‘শুধু শব্দ নিয়ে খেলতে যেয়ো না’

উপল বড়ুয়া | শুক্রবার , ৮ নভেম্বর, ২০২৪ at ৭:৩৮ পূর্বাহ্ণ

কবিতা যতটুকু না যাপনের তারও অধিক চর্চার। ভাষার সর্বোচ্চ প্রকাশের চর্চা না থাকলেও কবিতা লেখা যায় বটে; তবে মহত্ত্বম কবিতা আরও অধিক কিছু দাবি রাখে। শুধু ভাষার মাধুর্য, ভাবাবেগ, ছন্দের কারিকুরি, রূপক, উপমা, উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারই কবিতা নয়। কিংবা দৃশ্যের উপস্থাপন, রঙের ব্যবহার, দর্শন, মিথ হাজির করে কবিতা লেখা গেলেও সেটি যে সর্বোৎকৃষ্ট হয়ে উঠবে এমন কোনো আশা না করাই ভালো। এ সবকিছু কবিতায় থাকতে হবে এমনও নয়। কবিতা একটি সাধারণ শব্দের ওপরেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। হ্যাঁ্তকবিতার সবচেয়ে শক্তিশালী ও দরকারি অনুষঙ্গটি হলো শব্দ। এই কারণে শুধু শব্দের পর শব্দ বসিয়ে দিলেই চলবে না। আপনার বইয়ের সাদাপৃষ্ঠাটিতেও যেন পাঠক কিছু পড়তে পারে। যা সে কল্পনা করে, আপনার কল্পনা যেন তাকেও ছুঁয়ে যায়। তাই বলে শুধু শব্দের ব্যবহার বা শব্দহীনতাকে নিয়ে ভাবার মানে নেই। এক্ষেত্রে আমরা লিওনার্দ কোহেনের কথা স্মরণ করতে পারি, ‘শুধু শব্দ নিয়ে খেলতে যেয়ো না।’

তাহলে আমরা কী কী নিয়ে খেলব কবিতায়? ভাষা, ছন্দ, কাব্যরস, কল্পনা, আবেগ, বেগ, গত্তিসবকিছু নিয়ে। কবিতার প্রয়োজনে যখন যেটার দাবি তৈরি হয়। তবে সবকিছু যেন হয়ে ওঠে নির্মেদ। অযথা শব্দের গাঁথুনিতে যেন সবকিছু মুখরা না হয়ে ওঠে। এঅনেকটা ইতালো ক্যালভিনোর স্থাপত্যকলা চিন্তার মতোন। তাঁর মতো করে এভাবে বলা যায়, ‘আমি ভার কমায়ে ফেলার চেষ্টা করি: মানুষ থেকে, নক্ষত্রের গা থেকে, শহরের কাঠামো থেকেসর্বোপরি গল্পের বুনন আর ভাষার শরীর থেকে আমি সমস্ত ভার বাদ দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।’ ক্যালভিনোর গল্পের বুনন থেকে ভাষার ভারীত্ব কমিয়ে ফেলার মতোন কবিতা থেকেও অযথা শব্দ কথা ফেলে দেওয়ার পক্ষে আমি। এজরা পাউন্ড কি টি.এস. এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ থেকে অনেক কিছু বাদ দিতে বলেননি? যদি ‘ঘোড়া’ শব্দটি লিখে আমাকে পুনরাবৃত্তি করতে হয় প্রাণীটির বিবিধ পরিচয় ও কাজ তবে সেটি ঘোড়ার জন্যই অপমানজনক। নৌকা বললেই আমাকে বুঝে নিতে হবে ইহা এক প্রকার জলযান। যার ভেতর দিয়ে পানিতে বসেও স্বপ্ন দেখা যায়। কিন্তু এমন মেদহীনতা স্লোগানধর্মী কবিতাকে কীভাবে ব্যক্ত করবে? স্লোগানের কবিতা শুরু হয় অনেক উচ্চগ্রাম থেকে। তাই বলে মুষ্টিবদ্ধ হাতকে শুধু বাতাসে ঘুষি মারতে থাকলে বুঝতে হবে, সাময়িকতা ও সীমাবদ্ধতায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে সব। স্লোগাননির্ভর অনেক কালজয়ী কবিতাও কী উদাহরণ হিসেবে আমাদের সামনে নেই! যথাযথ শব্দের ব্যবহার না হলে যেকোনো ঘরানার কবিতা কেবল ব্যক্তিগত কথন বা সাময়িক উত্তেজনার অংশ হয়েই থাকবে। কবিতা কোনো শিশুতোষ বিষয় নয়। এএক খেলা। কারও কাছে পাজল মেলানো বা কারও কাছে ক্যাসিনোতে বসে জীবনের সঙ্গে বাজি ধরা। এত সরলও নয় অবশ্য বিষয়টা। অত জটিলও নয়।

স্লোগান ও গীতিধর্মী কবিতার বৈশিষ্ট্য হলো ওসব বোধের চেয়ে কানকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। ধরুন, কোহেনের ধুম্রজাল ও জলে ভেজা স্বরের গান। কবি পরিচয়ের চেয়ে তিনি আমাদের কাছে বেশি হাজির আছেন গায়ক হিসেবে। তাঁর লিরিককে পুরোপুরি কবিতা বলারও পক্ষপাতী নই আমি। তা হলে কবিতা ও গীতিকবিতা শব্দ দুটোর অর্থ ভিন্ন হতো না। একথা প্রযোজ্য বব ডিলানের ক্ষেত্রেও। সুর ও কথার কারণেই কোহেনের ‘ফেমাস ব্লু রেইনকোট’, ডিলানের ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’ কালজয়ী গান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার গীতলতার কারণে তাতে সুর বসালে কানে শুনতে আরাম লাগবে। কিন্তু মাইকেল মধুসূদন দত্তের, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বা এলিয়টের ‘দ্য লাভ সং অব জে. আলফ্রেড প্রুফক’ কবিতার কিয়দংশে সুর বসিয়ে গাওয়া হলেও নিশ্চয়তা দিতে পারি, শুনতে মোটেও ভালো লাগবে না। যতটুকু না অনুধাবনে ধাবিত হবেন, তার সিকি বা আট আনার আরাম পাবেন না কানে। এই কারণে কবিতা ও গীতিকবিতা আলাদা। কিন্তু কবিতা গণিত নয়, আমরাও সমাধানে বসিনি। বিনয় মজুমদারের কাছে কবিতা গাণিতিক সূত্রের হতে পারে। গাণিতিক সুত্রে ভোরে ফুল পাপড়ি মেলে হয়তো। নিয়ম মেনে চলতে পারে বিশ্বব্র্রহ্মাণ্ডের সমস্তকিছু। তবে আমাদের সময়ের কবিতা কোনো নিয়মের মধ্যেই পড়ে না। সে ব্যক্তিভেদে লৈঙ্গিক হলেও অলৈঙ্গিক। প্রকাশ্যে যতটুকু বলে তারও ঢের অপ্রকাশ্যে রেখে দেয়। হয়তো এই কারণেই কবিতার পাঠক যুগে যুগে সুনির্দিষ্ট; এমনকি কবিও। চটকদার দুই পঙ্‌তি বা অন্ত্যমিল টানলেই কাউকে কবি বলে ডাকার যে চল, সেটি একপ্রকার অপমানজনক বৈকি! জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বললে, ‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি।’

কেন কবি নয় সকলেব্যাখ্যাটাও তিনি দিয়েছেন পরের লাইনে। কল্পনা, চিন্তা, অভিজ্ঞতা এবং ভাষাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কবিদের জিনগত। এই নয় যে, আপনার পুর্বপুরুষদের কেউ কবি ছিল না বলে আপনি কবিতা লিখতে পারবেন না। এটা গুরুশিষ্যেরও ব্যাপার নয়। বলে রাখা ভালো, কবিতায় শিল্পকলা ও জ্ঞানচর্চার একমাত্র মাধ্যম যেখানে গুরুশিষ্য পরম্পরা নেই। তবে কীভাবে কবিতা রক্তপ্রবাহিত না হয়েও উত্তরসূরি পায়? এক্ষেত্রে আমরা জীবনান্দেরই শরণাপন্ন হতে পারি। ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’র কথা বলেই সে সমাধান দিয়ে দিয়েছেন তিনি। হাজার বছর ধরে মানুষের যে যাত্রা আমি ও আপনিও তার কিছু অংশ। এভাবেই আমাদের সমস্তকিছুর চর্চা ব্যাটন নিয়ে ছুটে যাওয়ার মতোন ভবিষ্যতে ধাবমান। মানুষ থেকে মানুষের জন্মের চিরন্তনের ন্যায় এক কবিতা থেকেই আসলে আরেক কবিতার জন্ম হয়। অ্যাডগার অ্যালান পো’র ‘টু হেলেন’ (To Helen) না পড়লে হয়তো জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ লেখা হতো না। কিংবা গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ না শুনলে হয়তো ‘আমার সোনার বাংলা’র সুর অন্যরকম হতে পারতো। আসলে এসব পরম্পরাই শিল্পসাহিত্যের শক্তি। তাই বলে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ নকল করে শিল্পী দাবি করা বা আরেকটি ‘দ্য স্ট্যারি নাইট’ আঁকতে চাওয়ার মানে হয় না। কবিতাও ঠিক তদ্রুপ। প্রভাবিত হলেও নিজের ভাষাকে পাশ কাটিয়ে হুবহু নকলের সুযোগ নেই। প্রেরণাকে শুধু গ্রহণ করা যায়। আমেরিকায় বসে ঊনিশ শতকে লেখা হেলেনের রূপকে এক শতক পর জীবনানন্দ বাঙালির রূপে হাজির করেছেন তো বটে, অ্যালান পোর কবিতাটির সঙ্গেও কি পরিচয় করিয়ে দেননি? কবিতারও যে প্রাণ আছে, জন্মান্তর আছে! সেও দিব্যি হাঁটচলা করতে পারে। ওসব আবিষ্কারের জন্য কবিকে তো বটে পাঠককেও তৈরি হতে হয়। এব্যাপারে মনীন্দ্র গুপ্তের কথা দিয়েই উপসংহারে আসি, ‘সমস্ত জীবন্ত বস্তুর মতো কবিতারও জন্ম, বৃদ্ধি, জননক্ষমতা ও মৃত্যু আছে।’ উপসংহার মানে মীমাংসা নয়। কবিতা জোয়ার ভাটার মতো চলমান প্রক্রিয়া।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার্ত

কবিতার কথা। জীবনানন্দ দাশ

তরুণ কবিকে বলি। সম্পাদনা ও অনুবাদ: সুহৃদ শহীদুল্লাহ

গায়েবি শহর। ইতালো ক্যালভিনো। অনুবাদ: তুহিন খান

upalbarua10@gmail.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধজয়দেব কর-এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধরিডার্স স্কুল এন্ড কলেজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলা