দৃষ্টিনন্দন ফুটপাত নগরীর সৌন্দর্য বাড়ায়। আকর্ষণীয় চওড়া ফুটপাত ধরে চলাচল করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন পথচারী। পথচারীদের নিরাপদে হাঁটা ও চলাচলের উপযুক্ত স্থান ফুটপাত। প্রশস্ত ফুটপাতের ফলে যানজট বা দুর্ঘটনাও কমে অনেক। ব্যস্ত নগরীকে যানজটমুক্ত রাখতে স্বল্প দূরত্বে হেঁটে চলার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এই ফুটপাত কি আসলেই পথচারীদের জন্য? ফুটপাতের বর্তমান চিত্র হচ্ছে, ফুটপাত আছে আবার ফুটপাত নেই। ফুটপাত মানুষের চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে, এটা চরম বিশৃঙ্খলা এবং সময়ের বিশাল অপচয় হচ্ছে, যার ফলে মানুষের জন্য নগর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট দোকান, নির্মাণ সামগ্রী, ব্যবসা সামগ্রী আর হকারদের ঠেলে গন্তব্যে পৌঁছাতে প্রতিদিনই হয়রানি পোহাচ্ছেন পথচারিরা। ফুটপাতে ব্যবসা বা খাবার বিক্রয় কেন করবে। ফুটপাতে ভাসমান ব্যবসায়ী, হকার, অবৈধ পার্কিং ইত্যাদি কারণে ব্যস্ততম রাস্তাগুলোতে দিনের বেশির ভাগ সময় লেগে থাকে যানজট। মানুষ যেন মেনেই নিয়েছে এই পরিস্থিতিকে। আবার ফুটপাতে মাঝে মাঝে গর্তও দেখা যায়। সেদিকে কে খেয়াল দেবেন? অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে বিশেষ করে নগর ব্যবস্থাপনার মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে রয়েছে সমন্বয় ও সমঝোতার অভাব। বর্ষাকালে ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার, ওয়াসার লাইন স্থাপনের জন্য সংস্কার করা রাস্তা খুড়ে লাইন বসানো হয়। আবার কোথাও কোথাও রয়েছে ডাস্টবিন। বেশ কয়েকটি এলাকার ফুটপাতের চিত্র এমনই। মানুষের চলাচল নির্বিঘ্ন ও নগরবাসীকে যানজটমুক্ত রাখতে হলে ফুটপাত দখলমুক্ত ও সংস্কার করার কোনো বিকল্প নেই। আসলে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে হলে উভয় পক্ষ থেকেই দায়িত্বশীল কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে। স্রোতের মতো হকাররা আসতে থাকবে আর তারা ফুটপাতে ব্যবসা–বাণিজ্য করবে, তারপর পুনর্বাসনের দাবি তুলবে, এটি কখনো বাস্তবসম্মত নয়। হকার স্থায়ী পুনর্বাসনের এই মানবিক দিকটি বিবেচনা করা দরকার। এ জন্য চাই সুস্পষ্ট নীতিমালা। কারা প্রকৃত হকার তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে। একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। এ জন্য সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। কাজেই এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে পথচারী–হকার উভয় পক্ষের স্বার্থই রক্ষা হয়। গণসচেতনতা বাড়ানোর জন্য ফুটপাত দখলকারী ব্যবসায়ীদের দোরগোড়ায় যেতে হবে। তাদের পথচারীদের অধিকার সম্পর্কে বুঝিয়ে বলতে হবে। আবার অনেক এলাকার রাস্তার ফুটপাত সংকীর্ণ, ভাঙাচোরা, কোথাও কোথাও এমন সংকীর্ণ যে একজন মানুষও হাঁটতে পারে না। ফুটপাত সংকীর্ণ করা নয় বরং প্রয়োজন হলে আরো প্রশস্ত করতে হবে। কোথাও আবার সড়কের সঙ্গে ফুটপাত মিশে একাকার হয়ে গেছে। এ ধরনের ফুটপাত ঝুঁকিপূর্ণ। রাজধানীতে একটি বেপরোয়া বাস ফুটপাতে উঠে এক মহিলার মৃত্যু ঘটায়। পথচারীদের অবাধ যাতায়াতের সুবিধার জন্য সেগুলো মেরামত করার মাধ্যমে পথচারী হাঁটার উপযুক্ত করা প্রয়োজন। জনবহুল বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে সাড়ে ছয় মিটার ফুটপাত রাখার মানদণ্ড নির্ধারণ করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। যেখানে চার মিটার পথচারীদের জন্য, সবুজায়ন ও বিশ্রামের জন্য দেড় মিটার। অথচ এদেশে কোথাও বিশ্ব মানদণ্ড অনুসরণ করে ফুটপাত নির্মাণ হচ্ছে না। মেইন রোডে ট্রাফিক জ্যাম থাকলে অনেক মোটরবাইক চালক মোটরবাইকটি ফুটপাতে উঠিয়ে দিচ্ছেন নির্দ্বিধায়। অনেক সময় এই দৃশ্যটি দেখা যায়, এটা যেন সাধারণ ব্যাপার। তারা একবারও ভেবে দেখেন না, এরকম পরিস্থিতিতে অপর দিক থেকে হেঁটে আসা মানুষ কী রকম অবস্থায় পড়তে পারে। তাছাড়া স্কুলে যাওয়া ছোট ছোট শিশুর হাঁটাও ঝুঁকিপূর্ণ। আচমকা মোটরবাইকের হর্ন বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ছোটাছুটি করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। কখনো প্রাইভেট গাড়ি পার্কিং করে ফুটপাত দখল। আবার কিছু কিছু ডেভেলপারদের ইমারত নির্মাণে বিস্ময়কর কর্মযজ্ঞ এখন সাধারণ একটি চিত্র। এসব নির্মাণাধীন ইমারতের কাজ চালানোর জন্য ইট, বালু, রড, সুরকি, লোহার গ্রীল ও অন্যান্য সামগ্রী রাখার জন্য ফুটপাত ও সামনের রাস্তাটুকুই প্রধান এবং একমাত্র স্থান। মাঝে মধ্যে বিকট শব্দে মেশিন চালিয়ে ওখানেই খোয়া ভাঙানো হয়। কিন্তু হাঁটার পথ সরু হয়ে যাওয়ার বিষয়ে তাদের দৃষ্টি থাকে না। ফুটপাত দখল করার প্রক্রিয়া আপাতদৃষ্টিতে সরল হলেও কার্যত বেশ অভিনব। কিছু কিছু দোকানদার তাদের সামগ্রী সমেত শোকেসগুলো সরাসরি দোকানের সামনেই ফুটপাতের ওপর নামিয়ে দেন। আবার, কোনও কোনও দোকানদার দোকানের মেঝের সঙ্গে কাঠ বা লোহার পাটাতন জুড়ে দেন। যেগুলো ফুটপাতের উপর ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। এভাবে অবৈধভাবে ফুটপাত দখলে থাকায় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন পথচারীরা। তখন বাধ্য হয়ে হাঁটতে হয় মূল সড়ক দিয়ে। যার ফলে অনেক সময় ঘটে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। ফুটপাত ব্যবহারের পাশাপাশি জেব্রা ক্রসিংও সড়কে দুর্ঘটনা এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পথচারীদের নিরাপদে সড়ক পার হওয়ার জন্য সাদা দাগ কেটে জেব্রা ক্রসিং তৈরি করা হয়। কিন্তু নগরীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, যেসব স্থানে জেব্রা ক্রসিং আছে, সেখানে এর ব্যবহার তেমন নেই। অনেক জায়গায় ক্রসিংয়ের সাদা দাগের ওপরেই যানবাহন থেমে থাকছে। অধিকাংশ ড্রাইভার জানেনই না জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি থামাতে হয়। জেব্রা ক্রসিংয়ের কাছাকাছি এলে গাড়ির গতি কমানোর নিয়ম। পথচারীরা পারাপারের সময়েও চালক যানবাহন না থামিয়েই দ্রুত চলে যায়। অনেক সময় জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী তোলা হয় যানবাহনে। জনগণের নিরাপদে হাঁটার জন্য ফুটপাত, রাস্তা পারাপারের জন্য ফুট ওভারব্রীজ বা জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার উপযোগী রাখতে সিটি কর্পোরেশন এবং ট্রাফিক আইন শঙ্খলা রক্ষার্থে ট্রাফিক পুলিশ সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এর দ্বায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের প্রবিধান, মোটরযান আইন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬ এবং ঢাকা সিটি ম্যানুয়াল–১৯৮২ ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত রাখতে বলা হয়েছে এবং ফুটপাত পথচারীদের হাঁটার জন্য উপযোগী করার কথাও উল্লেখ রয়েছে। স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এ পথচারীদের অগ্রাধিকার বিষয়ে তৃতীয় তফসিলের ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, পথচারী যেন পথ চলতে বিপদগ্রস্ত না হয় এবং নিরাপদে ও অনায়াসে পথ চলতে পারে, সেজন্য কর্পোরেশন প্রবিধান দিয়ে যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। পথচারীদের যেন কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্য রয়েছে মোটরযান আইন ১৯৮৩। এ আইনে অসাবধানে কিংবা বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালনা, প্রকাশ্য স্থানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে জরিমানার বিধান আছে। পথচারী পারাপারের নির্ধারিত স্থানে কিংবা ঠিক পাশ দিয়ে ওভারটেকিং নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এসব স্থানে ওভারটেক করলে ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল করার কথা বলা আছে। ভুল স্থানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে পায়ে চলা পথ বন্ধ করা, রাস্তায় বা সাধারণ মানুষ চলাচল করে এমন পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, কোনো পশু বা যানবাহন ভাড়া দেওয়া বা বিক্রি করার জন্য প্রদর্শন করা, রাস্তায় যানবাহন মেরামত করা, রাস্তায় উৎপাত ইত্যাদি ঘটনাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ফুটপাত যেহেতু হেঁটে চলাচলের জন্য। তাই পথচারীদের এই নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা পাওয়া জরুরি। তার জন্য সিটি কর্পোরেশনের দ্বায়িত্বশীল ভূমিকা অব্যাহত রাখতে হবে। এখানে আরেকটা কথা বলে রাখি সময়ের চেয়ে আমাদের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। নিরাপদ রাস্তা পারাপারে জনগণকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হতে হবে। সবাই সচেতন হয়ে ফুট ওভারব্রীজ/জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করি এবং ফুটপাত সমস্যার সমাধান করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনার হারও অনেক কমে যাবে। আমাদের হাঁটার পথ হোক নিরাপদ।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।