দু’হাজার তেইশের এপ্রিলে প্রকাশিত হয় মুরাকামির সর্বশেষ উপন্যাস ‘মাচি তো সোনো ফুতাশিকা না কাবে’। আর দু’হাজার চব্বিশের নভেম্বরে ফিলিপ গ্যাব্রিয়েলের অনুবাদে প্রকাশিত হয় সেই উপন্যাসের ইংরেজি সংস্করণ ‘দ্য সিটি এন্ড ইটস্ আনসার্টেইন ওয়ালস্’। ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশের অব্যবহিত পরপরই তার সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতা করেন দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার জন সেলফ্। সেই সাক্ষাৎকারের বাংলায়ন রইল সাহিত্য সাপ্তাহিকীর পাঠকদের জন্য ।
জন সেলফ্: ঊনিশ’শ আশি সালে রচিত বড়গল্প থেকে একই শিরোনামের উপন্যাস ‘দ্য সিটি এন্ড ইটস্ আন সার্টেইন ওয়ালস্’ এর জন্ম। নতুন পাঠকদের কাছে গল্পটি উপন্যাস আকারে তুলে ধরা কেন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
হারুকি মুরাকামি: এই কাজটিই ছিল আমার করা এমন একটি কাজ, যা আমি কখনও ইতোপূর্বে বই আকারে পুনর্মুদ্রণ করার অনুমতি দিইনি। আবার গল্পটি নিয়েও খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলাম না। আমি জানতাম যে গল্পের বিষয়বস্তুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমি মনে করি ওই সময়টায় আমার লেখার দক্ষতার সীমাবদ্ধতার কারণে তা সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারিনি। ফলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করব যতদিন না আমি প্রয়েজনীয় দক্ষতা অর্জন করছি এবং তারপর পুরো গল্পটি নতুনভাবে লিখব। এরপর, আমি অন্যান্য অনেক কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে এটিও শুরু করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। ততদিনে দেখি চল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে (যেন এক ঝটকাতেই), এবং আমি ৭০–এর কোঠায় পৌঁছে গেছি। তখন ভাবলাম, সত্যিই যদি এটি করতে চাই, তবে এখনই শুরু করা উচিত, কারণ সময় তো সীমিত। তাছাড়া একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করছিলাম।
জন: বইটি লকডাউনের সময় লিখেছিলেন এবং স্বভাবতই সেই সময় খুব কমই ঘর থেকে বেরুতে পেরেছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই ধরনের লেখার অভ্যাস কি গল্পের সুর বা বিষয়বস্তুকে প্রভাবিত করেছে?
মুরাকামি: বটেই, এই উপন্যাসটি লেখার সময় আমার প্রচুর পরিমাণে শান্ত এবং নীরব সময়ের প্রয়োজন ছিল। দেয়ালঘেরা শহরের পরিস্থিতি আসলে বিশ্বব্যাপী লকডাউনের রূপক বলতে পারেন। কীভাবে চরম বিচ্ছিন্নতা এবং উষ্ণ সহানুভূতির অনুভব একইসঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে, এটিই ছিল এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান বিষয় এবং এই দৃষ্টিকোণ থেকে এটি পুরনো গল্পটির তুলনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলেই মনে হয়।
জন: অনেক জাপানি পাঠক বইটি পড়ে খানিকটা বিভ্রান্ত হয়েছেন। আবার অনেকেই এর বিস্ময়কর এবং অতিপ্রাকৃত উপাদানগুলোকে আপনার উপন্যাসের অন্যতম আনন্দ হিসেবে মনে করেন। আপনি কি পাঠকদেরকে কিছু প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে থাকতেই পছন্দ করেন?
মুরাকামি: আমি মনে করি একটি চমৎকার উপন্যাস সবসময় কিছু প্ররোচনামূলক প্রশ্ন উত্থাপন করবে– কিন্তু একটি সুনির্দিষ্ট, সরল সমাধান দেবে না। আমি চাই পাঠকরা আমার বইগুলো পড়া শেষ করে এমন কিছু ভাবুক। যেমন, এখানে কী কী শেষ হতে পারত? প্রতিটি গল্পের মধ্যে আমি কিছু ইঙ্গিত দিই যাতে পাঠকরা সেগুলো ধরে নিজেদের মতো করে একটি অনন্য সমাপ্তির কল্পনা করতে পারেন। অনেক পাঠক আমাকে লিখেছেন: “আমি আপনার একই বই বারবার পড়ে একই আনন্দ পেয়েছি।” একজন লেখক হিসেবে এটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আহ্লাদিত করে।
জন: যখন আপনি উপন্যাসের এমন কোনও চরিত্রকে দাঁড় করাচ্ছেন, যেমন “দ্য সিটি এন্ড ইটস্ আন সার্টেইন ওয়ালস্”–এর বর্ণনাকারী, বা “দ্য উইন্ড–আপ বার্ড ক্রনিকল”–এর তোড়ু বা “কাফকা অন দ্য শোর”–এর কাফকা, তখন তা কতটা আপনার নিজের কথা বলে?
মুরাকামি: আমার উপন্যাসের উত্তম–পুরুষ চরিত্রগুলো, জোর দিয়েই বলছি, প্রকৃত আমি নই…তবে আমিও এমন একজন হতে পারতাম! এই সম্ভাবনাগুলো অন্বেষণ করা দুর্দান্ত, কারণ নিজেকে ছাড়া অন্য কারও মতো হওয়ার সুযোগ জীবনে বেশি আসে না।
জন: আপনি জাপানি ভাষায় অনেক ইংরেজি লেখকের অনুবাদ করেছেন, যেমন স্যালিঞ্জার, ফিৎজেরাল্ড, চ্যান্ডলার, কার্ভার এবং ক্যাপোয়তে। এদের মধ্যে কার রচনা আপনার কাছে সবচেয়ে অর্থবহ?
মুরাকামি: প্রতিজন লেখকই আমাকে প্রভাবিত করেছেন। ফিৎজেরাল্ড এবং ক্যাপোয়তের উজ্জ্বল, দীপ্তিময় লেখনশৈলী আমাকে খুব টানে, যদিও তা আমার শৈলীর থেকে পুরোপুরি আলাদা। ব্যক্তিগতভাবে, আমি চ্যান্ডলারের শৈলী খুব পছন্দ করি।
জন: জাপানের সাহিত্য পটভূমিকায় গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে আপনি লেখালেখি ও প্রকাশনার সাথে যুক্ত আছেন, সাহিত্যিক বাতাবরণ কতটা বদলেছে এই সময়ে, এবং আপনি কি নিজেকে এর অংশ মনে করেন, না–কি এর বাইরে?
মুরাকামি: আমি মনে করি তরুণ লেখকরা আজকাল ‘‘এই–ই হচ্ছে সাহিত্যের মাপকাঠি’’–এর মতো ভণ্ডামিপূর্ণ ধারণাকে একপাশে রেখে তুলনামূলকভাবে আরও স্বাধীন ও নমনীয়ভাবে কথাসাহিত্য রচনা করছেন। আমি সত্যিই এর প্রশংসা করি। তবে আমার ক্ষেত্রে, আমি শুধু নিজের মতো করে কাজ করে যাচ্ছি, এবং এই সাহিত্য পটভূমির পরিবর্তনের সাথে আমার কী বা কতটুকু সম্পর্ক রয়েছে সেটা বুঝতে পারি না।
জন: আপনার পাঠকগোষ্ঠীদের মধ্যে, জাপানে এবং আন্তর্জাতিকভাবে, কী ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন, এবং এটি কি আপনার জন্য লেখালেখি সহজ করেছে, নাকি কঠিন?
মুরাকামি: জাপানে এবং আন্তর্জাতিকভাবে, আমার পাঠকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে বলে মনে হয়, এবং আমি প্রায়ই এই সংখ্যাগুলো দেখে বিস্মিত হই। লাওসে একজন থাই পাঠক আমাকে ডেকে থামিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন, ড্রেসডেনে একজন আলবেনিয়ান পাঠক ছিলেন, আর টোকিওতে দেখা হয়েছিল এক ইন্দোনেশিয়ার পাঠকের সঙ্গে। প্রায়ই মনে হয় আমি যেন আর বাস্তব আমি নই, বরং কোনো কাল্পনিক চরিত্রে পরিণত হয়েছি…তবে এসবের কিছুই লেখালেখিকে সহজ বা কঠিন করে তুলতে পারেনি। আমি কেবল কৃতজ্ঞ যে এত মানুষ, যা আমি কখনো কল্পনাও করিনি, আমার বই পড়েছেন। সবাই আমার মতো এমন সৌভাগ্যবান নয়।
জন: জাপানি কথাসাহিত্য এখন ব্রিটেনে বিক্রি হওয়া সমস্ত অনূদিত কথাসাহিত্যের এক–চতুর্থাংশ দখল করে আছে। আপনি কী মনে করেন, এমন দারুণ জনপ্রিয়তা কেন?
মুরাকামি: আমি জানতাম না যে জাপানি উপন্যাস ব্রিটেনে এত জনপ্রিয়! কী কারণ হতে পারে? আমার কোনো ধারণা নেই। হয়তো আপনি আমাকে বলতে পারবেন–আমি জানতে চাই। জাপানের অর্থনীতি আজকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, এবং আমি মনে করি সাংস্কৃতিক রপ্তানি কোনো না কোনোভাবে অবদান রাখতে পারে, যদিও সাহিত্যিক রপ্তানি অর্থনীতিতে খুব বেশি অবদান রাখে না, তাই না?
জন: শেষ প্রশ্ন; দু’হাজার সতের সালে মিয়েকো কাওয়কামি আপনার গল্প–উপন্যাসের নারী– চরিত্রদের নিয়ে যে সমালোচনা করেছিলেন, তা কি আপনার লেখার ধরনে কোনো প্রভাব ফেলেছিল?
মুরাকামি: আমার গল্প–উপন্যাস বছরের পর বছর ধরে এত বেশি সমালোচিত হয়েছে যে আমি মনে করতে পারি না কোন প্রসঙ্গে সেসবের সমালোচনা করা হয়েছিল। এবং আমি সেগুলোর দিকে খুব বেশি মনোযোগ দিই না। মিয়েকো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান, তাই আমি নিশ্চিত তিনি যে সমালোচনাই করেছেন, তা যথার্থ ছিল। তবে সত্যি বলতে, আমি সঠিকভাবে মনে করতে পারি না তিনি কী সমালোচনা করেছিলেন। আর গল্প–উপন্যাসের নারীচরিত্র প্রসঙ্গে এবং আমার কাজের প্রসঙ্গে বলতে গেলে, আমার পাঠকরা নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রায় সমানভাবে বিভক্ত, যা আমাকে অত্যন্ত আনন্দিত করে।