গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, ‘নির্বোধ বন্ধু আদৌ কোনো বন্ধু নয়। নির্বোধ বন্ধু থাকার চেয়ে একা হওয়া অনেক ভালো’। ভাগ্যিস চুলু ফার–ইস্ট অভিযান থেকে কাঠমান্ডু ফিরে সেদিন একা থাকতে হয়নি। উপরি হিসেবে সাথী ছিল দুই সুবোধ বাবর এবং শাওন। দেশে ফেরার আগে হাতে কয়েকদিন সময় আছে। এই কদিন কী করা যায় ভাবছি এমন সময় বাবর প্রস্তাব করল, ‘চলেন লুম্বিনি যাই’। বুদ্ধ একদা বলেছিলেন, ‘বন্ধুর সাথে অন্ধকার রাস্তায় চলা, আলোকজ্জ্বল রাস্তায় একা চলার থেকে অনেক ভালো’। তাই প্রস্তাব পেয়েই আমরা সানন্দে রাজি।
টিকেট করার গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত হলো শাওনের উপর। সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ! গিয়ার ব্রো’র এই নিয়ে প্রশ্নের ফুলঝুরি যেন শেষই হয় না। আর এদিকে বাবর গোঁ ধরেছে টিকেট করতে হবে শাওনকেই। অবশেষে বাবরের জেদই জয়ী হলো। এভারেস্ট সামিট, থুক্কু লুম্বিনি যাত্রার টিকেট জোগাড় করল শাওন। রাতের বাসে চড়ে এবড়োথেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে পরদিন ভোরেই পৌঁছে গেলাম লুম্বিনি। সুন্দর ভোরটা খানিকটা অসুন্দর করতেই বাস থামতেই হাজির বিভিন্ন হোটেলের অযাচিত প্রতিনিধি দল। এত সুখ আবার আমাদের সয় না। তাই এদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে একটু সরে গিয়ে নিজেরাই বেছে নিলাম আবাস। ছিমছাম শান্ত পরিবেশ। হোটেল না বলে একে বাড়িই বলা চলে। স্নান সেরেই বেরিয়ে পড়লাম লুম্বিনি দর্শনে।
বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্মস্থান এই লুম্বিনি। গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান এবং জন্ম নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকলেও লুম্বিনির পালেই লেগেছে সবচেয়ে বেশি হাওয়া। এই স্থানেই শাক্য বংশের রাজা শুদ্ধোধনের স্ত্রী মহারানি মায়াদেবী ৬২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম দিয়েছিলেন। শাক্য রাজধানী কপিলাবস্তু থেকে বাবার বাড়ি যাওয়ার পথে লুম্বিনি বনে একটি শালগাছের নিচে গৌতম বুদ্ধকে জন্ম দেন মায়াদেবী। জন্মের আগে তিনি একটি দিঘিতে স্নান করেন এবং জন্মের পরে গৌতমকেও সেই দিঘিতে স্নান করানো হয়। এই দিঘিটি পবিত্র পুষ্করিণী হিসেবে খ্যাত। শুধু জন্মগ্রহণই নয়, বোধি প্রাপ্তির পরও সিদ্ধার্থ লুম্বিনিতে এসেছিলেন বলে কথিত আছে। স্বাভাবিকভাবেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য এক পরম পবিত্র মহাতীর্থ এই লুম্বিনি এবং চারটি ‘মহাতীর্থ স্থান’ এর অন্যতম। অন্য তিনটি হলো কুশিনগর, বুদ্ধগয়া এবং সারনাথ। তিনি লুম্বিনিতে জন্মগ্রহণ করেন, বুদ্ধগয়ায় বুদ্ধত্ব লাভ করেন, সারনাথে প্রথম ধর্মপ্রচার করেন এবং কুশীনগরে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। এছাড়াও লুম্বিনি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্ভুক্ত।
শুরুতেই দেখে নিতে চাই মায়াদেবী মন্দির। পাখির কলরবে সরব বাগানের মধ্য দিয়ে পথ পেরিয়ে যেতেই হাজির দুয়েকটা মঠ। দেখেই পা বাড়ালাম আসল গন্তব্যের দিকে। মন্দিরের আশপাশটাতে আমাদের মহাস্থানগড়, পাহাড়পুরের মতো কিছু ইটের স্থাপনার দেহাবশেষ ছড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। চারপাশটা বেশ সবুজ এবং পরিপাটি। আর মাঝে সাদা দালানে মায়াদেবী মন্দির। নির্বাণ লাভ কিংবা কামনা–বাসনা থেকে মুক্তি লাভে ঘটে দুঃখের অবসান, দূর হয় অজ্ঞানতা, মেলে পূর্ণ শান্তি–এমন দর্শনের প্রচারক এই তপস্বীর জন্মস্থানটা বেশ সুন্দর করেই সাজানো আছে মন্দিরে। সেখানে স্থাপিত আছে জন্মস্থান চিহ্নিতকারী পাথর। সেখান থেকে বের হতেই দেখি মা–সন্তানের স্নানধন্য সেই পবিত্র পুষ্করিণী। অতীতে কোনোকালে সেটা হয়ত দিঘি ছিল, কিন্তু এখন ছোট সুইমিংপুল আকারের জলাধারে পরিণত। পুকুরের ওপারে সেই প্রাচীন পবিত্র বোধিবৃক্ষ দৃষ্টিগোচর হতেই সেদিকে পা বাড়ালাম। হৃদয় শীতল করা স্থান হলেও শাখামৃগদের উৎপাতে বেশিক্ষণ বসা দুষ্কর। মন্দিরের অপর পাশে আছে ‘অশোক স্মারক স্তম্ভ’। প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত মৌর্য সম্রাট অশোক ২৪৯ খ্রিস্টপূর্বে এই তীর্থভূমি পরিদর্শনে এসেছিলেন। তাঁর আগমনের স্মারক হিসেবে এখানে স্থাপিত হয় ওই স্তম্ভ।
এই এলাকা পূর্ব ও পশ্চিম দুই ভাগে ভাগ করে রাখা হয়েছে। পূর্বদিকে রয়েছে থেরাভদিন বা স্থবিরবাদী বৌদ্ধদের মঠ। পশ্চিমদিকে রয়েছে মহাযান ও হীনযানপন্থী বৌদ্ধদের মঠ। প্রাচীন বেশ কয়েকটি মঠের ধ্বংসাবশেষও রয়েছে এখানে। রয়েছে বিশাল জলাধারের দুইপাশে হাঁটার জন্য শান বাঁধানো রাস্তা, বিশ্ব শান্তি স্তুপা, শিখা অনির্বান। মজার ব্যাপার হলো শিখার এপারে দাঁড়ালে দেখা যায় একই সমান্তরালে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি, যার ওপারেই শান্তি স্তুপা। আদতে সেটা আরও কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত। কিন্তু এসব এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে তৈরি হয় এই দৃষ্টি বিভ্রম। স্থানে স্থানেই দাঁড়িয়ে আছেন বুদ্ধ। কোথাও গম্ভীর মুখে, কোথাও হাসিমুখে। পুরো এলাকা জুড়েই নানা দেশ নির্মাণ করেছে নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসারে বুদ্ধ–মন্দির। শুনেছি বাংলাদেশও এখানে একটি বুদ্ধ–মন্দির নির্মাণ করবে। ভারতের বুদ্ধ–মন্দিরটি দেখে প্রমাদ গুনলাম। আমাদের দেশ বুদ্ধ–মন্দির তৈরির ঘটনা সত্য হলে এরচেয়ে যাতে মন্দ শৈলির না হয়!
এই বিশাল সংরক্ষিত এলাকার কোথাও কোনো দোকান, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করে এলাকার ভাবগাম্ভীর্য ক্ষুণ্ন করা নিষিদ্ধ। তবুও কিছু সুযোগ সন্ধানী হকারের উৎপাত আছে। তবে এই বঙ্গদেশের দর্শনীয় স্থান রঙ্গের সাথে তুলনা করলে তা খুবই নগন্য। পুরো এলাকাটাই বেশ নিরিবিলি। চারপাশের শোভা দেখে আত্মশুদ্ধি হতে যাবে এমন সময় পিলে চমকে উঠে মোবাইলে বাজতে থাকা হিন্দি গানের শব্দে। ফিরলেই দেখি কেউ গান ছেড়ে হাতে মোবাইল ধরে নাচছে। প্রায় সকল স্থানেই টিকটিক নিষিদ্ধ বলা থাকলেও বুদ্ধের ‘প্রাজ্ঞ ব্যক্তি কখনো নিন্দা বা প্রশংসায় প্রভাবিত হয় না’ বাণীর ভিন্নার্থ বের করে নেওয়া তারুণ্যকে রুখে দেওয়ার সাধ্য কার!
ওই এলাকা ছেড়ে বের হয়েছি শুধু ভোজন কার্যে। মূল সড়ক থেকে বেশ ভিতরে জুটে গিয়েছিল এক দিদি। প্রথমদিন ভোরেই আহার সারতে গিয়ে দিদির হাতের রান্নার স্বাদের এমন ভক্ত হয়ে গিয়েছি আমরা যে অন্য কিছু পরীক্ষা করার ভাবনা মাথাতেই আসতে দিলাম না। এভাবেই মায়াদেবীর মায়ায়, বোধিবৃক্ষের ছায়ায় কেটে গেল আমাদের দুটি দিন। কামনা–বাসনা থেকে মুক্তি তখনো অধরা, কারণ এবার আছে বাড়ি ফেরার তাড়া!