কাজ শেষ হওয়ার আগেই উদ্বোধন করা চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে ‘দৃষ্টিনন্দন ও দৃষ্টিগোচর’ করতে বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রস্তাবিত ১০ সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি ১০ মাসেও। তবে একটি সুপারিশের আলোকে শহীদ মিনার চত্বরে ওঠার র্যাম্প প্রশস্ত করা হচ্ছে। বাকি সুপারিশগুলোর বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের জুন মাসে। এসময়ের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা না পেলে বাকি সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।
এদিকে নির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার দৃশ্যমান নয় দাবি করে বিভিন্ন সময়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীরা। তারা প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ছাড়া এ শহীদ মিনারে ফুল দিতে আপত্তি জানান। তাই গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেননি তারা। এ তালিকায় ছিলেন তৎকালীন সিটি মেয়রও। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পরিবর্তে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল প্রাঙ্গণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) নির্মিত শহীদ মিনারে জাতীয় দিবসগুলোতে শ্রদ্ধা জানান তারা। এ অবস্থায় ঘনিয়ে আসছে ১৬ ডিসেম্বর বা বিজয় দিবস। এদিন সংস্কৃতিকর্মীরা কোথায় শ্রদ্ধা জানাবেন তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নগরের কাট্টলীতে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানো হবে। এর আগে গত ২৬ মার্চও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সেখানে শ্রদ্ধা জানানো হয়। তবে তাতে যোগ দেননি তৎকালীন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।
এ বিষয়ে চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, সুপারিশগুলো দেখে মনে হয়েছে সেখানে অনেক কাজ বাকি আছে। রোববার অফিসে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে বসব। যারা কাজ করছেন তাদের সাথেও কথা বলব। যদি ১৬ ডিসেম্বরের আগে কমপ্লিট করতে পারে তাহলে সেখানে শ্রদ্ধা জানানো হবে। জেলা প্রশাসকের সাথে আমার কথা হয়েছে, তারা কাট্টলীতে আয়োজন করছেন। যদি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রস্তুত না হয় সেক্ষত্রে ওখানে অংশ নেব।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক টাকা খরচ করে এটা নির্মাণ করা হয়। সেটা ব্যবহার না করে ফেলে রাখলে তো হবে না। বিজয় দিবসে সম্ভব না হলে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি সেখানে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করব।
উল্লেখ্য, সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পালন করা হয় বিজয় দিবসের কর্মসূচি। এরপর একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর পুরনো কাঠামোটা ভাঙার কাজ শুরু হয়। একইসঙ্গে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল প্রাঙ্গণে অস্থায়ী শহীদ মিনার করে চসিক।
জানা গেছে, ২৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পের কাজ চলছে। আগামী বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ আছে। এ প্রকল্পের আওতায় পুরনো শহীদ মিনারের আদল ঠিক রেখে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন শহীদ মিনার ও উন্মুক্ত গ্যালারি। এছাড়া পুরনো পাবলিক লাইব্রেরি ভেঙে ১৫ তলা গণগ্রন্থাগার ভবন ও পুরনো মুসলিম হল ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছে ৮ তলা ভবন। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর এ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও তখন পর্যন্ত পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি।
বাস্তবায়ন না হওয়া ১০ সুপারিশ : উদ্বোধনের পর চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীরা নবনির্মিত শহীদ মিনারের বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরেন। বিষয়টি নিয়ে ২০২৩ সালের ১৮ নভেম্বর ও ২ ডিসেম্বর দুটি সভা হয়। সভাগুলোতে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন মেয়রও। সভায় শহীদ মিনার দৃশ্যমান না হওয়ার জন্য নবনির্মিত মুসলিম ইনস্টিটিউট ও গণগ্রন্থাগার ভবনের সঙ্গে শহীদ মিনারকে যুক্ত করা ২১ ফুট উঁচু প্লাজাকে দায়ী করা হয়। এ কারণে নিচের সড়ক থেকে প্লাজার উপরে থাকা শহীদ মিনার দৃশ্যমান নয় বলে দাবি করা হয়। সেটা ভেঙে ফেলারও দাবি ওঠে।
সংস্কৃতিকর্মীরা প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ছাড়া এ শহীদ মিনারে ফুল দিতে আপত্তি জানান। এরপর শহীদ মিনারকে আরো দৃষ্টিনন্দন ও দৃষ্টিগোচর করা এবং সর্বশ্রেণির মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের উপযোগী করতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানে চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি একটি কমিটি করা হয়। বিশেষজ্ঞ এ কমিটি ৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে ১০টি সুপারিশ করা হয়।
কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সিটি মেয়র। সমন্বয়ক ছিলেন নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার। সদস্যরা হচ্ছেন– স্থপতি আশিক ইমরান, স্থপতি জেরিনা খান, প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, স্থপতি সোহেল মোহাম্মদ শাকুর ও স্থপতি আবদুল্লাহ আল ওমর।
সুপারিশগুলোর মধ্যে আছে– শহীদ মিনারের বেদিটি বর্তমান স্থান থেকে আরো ১ দশমিক ৫ ফুট উঁচু করা। জাতীয় দিবসগুলোতে সাধারণ জনগণের নিরাপদে শ্রদ্ধা নিবেদনের সুবিধার্থে প্রকল্পের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে একটি নতুন র্যাম্প নির্মাণ এবং র্যাম্পের পেছনে দক্ষিণ পাশে কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, শিমূল জাতীয় দেশীয় গাছ লাগানো। র্যাম্পের সামনে একটি এসেম্বলি করা ও র্যাম্পের সাইড ওয়াল দুটিতে গাঁথুনি না করে ট্রান্সপারেন্ট রাখা যাতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধক না হয়ে শহীদ মিনার দেখা যায়। পূর্বের শহীদ মিনারের বৃহৎ পরিসর শহীদ মিনারের দর্শনার্থী বা সকল নাগরিকের একত্রিত (এসেম্বল) করার জন্য অগ্রভাগ হিসাবে উন্মুক্ত সবুজ পরিসর হিসাবে সংরক্ষণ করা।
শহীদ মিনারের পার্শ্বস্থ দুটি দেয়াল শহীদ মিনার দেখতে বাধাগ্রস্থ করায় দেয়াল দুটি অপসারণের সুপারিশ করা হয়। এছাড়া ১৯৭৪ সালে স্থাপিত মূল শহীদ মিনারের মূল স্থপতি আহমদ জিল্লুর চৌধুরীর পরামর্শ অনুযায়ী শহীদ মিনারের চারটি স্তম্ভের উচ্চতা বাড়ানো, প্লাজার দুইপাশের দেয়ালগুলোর উচ্চতা কিছুটা হ্রাস করা অথবা পারফোরোটেড টাইপ করে দৃশ্যমান করা, দক্ষিণ পূর্বের উন্মুক্ত মঞ্চের স্ট্রেজের পিছনে গ্রিনরুমের দেওয়ালের উচ্চতা ফ্লোর লেভেল থেকে ৬ ফুট বা স্ট্রেজ হতে ৪ ফুট রেখে অবশিষ্ট অংশ অপসারণ, লিলিপন্ড ওয়াটারবডি অপসারণ, মূল বেদীর দুই পাশে বাকানো গার্ডেন ওয়ালের উচ্চতা কমানো এবং পূর্ব পাশের প্রবেশ র্যাম্প ও সিঁড়ির মাঝস্থলের দেওয়াল অপসারণ করে পূর্ণাঙ্গ র্যাম্প করার সুপারিশ করা হয়। আজ ১০ মাস পূর্ণ হলেও ওইসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি।
এ বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের (সার্কেল–১) নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল হাসান খান আজাদীকে বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। মন্ত্রণালয় থেকে র্যাম্প প্রশস্ত করার নির্দেশনা দেয়া হয়; সে আলোকে প্রশস্ত করা হচ্ছে। র্যাম্প আগে ৫ ফুট ছিল, এখন ১০ ফুটে উন্নীত করা হবে।
বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ওগুলো আমি পেয়েছি। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছাড়া তো বাস্তবায়ন করতে পারব না। যদি মন্ত্রণালয় বলে করে ফেলা যাবে। তবে যাই করি না কেন আগামী জুনের মধ্যে করতে হবে। এরপর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আর পারব না।
বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য স্থপতি আশিক ইমরান আজাদীকে বলেন, সুপারিশগুলো মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা ছিল। সম্ভবত মেয়র পরে পাঠাননি। যেহেতু একটা জিনিস হয়ে গেছে সেটা ব্যবহার না করে ফেলে রাখা ঠিক হবে না। আমরা যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা উচিত। একইসঙ্গে চাইলে এখানে শ্রদ্ধা জানাতে পারে।
এদিকে চসিকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজাদীকে জানিয়েছেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পের উদ্বোধন করে ফেলায় মেয়র লিখিতভাবে এটার ত্রুটি মন্ত্রণালয়কে জানাতে চাননি। তাই ডিও প্রস্তুত হলেও শেষ পর্যন্ত পাঠাননি। মেয়র চেয়েছিলেন মৌখিকভাবে জানাবেন। এরপর ওরা যদি লিখিত ডিমান্ড করে তখন পাঠাবেন। কিন্তু পরে বিষয়টি ওইভাবেই পড়েছিল।