বিপনন কোম্পানীগুলো। এছাড়া কোম্পানীর পরিচালনা পরিষদে গ্রাহক প্রতিনিধি না থাকায় গ্রাহকের স্বার্থ দেখার কেউ নেই। যা এক প্রকার বৈষম্য বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞমহল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত সরকারের কেন্দ্রীয়করণের যে ভুল সিদ্ধান্ত তা পরিহার করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীয়করণ জরুরি। এখনই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে পেট্রোবাংলায়।
ইতিপূর্বে এ বিষয়ে অনেকবার লেখা হয়েছে, বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। গ্যাস সেক্টরের অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। কর্মকর্তাদের অলসতা এবং কোম্পানীগুলোতে যোগ্যতদের পদায়ন না করে বাইরের কর্মকর্তাদের এসে চাপিয়ে দেওয়া এবং কারিগরি জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদেরকে সর্বোচ্চ পদে পদায়ন করে অভিজ্ঞদের অবমূল্যায়ন করে এ সেক্টরকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে রাখা হয়েছে। বৈষম্যের কারণে ক্ষমতার রদবদল হলেও এখনো অনেক বিভাগে বৈষম্য বিদ্যমান।
একটা বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন চট্টগ্রাম দেশের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি। কিন্তু সূদুঢ় অতীতে এবং বর্তমানেও প্রতিটি ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বঞ্চনার শিকার। গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। অথচ চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতির অন্যতম যোগানদার। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রামের মানুষ। প্রান্তিক পরিবেশে তাঁর বেড়ে ওঠা। তাঁর এ সময়েও যদি চট্টগ্রাম উপেক্ষিত থাকে, তার চেয়ে বেদনার আর কিছু থাকে না। চট্টগ্রামের সাথে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি জড়িত। এ বিষয়টি সবাই স্বীকার করলেও কার্যক্ষেত্রে এর প্রমাণ মেলে না। নতুন সময়ে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গ্যাস সেক্টরের ন্যাায় জনসেবামূলক সংস্থাগুলোকে ইগো ত্যাগ করে জনস্বার্থে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা, চট্টগ্রামের দুঃখগাথা হয়ে আছে জলাবদ্ধতা। বর্ষা মৌসুমে ভারী কিংবা অল্প বৃষ্টিতে নগরের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। এ নিয়তি চট্টগ্রামবাসী এক প্রকার মেনেই নিয়েছে। বৃষ্টি না থাকলেও অনেক সময় জোয়ারের পানিতেও খাতুনগঞ্জের ন্যায় বিখ্যাত ভোগ্যপণের পাইকারী বাজার, হাসপাতালসহ বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ার ঘটনা এখনো নৈমিত্তিক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রাম নগরের জলবদ্ধতার মূল কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ন। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জলপ্রবাহের যে ধারা তা বন্ধ করে উন্নয়ন কাজগুলো করা হয় কিন্তু পরবর্তীতে তা চালু করার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীলদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মেগা প্রকল্পের জলাবদ্ধতা নিরসনে যে সুপরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন জরুরি।
প্রকৃত প্রস্তাবে ‘কাজ নেই তো খই ভাজ’ এত্থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সেবামূলক সংস্থার কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে, প্রকৃত অর্থে জনগণের সেবায় মনোযোগ হতে দায়িত্বশীল হতে হবে। জবাবদিহিতা এখন সবচাইতে বেশি প্রয়োজন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক–শিল্পশৈলী।