রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনসমূহ আগামী ১ অক্টোবর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করবে এবং পরবর্তী তিন মাস অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিশন তার সংস্কার প্রস্তাবনা সরকারের নিকট উপস্থাপন করবে। কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, ছাত্র প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ৬ সংস্কার কমিশনের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে এসব সিদ্ধান্ত হয়। রাজধানীর তেজগাঁও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্র্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজুল আলম এসব কথা বলেন। খবর বাসসের।
আসিফ নজরুল বলেন, কমিশনগুলো ১ অক্টোবর থেকে তাদের কাজ শুরু করবে এবং আশা করছি ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তারা একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দ্বিতীয় ধাপে উপদেষ্টামণ্ডলী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু করবে। তিনি জানান, এরপর আরও বৃহৎ আকারে আলোচনা হবে যেখানে সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পরে সেগুলো অনলাইনে উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে, যাতে সকলে তাদের মতামত পাঠাতে পারেন।
ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার কথা উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা শুধু নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সেটা ছিল একটা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন এবং প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। বাংলাদেশে যেন আর কোনোদিন, কখনো যেনো ফ্যাসিবাদী শাসন জাঁকিয়ে বসতে না পরে সেটা রোধ করতে কী কী সংস্কার প্রয়োজন সে লক্ষ্য নিয়ে সংস্কার কমিশন প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করেছে বলে জানান তিনি।
সংস্কার কমিশনের কর্মপদ্ধতির বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজুল আলম বলেন, দেশের মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে ফ্যাসিবাদী শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ঠ ছিল। এখন জনগণের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি যেমন আছে, তেমনি গত ১৫ বছরে দেশের সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো জনগণের স্বার্থে কাজ করতে পারছে না। এগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। কমিশনগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করবে। তাদের ওপর কোনো রকম রাজনৈতিক চাপ না থাকবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কমিশনের প্রধানদের বৈঠকের বিষয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আরও বলেন, বৈঠকে প্রধানত আলোচনা হয়েছে সংস্কার ভাবনা নিয়ে। কমিশনগুলো কীভাবে কাজ করতে চায়, কর্মপদ্ধতি কী হবে, সদস্য বাছাইয়ের প্রক্রিয়া কী হবে, কবে প্রতিবেদন দেবেন, রাজনৈতিক দল বা পেশাজীবী সংগঠনের অংশগ্রহণ কীভাবে হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ছাত্র–জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা ছাড়া অন্য সকল শ্রেণি–পেশার মানুষের পরামর্শ সংস্কার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ গণহত্যাকারী ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। আমাদের প্রায় অন্তত এক হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। আরও অনেক অনেক মানুষকে গুরুতর আহত করেছে, চক্ষুহীন–দৃষ্টিহীন করেছে। যারা বিচারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হবে না। তাদের বাদে সমাজের যত প্রতিনিধিত্বকারী শ্রেণি আছে, রাজনৈতিক দল আছে, সামাজিক, পেশাজীবী, ছাত্র সংগঠন, বিপ্লবী অভ্যুত্থানে ছিলেন– তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে যতভাবে পারা যায় মতামত প্রতিফলিত করা হবে। অতীতের কমিশনের রিপোর্টগুলোও এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
গণহত্যার বিচারের মুখোমুখি করতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের সঙ্গে ভারতের বন্দী বিনিময় চুক্তি আছে। সেখানে যদি কোনো সাজাপ্রাপ্ত আসামি থাকেন, উনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা যা–ই হোন না কেন, উনার প্রত্যার্পন আমরা চাইতে পারি। তিনি বলেন, ছাত্র–জনতার অন্দোলনের সময় যে গণহত্যা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, সেটার বিচারের লক্ষ্যে আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যে নিয়েছি। ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং অচিরেই আদালত পুনর্গঠন করা হবে। পূর্ণাঙ্গভাবে বিচার কার্যক্রম শুরু হলে সরকার শেখ হাসিনার প্রত্যার্পণ চাইবে বলে জানান তিনি।
সংবিধান সংশোধন কী প্রক্রিয়ায় হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে আসিফ নজরুল বলেন, সংস্কার কমিশন সকল সম্ভাবনা পর্যালোচনা করবে। সেটা গণভোট কিংবা গণপরিষদের মাধ্যমে হতে পারে। গণপরিষদ সংবিধান তৈরি করতে বা গ্রহণ করতে পারে। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নের কাজ চলতে পারে। কী হবে সে সিদ্ধান্ত আমরা নেব না, সেটা নেবে বাংলাদেশের জনগণ। জনগণের পক্ষে কাজ করার জন্য এ কমিশন গঠন করা হয়েছে। সেখানে সমাজের সকল স্তরের মানুষের মতামতের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হবে।
বিচার–বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর মনোভাবের কথা উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, স্পষ্টভাবে বলতে চাই কোনো রকম মব জাস্টিস, আইন নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া, গণপিটুনি বা বিচার বহির্ভূত–হত্যাকাণ্ড কোনোভাবে গ্রহণ করা হবে না। এগুলো যদি ঘটে আপনাদের নিশ্চিত করতে পারি সরকার তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেবে এবং বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবে।
ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ব্যক্তির নিহত হওয়ার ঘটনা ইঙ্গিত করে আসিফ নজরুল বলেন, যে মব জাস্টিসের ঘটনা দেখেছি, তা আমাদের সবাইকে মর্মাহত করেছে। কষ্ট দিয়েছে। আমরা তাৎক্ষণিক এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। তিনি জানান, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে ইতোমধ্যে চারজনকে আটক করা হয়েছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, এ ধরনের ঘটনা এড়ানোর জন্য যত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, আমরা তা নেব।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা একটা কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনে ছিলাম। বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হয়েছি। ভোটাধিকার থেকে শুরু করে বহুক্ষেত্রে বঞ্চনা। এটার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে এ জন্য কতগুলো পরিবর্তন আনতে হবে। কতগুলো সংস্কার করতে হবে।