পর্ব ১
প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে এক’শ জন প্রভাবশালী ও অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর নাম ঘোষণা করে বিবিসি। বিবিসি হানড্রেড উইম্যান কার্যক্রমের যাত্রা শুরু হয় দু’হাজার বারো সালে ভারতের দিল্লিতে সংঘটিত গণধর্ষণের অব্যবহতি পরপরই। বিবিসির কন্ট্রোলার লিলিয়েন ল্যান্ডর, সম্পাদক ফিওনা ক্র্যাক এবং সমমনা নারী সাংবাদিক তথা মানুষেরা মিলে এই উদ্যোগটি হাতে নেয় যাতে নারীদের জীবনের উপর ঘটে যাওয়া নানান বৈষম্য–অত্যাচার উঁজিয়ে সফল যারা তারা যেনো গণমাধ্যমে তাদের প্রাপ্য সম্মান এবং ভুক্তি পায়। আর তাই প্রতি বছর বিবিসি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একশ জন প্রভাবশালী ও অনুপ্রেরণাদায়ক নারীর নাম ঘোষণা করে এবং তাদের গল্পগুলো গণমাধ্যমের সঙ্গে ভাগ করে নেয়। কিন্তু কীভাবে নির্বাচিত হন নারীরা? শুরুতেই বিবিসি হান্ড্রেড উইম্যান টিম একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে, যা গবেষণার মাধ্যমে এবং বিবিসির ৪১টি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ল্যাংগুয়েজ টিম ও বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশনের পরামর্শের ভিত্তিতে চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করা হয়। সম্পাদক মন্ডলীদের মতে, ‘‘আমরা এমন প্রার্থীদের খুঁজেছি যারা গত বারো মাসে খবরের শিরোনামে এসেছেন বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রভাব রেখেছেন। পাশাপাশি যাদের কাছে অনুপ্রেরণাদায়ী গল্প রয়েছে বা যারা উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন করেছেন এবং তাদের সমাজে এমনভাবে প্রভাব রেখেছেন যা হয়তো খবর হিসেবে আসেনি, কোথাও আলোচিত হয়নি।’’
এ–প্রসঙ্গে জানা যায়, এ বছর Resilience বা ‘দৃঢ়তা’র থিমের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। রেজিলিয়েন্স বা দৃঢ়তা মূলত সংকটের মুখে লড়াই করার সক্ষমতা এবং সহনশীলতাকে বুঝানো হয়। সারা বিশ্বজুড়ে নারীদের ওপর সফল নারীদের এ–বছরের প্রভাবকে স্বীকৃতি দিতে এমন নারীদের নির্বাচন করা হয়েছে যারা তাদের দৃঢ়তার মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করছেন এবং স্থানীয় বা বৈশ্বিক পর্যায়ে জীবনমান উন্নত করতে সচেষ্ট আছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে মাথায় রেখে জলবায়ু পরিবর্তন ক্ষেত্রে কাজ করছেন এমন নারীদের নামও যাচাই করা হয়েছে, যার মধ্যে দিয়ে জলবায়ু বিষয়ে অগ্রদূত এবং অন্যান্য পরিবেশগত নেতাদের একটি দলও নির্বাচন করা হয়েছে। অর্থাৎ উদ্যোগটি সমাজের সব অংশ ও রাজনৈতিক মতামতের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং ভিন্ন ধারার মতামত তৈরি করছে এমন নারীদেরকেই নির্বাচিত করে থাকে। পাশপাশি অঞ্চলভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে চূড়ান্ত নামগুলো নির্বাচন করা হয়েছে। জলবায়ু কর্মী’র পাশাপশি আরও কয়েকটি ক্যাটাগরি যেমন সংস্কৃতি ও শিক্ষা, বিনোদন ও ক্রীড়া, রাজনীতি ও অ্যাডভোকেসি, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি থেকেও নির্বাচিত হন নারীরা। এমনকী নাম প্রকাশের আগে তালিকায় থাকা সকল নারীর সম্মতিও নেওয়া হয়েছে।
এ–সব নিয়েই গত তিন ডিসেম্বর ২০২৪–এ ঘোষিত হলো এবারের এক’শ জন নারীর তালিকা। তাদের মধ্যে রয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী নাদিয়া মুরাদ, দীর্ঘ সময় ধ’রে চলতে থাকা ধর্ষণের হাত থেকে বেঁচে ফেরা ক্যাম্পেইনার জিসেল পেলিকট, অভিনেত্রী শ্যারন স্টোন, অলিম্পিয়ান রেবেকা আন্দ্রাদে ও অ্যালিসন ফেলিঙ, গায়িকা রে, ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট ট্রেসি এমেন, জলবায়ু প্রচারক আদেনিকে ওলাদোসু এবং লেখিকা ক্রিস্টিনা রিভেরা গার্সা। আছেন বাংলাদেশের রিক্তা আক্তার বানু। আগামী কয়েকটি পর্বে বিধৃত এই প্রতিবেদনটির আজকের প্রথম পর্ব শেষ করব বাংলাদেশি এই গুণী নারীর গল্প দিয়ে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত অঞ্চল কুড়িগ্রামের চিলমারীতে বাস করেন নার্স রিক্তা আক্তার বানু। ওই দিককার মানুষেরা অটিস্টিক বা প্রতিবন্ধী শিশুকে অভিশাপ হিসেবে দেখে। রিক্তা আক্তারের নিজের অটিস্টিক এবং সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত কন্যাকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে নিয়ে যান তিনি কিন্তু স্কুল সেই কন্যাকে ভর্তি নিলো না! রোখ চাপে রিক্তার, নিজের জমি বিক্রি করে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন ‘‘রিক্তা আক্তার বানু লার্নিং ডিজেবিলিটি স্কুল’’। সেই স্কুলে এখন ৩০০ শিক্ষার্থীর মিলনমেলা যা প্রতিবন্ধীতার প্রতি সমাজের মনোভাব পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্কুলটি প্রাথমিকভাবে অটিস্টিক বা শিক্ষামূলক কিছু শেখার প্রতিবন্ধকতায় থাকা শিশুদের জন্য নির্মিত হলেও এখন এটি বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিমত্তা ও শারীরিক প্রতিবন্ধীতায় আক্রান্ত শিশুদের জন্যও সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। জয়তু রিক্তা আক্তার বানু! উদযাপিত হোক নারী শক্তি!