ছিলো গান ছিলো প্রাণ

সঞ্জীব চৌধুরীকে স্মরণ

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু | সোমবার , ২৫ নভেম্বর, ২০২৪ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

আমি তোমাকেই বলে দেব কী যে একা দীর্ঘ রাত

আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে

আমি তোমাকেই বলে দেব সেই ভুলে ভরা গল্প

কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরোজায়

ছুঁয়ে কান্নার রঙ, ছুঁয়ে জোছনার ছায়া

ছুঁয়ে কান্নার রঙ, ছুঁয়ে জোছনার ছায়া

এ যেন গভীর রাতের একাকী মনে গান গাইবার ও শোনার দারুণ গীতিকবিতা। সঞ্জীব চৌধুরীর লেখা এই গানটি আজও জনপ্রিয়। গায়ক হিসেবে তিনি যতোটা পরিচিত, নিবিষ্ট মনে কাজ করে গেছেন একজন সংবাদকর্মী হিসেবে। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে রাজপথে থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। আবার লিখেছেন গীতিকবিতা। একইসাথে তিনি ছিলেন সুরস্রষ্টা। ১৯৯৬ সালে বাপ্পা মজুমদারকে নিয়ে গড়া “দলছুট” ব্যান্ড দারুণ সাড়া ফেলে। রোমান্টিক এবং বক্তব্যধর্মী গানগুলো তরুণদের মাতিয়েছে। সেই সঞ্জীব চৌধুরী আকস্মিকভাবে চিরবিদায় নিলেন ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর।

এ যেন এলাম, দেখলাম, জয় করলাম, চলে গেলাম।

সঞ্জীব চৌধুরীর সৃষ্টিকর্মগুলো এক জায়গায় নথিবদ্ধ করার তাগিদ অনুভব করে দুইটি প্রকাশনা করেছেন আরেক সংগীতশিল্পী, সুরকার ও প্রকাশক জয় শাহরিয়ার। যিনি খুব কাছ থেকেই দেখেছেন সঞ্জীব চৌধুরীকে। তারই সাথে মেতেছিলেন গানে ও আড্ডায়। দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন নানান আলোচনায়। তাই জয় শাহরিয়ার বলেন, “আমার কাছে সঞ্জীব চৌধুরী একটি দর্শনের নাম। যে দর্শন ধারণ করবার চেষ্টা করি আমি এবং আমরা।” জয়ের এই কথায় সঞ্জীবকে নিয়ে আবারও নতুন করে জানার ইচ্ছে জাগে। মঞ্চ মাতানো এই তরুণ গায়কের দর্শন তাহলে কী?

অতি সামপ্রতিক কালে বাংলাদেশে সংগীত শিল্পীদের নিয়ে প্রকাশনার কাজটি শুরু হয়েছে। সংগীতের সাথে তো যুক্ত থাকেন একটি দল। গীতিকবি, সুরকার, বাদ্যযন্ত্রশিল্পী। একটি গানের নেপথ্যে থাকা এই মানুষদের নিয়ে এখন কাজ হচ্ছে। প্রকাশনা হচ্ছে। পাঠক হিসেবে জানার সুযোগ ঘটছে অনেক অজানা কাহিনী।

জয় শাহরিয়ার তার আজব প্রকাশ থেকে প্রকাশ করেছে দুটো বইসঞ্জীব চৌধুরীকে নিয়ে।

এক. তোমাকেই বলে দেব ( ২০২১, আজব প্রকাশ)

দুই. সঞ্জীবনামা ( ২০২৪, আজব প্রকাশ)

তোমাকেই বলে দেব

মোট ৪৮টি গীতিকবিতা নিয়ে প্রকাশিত এই বইটি বেশ সাড়া ফেলেছে। যারা গান গাইতে পছন্দ করেন, সংরক্ষণের জন্য ডায়েরিতে লিখে রাখেন– “তোমাকেই বলে দেব” বইটি মনের আশা পূরণ করবে। একজন সংগীত শিল্পী, সংগীতপ্রেমীর জন্য এই ধরনের প্রকাশনা গুরুত্ব রাখে। কথা হারিয়ে যাওয়ার ভয় যেমন থাকে না, তেমনি একজন শিল্পীর সৃষ্টিকর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।

সঞ্জীবনামা

বাংলাদেশের সংগীতশিল্পীদের জীবন ও কর্ম সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে যে কয়টি প্রকাশনা হয়েছে, তার মধ্যে “সঞ্জীবনামা” উল্লেখযোগ্য। এই বইতে স্মৃতিকথনে সঞ্জীব চৌধুরীর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখেছেন ইরাজ আহমেদ (সঞ্জীব চৌধুরী: নিঃসঙ্গ নির্মাণে), আনিসুল হক (সঞ্জীবদা), আবিদা নাসরিন কলি(মন খারাপের সঙ্গে আড়ি), টোকন ঠাকুর (যে ব্যথা লুকিয়ে সঞ্জীবদা গাইতেন), বাপ্পা মজুমদার (সঞ্জীবদা আমার বাতিঘর), শেখ রানা (যে পথ ধরে বাড়ি ফিরে গেছে সঞ্জীব চৌধুরী), মহাকাশ মিলন (আমার সঞ্জীবদা), শাহান কবন্ধ (অব্যক্ত অনুভূতি জীবনে বয়ে বেড়াই), আকলিমা নাসরীন লিপি (আমার দাদা সঞ্জীব চৌধুরী), জয় শাহরিয়ার ( সঞ্জীবদা : আমার ভাবনার স্কুল), সাহস মোস্তাফিজ ( একজন সঞ্জীব চৌধুরী)। এরসাথে যুক্ত আছে ডিস্কোগ্রাফি।

ইরাজ আহমেদ এভাবেই মূল্যায়ন করেছেন সঞ্জীব চৌধুরীকে : “আমি বলি, সঞ্জীব বিদায় নেয়নি। এই একবিংশ শতাব্দীর হুল্লোড়ের ভেতরে তার চলার পথ আমাদের জানান দেয়, কোনো কোনো নিঃসঙ্গ নির্মাণ আজও কী ভীষণ মূল্যবান।” একজন শিল্পীকে নিয়ে এরচেয়ে বেশি আর কী বলা যায়। সঞ্জীবদাকে নিয়ে ইরাজের এই কথাগুলো আবারও মনে করিয়ে দিল, কী হারালাম। কী চলে গেল।

বাপ্পা মজুমদার তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন: “সঞ্জীবদাকে শুরু থেকেই আমার কাছে একটা গোটা ইন্সটিটিউশন মনে হয়েছে। লেখার জায়গা, ভাবনার জায়গা কিংবা জীবন দর্শন সব জায়গাতেই তিনি ছিলেন অনন্য।.. সঞ্জীবদার না থাকার যে শূন্যতা সেটা আসলে অপূরণীয়। দাদাকে ছাড়া দলছুট সেই দলছুট নেই। সেটা সম্ভবও না। দাদা নেই মানে দলছুটের একটা সত্তা অনুপস্থিত। সেটা কখনোই পূরণ করা সম্ভব না।”

টোকন ঠাকুর লিখেছেন ; “অধিকার বঞ্চিত গণমানুষকে ভালোবেসে মিটিংমিছিল করেছেন। আশির দশকের সামরিক শাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যে জেনারেশন জীবনযৌবন বিসর্জন দিয়েছে রাস্তায়, সঞ্জীবদাও তাদের মধ্যে পড়েন। এই জন্যে দেখেছিলাম, যেদিন সঞ্জীবদার লাশ আনা হয় টিএসসিতে, শোকার্ত গণমানুষের ঢল নেমেছিল। এলিট সংস্কৃতির লোকেরা যেমন এসেছিল, নামগোত্রহীন রিকশাওয়ালা গোছের নিম্নবর্গের মানুষেও ভরে গিয়েছিল টিএসসির পরিপার্শ্ব। যারা তার গান ‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ / বায়োস্কোপের নেশা আমার কাটে না… ’ কিংবা ‘গাড়ি চলে না চলে না, চলে না রে…’ ভালোবেসে শিল্পীর শেষযাত্রার শোকে সামিল। আমরা আমাদের এক টেবিলের, হৃদয়ের, মননের শিল্পীকে হারিয়েছিলাম।”

শিল্পী সত্তার বাইরে একজন সঞ্জীব চৌধুরী মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন, তা জানতে পারি আকলিমা নাসরীন লিপির স্মৃতিচারণে। তিনি লিখেছেন: “একটা অদ্ভুত বিষয় হতো দাদার সাথে, তিনি যে এলাকাতেই থাকতেন এলাকায় তার অনেকগুলো কুকুর বন্ধু হয়ে যেতো। কাজের সুবাদে দাদা প্রায়ই অনেক রাতে বাড়ি ফিরতেন। যত রাতই হোক ওনার সাথে অনেকগুলো কুকুর ওনাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতো। এমনকি যদি দাদা ঢাকার বাইরেও যেতাম দাদাকে দেখলে কেন জানি কুকুররা চলে আসতো…. ”

সঞ্জীবদার সাম্যবাদী দর্শনের প্রয়োজনটা এখনো খুব সমকালীন। এই যে একটা ভোগবাদী সমাজে সবকিছু লাভ আর লসের হিসেবে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেই সময় সঞ্জীবদার মতো ক্যারিশমাটিক মানুষ ও তার দর্শনের খুব প্রয়োজন ছিল….” সঞ্জীবদাকে এভাবেই লিখেছেন জয় শাহরিয়ার। গভীর পর্যবেক্ষণ সঞ্জীবদাকে নিয়ে।

আসলে একজন শিল্পী হিসেবে তাকে যথাযথ সম্মান দিতে যদি না পারি, তার সৃষ্টিকর্ম একটা সময়ে হারিয়ে যেতে বাধ্য। হোক তা কম আর বেশি। গণমানুষের কাছে তো তিনি প্রিয় ছিলেন। যাহোক, এভাবেই “তোমাকেই বলে দেব” আর “সঞ্জীবনামা” বই দুটোর মাঝেই সঞ্জীব চৌধুরী প্রজন্মের কাছে থাকবেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা
পরবর্তী নিবন্ধআনোয়ারায় ঝোপে পড়ে ছিল নবজাতকের মরদেহ